ইন্দ্রাণী পাঠক।
অধিকার বোধটা খুব জ্বালা দেয়। অনিঃশেষ ভালবাসা সেতো অধিকার আছে বলেই হয়ে থাকে। এত ক্ষমতা, দাপট সব কি অধিকারের দখলে? বিশ্লেষণ করতে গেলেই বিপত্তি ঘটে। শিশু অধিকার, স্ত্রী অধিকার, স্বামীর অধিকার, সমাজের অধিকার, শিক্ষার অধিকার, সুবিধা বঞ্চিতদের অধিকার, খাওয়ার অধিকার, কথা বলার অধিকার আরো কত অধিকার!!!! শেষ হবে না বলে কয়ে।
এত এত অধিকারের কথা আসছে এখন কথা হলো এই অধিকার পাওয়ার বা রাখার যোগ্যতা কতটুকু আমাদের আছে! আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে প্রথমেই ভালো মানুষ হওয়ার অধিকার নিয়ে কি দাবী করেছি কখনো? মৌলিক অধিকারগুলো পুরণ হওয়ার সাথে সাথে কিছু ন্যায্য, অন্যায্য অধিকার খাটানো আমাদের স্বভাব হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেটা সব কিছুর উপরেই। আমাদের ক্ষুধা, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা মেটানোর পর ও কিছু অনধিকার চর্চা করে থাকছি। প্রাসঙ্গিক একটি বিষয় তুলে ধরলাম এখানে।
অতি শিশু বয়সে আমরা শিশুকে পড়ানোর অধিকার খাটাচ্ছি। শিশুর বয়স ৩/৪ পার হতে না হতেই কি উৎকণ্ঠা আমাদের! স্ত্রী তার স্বামীকে বলছে দেখ বাবুসোনা আমার তাই ওর পড়াশুনো দেখার অধিকার আমার….. আবার স্বামী তার স্ত্রী কে বলছে মনিমার দায়িত্ব কেবল আমার।আচ্ছা ভাবুন তো আপনাদের সন্তানদের উপর যে অধিকারবোধ টুকু আপনারা চাপাচ্ছেন তারা আসলেই কি এই অধিকারের আওতায় পরে?
জানি বর্তমান পরিস্থিতিতে বিদ্যালয়ে ভর্তি করানো এক এলাহি ব্যাপার। কিন্তু বাবা মা হিসেবে সন্তানের ভাল-মন্দের ব্যাপারে অধিকার রাখা অবশ্যই আপনাদের আছে। কিন্তু একটু ভেবে দেখুন তো ঐ কোমলমতি শিশুর কি অবস্থা! প্রথমে আপনার শিশুকে শিশুসুলভ আচরণে বেড়ে উঠার অধিকার দিন। তাকে তার আনন্দময় জগৎ চিনতে সাহায্য করুন। তার আশে পাশে থেকে তাকে নিশ্চিন্ত করুন আপনি সর্বদা কেবল বাবা মা নন তার বন্ধু। এটুকু তাকে বুঝতে দিন। তাকে বইয়ের ব্যাগের ভারে অনিরাপত্তা না দিয়ে বাড়িতে কিছু কিছু মুল্যবোধ শিক্ষার নিরাপত্তা দিন। দয়া করে রাগ করবেন না আপনারা। জানি সবটুকু করেন আপনারা। তাহলে কেন শিশু সঠিক সময়ে বিদ্যালয়ে যায় না? কারণ সে সময়মত ঘুমাতে দেরি করে।অনেক রাত করে বসে টিভিতে বিভিন্ন অনুষ্ঠান দেখে নয়তো গেমইস খেলে। তাকে রোজ সঠিক সময়ে ঘুমানোর তাগিদ আপনাকে দিতে হবে।এজন্য আপনি ও তাড়াতাড়ি ঘুমাতে যাবেন।
এতে শিশু তার শৈশবে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করবে পরিবার থেকে বাবা -মা থেকে। বিরক্ত হবেন না আমার কথায়। সবকিছুর বিনিময়ে আমরা আমাদের অধিকার বোধটুকু দিতে বা নিতে গিয়ে কি শিশুর ক্ষতি করে ফেলছি নাতো! আমি এও বলছি না শিশুকে বিদ্যালয়ে না পড়াতে। তবে বয়স টা একটু ভাবুন। আচ্ছা আমরা আগে যা যা পড়েছি তা কি এখন আছে? নেই। অনেক টা বাড়তি বিষয় যোগ হয়েছে সেটা বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার প্রেক্ষাপটে। আপনার শিশু হয়তো সেই পড়া গ্রহণ করতে পারছে আবার তার সমবয়সী সে পারছেনা। সকলের মেধা, যোগ্যতা এক নয়। কম বেশি হয়। বিপত্তি ঘটে সেখানে। কেন পারছো না তুমি? পাশের ছেলে/ মেয়ে পারলে তোমায় ও পারতে হবে.. এধরনের অধিকার রাখা কি ঠিক? আচ্ছা ধরুন এস এস সি পরীক্ষার ফলাফল দিল…. পাশের বাড়ির মেয়ে/ ছেলে গোল্ডেন পেল আপনার সন্তান একটা বিষয়ের জন্য গোল্ডেন হাতছাড়া করে ফেললো। দিলেন বকা, অপমান সুচক বানী। আবার প্রতিবেশিরা জিজ্ঞেস করে বসে দিদি/ দাদা আপনার সন্তান কে ভালো শিক্ষক রেখে পড়ান নি? ভাই কে আপনাকে এই অধিকার দিয়েছে এসব শিশু কিশোরদের মনে আঘাত দেয়ার? আগে নিজেকে পরিশুদ্ধ করুন।
বিবেক, বুদ্ধি খাটিয়ে সন্তান কে ভালো মানুষ হওয়ার প্রাথমিক শিক্ষা দেয়ার অধিকারের যোগ্যতা অর্জন করুন। আপনার আমাদের কথা ঐ শিশু- কিশোরদের মনকে হত্যা করে প্রতিনিয়ত। হাতের পাঁচ আংগুল যেমন সমান নয় ঠিক সব পরিবারের সব শিশু এক রকম নয়। এরপর আসা যাক কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে। পত্রিকা খুললেই দেখি আত্মহত্যা। কেন রে বাবা! আপনি কি জানেন না আপনার সন্তানের ক্ষমতা কতটুকু। আনন্দে খুশিতে তাকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বানানোর জন্য বিজ্ঞান বিষয় চাপিয়ে দেন নতুবা তাদের কথায় তাকে সেই বিষয় পড়ান। আপনি অধিকার রাখেন সেই ক্ষেত্রে যা আপনি জানেন। আপনি জানেন আপনার সন্তান বিজ্ঞানে কম পারছে কিন্তু ইংরেজি, বাংলাতে তুখোড় আবার ব্যবসা শিক্ষায় ভালো করতে পারবে তাহলে তাকে কাউন্সেলিং এর মাধ্যমে বোঝান। এই অধিকার আপনার আমাদের আছে কিন্তু বিষয় চাপিয়ে দেয়ার অধিকার নেই। আমি বিজ্ঞান বা ব্যবসা বা সাহিত্য বিষয়কে হেয় করছিনা। শুধু বলতে চাইছি আপনি তো জানেন আপনার সন্তান প্রাক্-প্রাথমিক থেকে অষ্টম শ্রেনি পর্যন্ত কেমন ফলাফল করছে। তাহলে জেনে শুনে নিজে এবং সন্তান দুজনেই কেন বিষ পান করছেন?
কে অধিকার দিলো আপনাদের? কেউ দেয়নি, শুধু প্রতিযোগিতা আর প্রতিযোগিতা ভিড়ে হারিয়ে ফেলছি আমাদের সন্তানদের। প্রতিযোগিতা থাকবে তবে তা সঠিক জায়গায়। সন্তানকে চাপিয়ে দেবেন না কিছু। বন্ধু হোন, তার মনের কথা জানার অধিকার রাখুন, তার আনন্দ কষ্টের সহভাগিদার হোন। পাশের বাড়ির সন্তানের সাথে তুলনা না করে আপনার সন্তানের স্বকীয় সৃষ্টিশীল কাজের সন্ধান করুন, প্রশংসা করুন। এই অধিকারবোধ আপনার, আমার, আমাদের অবশ্যই আছে। তাই সঠিক ক্ষেত্রে সঠিক অধিকার রেখে সন্তানের ভবিষ্যৎ আমরা, আপনারা এগিয়ে নিতে পারবো।
সন্তান বড্ড আদরের, বড্ড মায়া। প্রাণ আইঢাই করে সন্তানের কষ্টে আমাদের। কিন্তু তাদের এই সুপ্ত কষ্টের অংশীদার যদি আমরা, আপনারা হতে পারি তাহলে শতভাগ নিশ্চিত সাফল্য আপনার ঘরেই বসে আছে। জয়, পরাজয় মেনে নেয়ার মানসিকতা তৈরি করুন তাদের মধ্যে, সাবলীল আচরণ গড়ে তুলুন, ভাল- মন্দের বিচার করাতে শেখান। দেখবেন তার মধ্যে আত্মবিশ্বাস গড়ে উঠছে আর আপনি তখনই বুঝবেন আপনার সন্তানের প্রতি আপনার অধিকার সফল হয়েছে।
ত্রুটির সীমানা পাড় করে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মাঝি হই আমরা…. বাবা,মা, শিক্ষক, সমাজ এবং রাষ্ট্র। সঠিক অধিকারের জয় হোক। জয় হোক মানবতার। সফল ও নিরাপদ হোক আগামী দিনের শিশুদের পথচলা।