শম্পা সাহা
কাজ শেষ হলে এক সময় সনৎ নিজেই দরজা খুলে দেয়। শীতের চাঁদরে শরীর ঢেকে উঠোন পার হয়ে নিজের ঘরে আসে বকুল। ঘর অন্ধকার ছিল। এখন আলো জ্বলছে। নিখিল ফিরেছে। মেয়ের দিকে না তাকিয়েই সে বলে-
-কোথায় ছিলি রে মা? কখন থেকে তোর জন্য অপেক্ষা করছি।
নিখিলের কথার কোন উত্তর দেয় না বকুল। অপকৃতস্থ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সে। তোর খোলা চুল। ছেঁড়া জামা, শরীরে রক্ত। নিখিল এসে জড়িয়ে ধরে বকুলকে। ডুকরে কেঁদে উঠে।
-আমাকে নিয়ে তুমি কত স্বপ্ন দেখেছিলে বাবা। আজ আমি ————–। তোমার সব স্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে এলাম।
সনৎ ——- আমাকে ————
নিখিলের মাথায় যেন বাজ পড়ে। শরীরের মধ্য দিয়ে শিহরণ বয়ে যায়। হৃৎপিন্ডে এক প্রচন্ড ধাক্কা। একি শুনছে সে। মেয়েকে আরো শক্ত করে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে সে।
-আমাকে ছুঁয়ো না বাবা। —————-আমি তো অপবিত্র হয়ে গেছি। —–আগে আমি স্ন্যান করে আসি।
বন্ধ ঘরে বকুলের মাথার কাছে বসে আছে নিখিল। গায়ে দুটো লেপ চাপিয়েও বকুলের শরীরের কাঁপুনি বন্ধ করা যাচ্ছে না। অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে মেয়েটা। রাত কত জানে না সে। বাইরে পলাশ আর পূর্ণিমার কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে। তার মানে সিনেমা দেখে ফিরেছে ওরা। দরজা খোলে নিখিল। অসহনীয় শীত বাইরে। পলাশকে ঘরে ডাকতেই খেঁকিয়ে উঠে সে।
-তাকিয়ে দেখ। সনৎ ——— অত্যাচার করছে বকুলকে। কি অবস্থা মেয়েটার।
-এক হাতে তো তালি বাজে না। নিশ্চয় বকুল ওর ঘরে গিয়ে কোন ঢলাঢলি করছে। চেঁচিয়ে উঠে নিখিল।
-আর কত নীচে নামবি তুই? তোর মা চলে যাবার পর সেই দুই বছর বয়স থেকে বকুল তোকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছে। আর আজ—-
-মা যেমন, মেয়ে তো তেমনই হবে।
-আমি এর বিচার চাই। সালিশ ডাকব। মেয়েটার কি হবে এখন?
-সালিশ! বিচারে কি হবে? সবাই জানবে। আর তোমার আমার মুখে চুন কালি পড়বে। সনৎ-এর গলায়
বকুলকে ঝুলিয়ে দেওয়ার জন্যই হয়তো, তোমরা ইচ্ছা করে এই কাজ করেছো।
কথাটা বলে চলে যায় পলাশ। পলাশের ওপর ঘৃণা হয় না নিখিলের। ঘৃণা হয় নিজের ওপর। এমন কুলাঙ্গার
ছেলের জন্মদাতা সে। কখনো অচেতন আবার কখনো ঘোরের মধ্যে কথা বলে চলছে বকুল। আবার কখনো ভয়ে আর্তনাৎ করে উঠছে সে।
-আমি আপনাকে দাদা ডাকছি। ————— আমার এত বড় সর্বনাশ আপনি। আমি আপনার পায়ে পড়ি। আপনি আমাকে ছেড়ে দেন।
-ভাই! কে ভাই? পলাশ আমার ভাই নয়।
-মা এসেছে? মিথ্যা কথা। কোন দিনও মা আসবে না। মার মত পলাশও আমাদের ছেড়ে চলে গেছে।
-আমি তোমাকে ছেড়ে যাব না বাবা। বল, তুমিও আমাকে কোনদিন ছেড়ে চলে যাবে না।
আরো পড়ুন: আঁধারে আলো || ১ম পর্ব
বকুলের মত নিখিলের শরীরে কাঁপুনি। তবে এই কাঁপুনি শঙ্কা, ভয় আর অজানা ভবিষ্যতের। অপমানে, ঘৃনায়, লজ্জায় সারাটা জীবন কেটেছে তার। বাকী জীবন এখন কিভাবে কাটবে বকুলের? কি হবে এই নিষ্পাপ মেয়ের ভবিষ্যৎ? চিৎকার করে নিখিলের বলতে ইচ্ছে করে, মেয়ের এই অবস্থা, একবার এসে দেখে যাও শিউলি। বুকের মধ্যে স্বযতনে আগলে রাখা বকুলকে নিয়ে দেখা স্বপ্ন আজ চিরদিনের মত ভেঙ্গে গেল। অন্ধকারে ঢেকে গেল মেয়েটার জীবন। আর কোনদিনই আলো আসবে না সে জীবনে। নিখিলের মনে হল, সন্তানের লাশের চাইতেও ধর্ষিত মেয়ের জীবনের ভার একজন পিতার কাছে অনেক বেশি ভারী। কি অব্যক্ত কষ্ট! কি দীর্ঘ এই রাত!
সন্ধ্যার পর থেকে এখন নিশ্চুপ চারিদিক। সেদিনের ঘটনার পর, পরদিন সকালে পলাশ, পূর্ণিমা আর সনৎ চলে গিয়েছে। এক মাস গড়িয়ে গেলেও পলাশ এখনো ফেরেনি। বকুল যে কদিন অসুস্থ ছিল, কাকিমা এসে রান্না করে দিয়েছে। আবার কখনো নিখিল দোকান থেকে খাবার নিয়ে এসেছে। খাবার মুখে উঠেনি। ও ভাবেই নষ্ট হয়েছে। এভাবেই দিনের পর দিন কেটেছে। নিখিল এখন আর রাত করে না। সন্ধ্যা নামতে না নামতেই বাড়ি চলে আসে। বকুল এখন রান্না ঘরে যায়। উনুন জ্বালায়, ভাত তুলে দেয়। তবে সব সময়ই আনমনা। আনমনা হয়ে তাকিয়ে থাকে পথের পানে, আকাশের দিকে। রান্না করতে করতে তরকারি পোড়ার গন্ধে কাকিমা এসে দেখে উনুনের সামনেই বকুল বসে আছে। পরম যত্নে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে প্রশ্ন করে-
-কি হয়েছে তোর?
মুখে হাসি ফুটিয়ে স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করে বকুল। কিন্তু পারে না।
-কিছুই যদি না হবে, তাহলে তোর চোখের নিচে কালি ক্যান? তোদের মুখের দিকে তাকানো যায় না। তোর বাপের সাথে তুইও শুকায়ে শুকায়ে কঙ্কাল হচ্ছিস। কারো সাথে কথা বলিস না। সারাদিন মুখ কালো। এখনো পযন্ত কেউ কিছু জানে না ভেবে, নিখিলের মন থেকে ভার কিছুটা নেমেছে। কিন্তু বকুল! নারীত্বের প্রকাশ বন্ধ হয়ে মাতৃত্বের প্রকাশ ঘটেছে তার জীবনে। সনৎ তার চিহ্ন রেখে গেছে বকুলের শরীরে। ওর গর্ভে লালিত হচ্ছে সন্তান কেউ জানে না। প্রতিনিয়ত, প্রতিক্ষণ, প্রতি মূহুর্ত নিজের সাথে যুদ্ধ। ক্ষত-বিক্ষত রক্তাক্ত হৃদয়। কেউ দেখে না, কেউ বোঝে না। মনের অতল গহর থেকে উঠে আসে একটি সিদ্ধান্ত। বকুলকে স্বাভাবিক হতে দেখে খুশি হয় নিখিল। আবার শঙ্কাও জন্ম নেয় মনে। নিভে যাবার প্রদীপও ধপ করে জ্বলে উঠে। বকুলের এই সব কিছুই আবার নিভে যাওয়া নয় তো! একে একে বকুল ঘরের বিছানার চাদর, নিখিলের জামা কাপড় সব পরিস্কার করে। বাড়তি কাপড় ট্রাঙ্কে তুলে রাখে। খাট, টেবিল, আলনার ধুলা ঝেড়ে পরিস্কার করে। তারপর একদিন পাশের বাড়ির মানিককে দিয়ে নিখিলের পছন্দের মাছ নিয়ে আসে। লাউ, চিংড়ি, রুই মাছের মাথা দিয়ে মুগ ডাল, আরো দু-তিন পদ রান্না করে। দুপুরে নিখিলের সাথে একসাথে বসে খায়। রাতের ভাত রান্না করে উনুনের কম আঁচে বসিয়ে রাখে। তারপর সন্ধ্যা গড়িয়ে রাতের অন্ধকার আরো গাঢ় হলে- ঘরের বারান্দার আলো জ্বালিয়ে রেখে ঘর থেকে বের হয় সে। তার পরিচিত রাস্তা, রাস্তার পাশের পালের পুকুর। বটতলা, কালী মন্দিরে পাশ দিয়ে, রহমান দাদার প্রসাদসম দোতলা বাড়ির পিছন দিয়ে অবশেষে তার স্কুল ঘরের সামনে দিয়ে স্টেশনের দিকে যায় বকুল। দশ বছর আগের গ্রাম আর এখন নেই। সন্ধ্যার পর এখন আর অন্ধকার নামে না। মাটির রাস্তা পাকা হয়েছে, গাছপালা কেটে নতুন বাড়ি উঠেছে। রাস্তার ল্যাম্প পোস্টে মিটমিট আলো জ্বলে। রাত আটায় এখন আর কেউ ঘরের মশারী টানায় না। শীত নেই, তবুও বড় চাদর দিয়ে তার মাথা ঢাকা। শুধু চোখ দুটো বাইরে। সেই চোখ দুটো বার করে জলে ভরে উঠছে। চাইলেও সে তার চোখের জল আটকাতে পারছে না। বারবার করে সে ফিরে ফিরে চাইছে তার ভাঙা বাড়ির দিকে। তার শৈশব, কৈশোর, ছাড়িয়ে ও জীবনের প্রতিটি ক্ষণ, প্রতিটি মূহুর্ত সব কেটেছে এই বাড়িতে। তবে সুখে নয়- দুঃখে, ব্যথায়, কষ্টে। বারবার করে সেই সব স্মৃতিই আসছে তার সামনে। তাকে পিছন ফিরে ডাকছে। সব কিছু মিলিয়ে অন্ধকারে শুধু চোখে পড়ছে বারান্দার হলুদ বাতির আলো। সেই আলোই সে প্রাণ ভরে দেখে নিচ্ছে। তবে একবার নয়, বারবার। রাস্তা ছেড়ে ক্ষেতের আইল ধরে হাঁটতে লাগল বকুল। রাত দশটার ট্রেন ঢাকা যায়। এই ট্রেন তো ধরতেই হবে তাকে।
কমলাপুর রেল স্টেশন। ট্রেনের যাত্রা, সমান্তরাল রেল লাইন দুটো-ই শুরু ও শেষ এখানে। অপরিচিত, অচেনা, অজানা- শুধু মানুষ এখানে। কত ট্রেন, কত প্লাটফরম। কখনো লোক নিয়ে ট্রেন প্লাটফরম ছাড়ছে। কিছুুটা লোক কমছে। আবার লোক নিয়ে ট্রেন আসছে। ট্রেন থেকে নেমে সবাই তাড়ায় থাকে। সবাই ছুটে চলে তার গন্তব্যে। শুধু গন্তব্যহীন, উদ্দেশ্যহীন, ঠিকানাহীন বকুল। সবার যাবার পথে সে শুধু তাকিয়ে থাকে। সকালের দিকে একবার প্লাটফরম থেকে বাইরে বের হয়েছিল সে। কত বড় রাস্তা! সারিসারি গাড়ি! কত মানুষ। সবকিছু অপরিচিত। কোথায় যাবে সে? কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে, আবার এখানে ফিরে এসেছে। লম্বা প্লাটফরমে কোথাও জুতা পালিশ, কোথাও পান, বিড়ি, সিগারেট আবার কোথাও চা-বিস্কুট, কলা বিক্রি হচ্ছে। আরো একটু দূরে দোকান। সেখানে সাজানো কত কিছু। একাকী হাঁটতে থাকে বকুল। তবে এবার বিপরীত দিকে। সামনে ভীড় কম। প্লাটফরমটা শেষ হতে হতে যেখানে ঢালু হয়ে মাটির সাথে মিশে গেছে। সেখানে এসে বসে সে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল নেমেছে। তবুও রোদের কত তেজ এখানে। আকাশের দিকে তাকায় বকুল। বাড়ির আকাশ-উঠোনের কদম গাছ, নারকেল গাছেল পাতার আড়ালে ঢাকা থাকত। আর এখানে- শুধু খাঁ খাঁ করা আকাশ। হঠাৎই চোখ আটকে যায় বকুলের। তবে, আকাশে নয়, মাটিতে। হয়ত তার চেয়ে বয়সে ছোট হবে মেয়েটা। তার শীর্ণ দেহে কাপড়ে জড়ানো খুব ছোট এক শিশুকে তার দুধ দিচ্ছে। ছোট সেই মুখটি বকুল দেখতে পেল না ঠিকই। কিন্তু সেই মুখটিই বকুলের সমস্ত চেতনাকে জাগিয়ে তুলল। বাড়ি থেকে চলে আসার উত্তেজনায় সে সব কিছু ভুলে ছিল। মনের গভীরে আবার সব ফিরে এল। মা হতে চলছে সে। তার শরীরের মধ্যে বেড়ে উঠছে একটি প্রাণ। একটি জীবন। আর কিছু ভাবতে পারে না বকুল। সময় পার হয়। চারপাশের এত কোলাহল এত লোকজন তবুও সবকিছু ছাপিয়ে বারবার নিখিলের মুখটা ভেসে আসছে তার সামনে। গতকাল রাতে তাকে খুঁজে ছিল বাবা। সেই খোঁজা কি এখন বন্ধ হয়েছে? না-এখনো তাকে খুঁজেই চলছে। ক্লান্ত বিধ্বস্ত শরীরে বাবা এখন কোথায়? মা একবার বাবাকে কষ্ট দিয়েছিল। সেই একই কষ্ট সে আবার বাবাকে দিল। আর ঐ রান্না-ভাত-ডাল সেগুলো! রান্না করার সময় একবারও তো তার মনে হয়নি, এই অবস্থায় খাবারগুলো বাবার গলা দিয়ে নামবে না। ক্ষণে ক্ষণে বকুলের মন চাইছে বাড়ি ফিরে যেতে। ঐ ট্রেনে উঠলেই তো বাড়ি পৌঁছে যাবে সে। গিয়ে বাবার বুকের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়বে। এতদিন বকুলের ভিতর থেকে একজন সবসময় তাড়া দিয়ে বলত-
-বকুল তুই পালা, তুই পালিয়ে যা। আজ সেই যেন আবার বলছে-
-তুই ভুল করেছিস, খুব বড় ভুল।
তাকে চাপা দিয়ে বকুল নিজের মনে চিৎকার করে উঠে।
-সে ভুল করেনি। বাড়িতে আশপাশে কেউ এই ঘটনা জানে না। কিন্তু, কত দিন সে লুকিয়ে রাখবে? একদিন সবাই জানবে। পলাশ সেদিন তার পাশে দাঁড়ায়নি। কোনদিন দাঁড়াবে না। বাবা ছাড়া কেউ তাকে বিশ্বাস করবে না। চলে এসে সে বাবাকে কষ্ট দিয়েছে সত্য। কিন্তু এই লজ্জা, এই অপমান! আজ এখানে কেউ তাকে জানে না, কেউ তাকে চেনে না। কেউ তাকে দেখিয়ে বলবে না ঐ যে বকুল! বিয়ে হয়নি। অথচ মা হতে চলছে। ওর মা সেও তো নষ্ট মেয়ে ছিলো। চরিত্রহীন।
রাত কত জানে না বকুল। সাথে যে টাকা ছিল সেই টাকা দিয়ে দু-তিন দিন কেটেছে। আজ সকালের পর থেকে পেটে কিছুই পড়েনি। ক্ষিধায়, তৃষ্ণায়, কষ্টে চোখে জল আসছে তার। কত ট্রেন যায় দিনে ও রাতে। রেল লাইনের ওপর গিয়ে দাঁড়ালে একসাথে তারা দুজনই মরতে পারে। রেল লাইনের এ পার আর ওপার! কত সামান্য দূরত্ব! এপারে ক্ষুধার জ্বালা, কষ্ট! আর ওপারে সব শেষ! মুক্তি। তবুও সে এই কষ্ট আকড়ে বেঁচে আছে। ট্রেনের সামনে দাঁড়িয়ে মরতে পারছে না। এই নিকোষ কালো অন্ধকারের মত তার ভবিষ্যৎ। নিজের কষ্টকে আর চাপা দিয়ে রাখতে পারে না বকুল। হাঁটুতে মুখ গুঁজে হু হু করে কাঁদতে শুরু করে। হঠাৎ তার পিঠে এক হাতের স্পর্শ অনুভব করে। মুখ তুলে দেখে মধ্য বয়সি এক পুরুষ। বকুলকে সাথে নিয়ে ভাতের হোটেলে আসে সে। নিজের টাকায় খাওয়ায় তাকে। কতদিন পেট ভরে ভাত খায়না বকুল। রাক্ষসের ক্ষিধা যেন তার পেটে। বকুলকে তার বাড়ি নিয়ে গিয়ে কাজ দেবার কথা বলে লোকটি।
অন্ধকারে রেল লাইন ধরে যাবার পথে কিছু দূর গিয়ে মালগাড়ির ফাঁকা বগিতে বকুলকে নিয়ে উঠে সে।
তারপর সনৎ যা করেছিল, একই কাজ সে করে বকুলের সাথে। যাবার সময় বলে-
-আমি অনেক সুখ পাইছি। খুব খুশি। তোর ঐ শরীরের টানে আমি আবার কাল আসবো। আজ যেখানে ছিলি, সেখানেই থাকবি।
এই সংসারের দৈনন্দিন সব কাজ- ঘর পরিস্কার করা, বাসন মাজা, রান্না করা, কাপড় ধোয়া আরো কত কিছু। দৈনিক একই কাজের পুনরাবৃত্তি নিয়ে এতগুলো বছর কেটেছে বকুলের। অথচ আজ! আজ তার কোন তাড়া নেই, কোন কাজ নেই। তার ভাত রান্না নেই, তারকারি কাটা নেই, চুলায় আগুন দেওয়া নেই। বাবাকে খেতে দেওয়া নেই। কোন কিছুই নেই আজ তার। আজ তার ঘর নেই, ঠিকানা নেই, পরিচয় নেই। আজ আছে তার শুধু —— একান্ত অবসর। বাড়ি থেকে আসার পর এ পর্যন্ত স্ন্যান হয়নি।
কি বিশ্রী গন্ধ বের হচ্ছে শরীর দিয়ে। মাথার চুলের কি অবস্থা। সারাদিন কেটে গেছে। এখন সকাল হলেই রেল লাইনের ধার ঘেঁসে দাঁড়িয়ে থাকা চায়ের দোকান অথবা ভাতের দোকানে কাজ খোঁজে বকুল। কাজ পেলে সারাদিন ভালই কাটে। রাতে দোকান বন্ধ হলে প্লাটফরমে আসে সে। তবে রাতে এখানে অন্ধকার নামে না। ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকে না। প্লাটফরমে ছেলে, বুড়ো, জোয়ান, নারী-পুরুষ সবাই পাশাপাশি মুখ ঢেকে শুয়ে থাকে। বকুলও এসে ভিড় জমায় সেখানে। সবাই ঘুমায়। শুধু ঘুম নামে না বকুলের চোখে। মনের মাঝে মায়ের মুখটা খুঁজতে থাকে বকুল। কিন্তু অস্পষ্ট হতে হতে ঐ মুখটার কোন অবয়বই তার স্মৃতিতে আসে না। বাবার মুখটাও হয়তো একদিন এমনিভাবেই তার মন থেকে মুছে যাবে। মা থাকলে তার জীবনটা হয়তো আজ এমন হতো না। সেই ছোটবেলা থেকে কষ্ট তার জীবনের সাথী। কষ্ট তার পিছু ছাড়েনি। যত দিন যাচ্ছে, কষ্ট তাকে তত বেশি জড়িয়ে ধরছে। বাড়িতে দেখেছে সন্তান আসার কথায় সবাই কত খুশি হয়, আর আজ! তার শরীরেও সন্তান! এই সন্তানের জন্যই সে আজ বাড়ি ছাড়া। সেই ছোটবেলা থেকে এই সংসার সে আগলে ছিল। আর আজ! এই সংসারই তাকে দূরে ঠেলে দিল। রাত জেগে কত কিছু দেখে বকুল। দেখে তার বয়সি মেয়েরা প্লাটফরমে বসে বসে ঠোটে রং দেয়। কপালে টিপ পড়ে, চোখে কাজল দেয়। ফিতা দিয়ে চুল বাঁধে। একটু আড়ালে ছেলে ছোকড়া বা মধ্যবয়সী কোন পুরুষ এসে দাঁড়ালে ওরা ইশারায়, চোখে চোখে কথা বলে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে আলাপ করে। তারপর চুলের বেণী দুলিয়ে হাসতে হাসতে তার সাথে চলে যায়। বেশ কিছুক্ষণ সময় পার করে ফেরে ওরা। তারপর বুকের মধ্য থেকে টাকা বের করে গুণতে থাকে। তবে কি ওরা নিজেদের ইচ্ছায় এই কাজ করে! বকুল একদিন জিজ্ঞেস করেছিল-
-এত রাতে কোথায় যায়? টাকা কোথায় পায়?
ওদের একজনের নাম লাইলা। হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ে লাইলা বলেছিল
-“দুইদিন সবুর কর। এই লাইনে আসলেই বুঝতে পারবা টাকা কই পাই।”
শুধু রাত নয়, দিনের বেলাতেও হোটেলের আশপাশে ওদের দেখতে পায় বকুল। আরো দেখতে পায় হিজরা। বিলকিসের ছেলে নাচিয়ে চাল, শাড়ি, টাকা অনেক কিছু নিয়েছিল। এখানে ওরা ভিক্ষা করে। এক অলস দুপুরে বকুল একদিন গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল ওদের কাছে। ওদের একজন বলেছিল- ওলো মা! তুই তো আমাগো মত না। তুই তো গতরও বেশ পারবি। আবার পেটে বাচ্চাও ধরতে পারবি। তাহলে তুই সব সময় কান্দোস ক্যান? গতর বেচা, লাইনে আসা কথাগুলো বেসুরো লাগে বকুলের কাছে। রাত জেগে কথাগুলোর অর্থ খুঁজতে থাকে সে। ট্রেনের হুইসেল আর মালগাড়ির শব্দও একসময় কমে আসে। এখানে পাখির কিচির-মিচির শব্দ নেই, তবুও ভোর আসে। কাক ডাকে। দিনের আলোয় স্ট্রিটল্যাইটের হলুদ সোডিয়াম আলো নিস্প্রভ হয়ে আসে। তবুও অকারণে জ্বলতে থাকে সেগুলো।
আরো পড়ুন: আঁধারে আলো || ২য় পর্ব
সারি সারি মেয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বকুল ভেবেছিল, এটাই গার্মেন্টস। কমলাপুর রেল স্টেশনের চায়ের দোকানের এক লোক তাকে নিয়ে এসেছে এখানে। গতকাল রাতে তাকে সিঙ্গারা আর পুরীর সাথে চা দিয়েছিল। সে চা খাওয়ার পর থেকে ঘুম। আর কিছুই মনে পড়ে না। সকালের দিকে একবার ঘুম ভেঙে ছিল। তখন সে ছিল বাসে। রিক্সায় উঠল। তখন বেলা অনেক বেড়েছে। চারিদিকে খাঁ খাঁ রোদ। তবে তার গ্রামের মতও নয়। রাস্তার পাশের দোকানগুলোতে লেখা দেখে বুঝতে পারে জায়গাটার নাম ফরিদপুর। রিক্সা এসে থেমেছে এখানে। চায়ের দোকানের লোকটি বকুলকে এক বাড়িতে নিয়ে এসে বলে,
-আজ থেকে তুই এখানেই থাকবি।
আশস্ত হয় বকুল। কত দিন পর সে আজ ঘরে। রাতে দিনে কোন সময় তাকে আর প্লাটফরমে থাকতে হবে না। সারি সারি কত ঘর। এরই একটি ঘরে সে থাকবে। স্বাস্থ্যবান, মাঝবয়সী এক মহিলা আসে।চায়ের দোকানের লোকটি তাকে মাসী বলে ডাকে। এক ঝটকায় বকুলের গায়ের ওড়না খুলে তাকে দেখতে থাকে মাসী। এমন দৃষ্টি তো সেই চায়ের দোকান আর ভাতের হোটেলের লোকগুলোর।
-বয়স বেশিই আছে। কিন্তু খুকি তো আর না যে, পুলিশের কাছে বেশি বেশি বয়স দেখানো লাগবে। স্বাস্থ্য, শরীরের গঠন সবাই ভালো।
-দামটা এবার বেশি
-কত বেশি চাও তুমি? থানায় পুলিশের খাতায় নাম উঠাতে আমারও পাঁচ-দশ হাজার টাকা লাগবে। গতবার যা ছিল তার চেয়ে ১ হাজার টাকা বেশি। এর বেশি পারব না।
গার্মেন্টেসে মেয়েরা জামা কাপড় সেলাই করে। সেও জামা তৈরি করবে। এ কথা বলেই তো চায়ের দোকানের লোক তাকে নিয়ে এসেছে এখানে। তার শরীরের গঠন দিয়ে কি হবে? এখানে তাকে বিক্রি করে দিচ্ছে! বকুলের দরদাম চিৎকারের আড়ালে চাপা পড়ে। দশ কি বারো বছরের একটি মেয়ে হাতে পায়ে ধরছে।চিৎকার করে কান্না করছে।
-মাসি না, তুমি আমার মা। আমি তোমারে মা ডাকছি। আমি যাব না। তুমি আমারে নিও না মা।
-চুপ হারামজাদী। এই লাইনে কোন মা বাপ নাই। মাগনা মাগনা বসায়ে খাওনোর জন্য তো আমি তোরে কিনি নাই। একজন আইছে, অনেক টাকা দিবো। ফ্রেশ মাল চায়।
টেনে হিঁচরে নিয়ে যাবার সময় হাত কামড়ে দেয় মেয়েটি। কিন্তু তারপর বেতের ঘা পড়ে মেয়েটির শরীরে। এলোপাথারি মারে জামা ছিড়ে যায়। রক্ত বের হয়। তবুও মার থামে না। ভয়ে হিম হয়ে আসে বকুলের শরীর। এ কোন জায়গা? আসার পরে মাত্র কয়েক ঘন্টা। খুব অল্প সময়। এই অল্প সময়ের মধ্যে বকুল বুঝতে পরে এখানে একজন নয়, অনেক মাসী, আর তাদের কথাই সবাই শোনে। সেও মাসীর কথা মত স্ন্যান করে। ভাত খায়। বিশ্বাস হতে চায় না, এই বাড়ি এই ঘরে থাকবে সে। আবার মনের কোণে ভয় জমে। যদি তাড়িয়ে দেয়। তাহলে এই আশ্রয়টুকুও হারাবে সে। বিকালের দিকে এক মাঝ বয়সি দেখতে খুব সুন্দর মত একজন আসে ঘরে। নাম জিজ্ঞেস করে-
-কি নাম বললি তুই? তোর বাড়ি কোথায়? বাবার নাম কি?
তারপর টানতে টানতে বকুলকে তার ঘরে নিয়ে যায়। দরজা আটকানো বন্ধ ঘরে একে একে সব কথা বলে বকুল। ছোট বেলায় তার মায়ের সংসার ছেড়ে চলে যাওয়া, বাবার কাছে তাদের বড় হওয়া, পলাশের বিয়ে। তারপর তার শরীরে সন্তান আসা; মায়ের মত তারও রাতের অন্ধকারে বাড়ি থেকে পালিয়ে আসা। কমলাপুর রেল স্টেশনে দিন কাটানো- কোন কিছুই বাদ দেয়া না সে।
সেদিনের ঐ সে, যে বকুলের নাম জিজ্ঞেস করেছিল, সবাই তাকে মিনুদি বলে ডাকলেও বকুল তাকে ডাকে মাসী বলে। তবে মাসীর এই অদ্ভুত আচরণ বুঝতে পারে না বকুল। এক মূহুর্তের জন্যও মাসি তাকে চোখের আড়াল করে না। ছোট খুপড়ি ঘর। তবে এটি মাসীর নিজস্ব। বাইরে দিন না রাত বোঝা যায় না।
সব সময়ই ঘরে আলো জ্বলে। ঘরে রঙিন টিভি, সিডি প্লেয়ার সবই আছে। ছোট আলনায় দামি দামি কাপড়,
ড্রেসিং টেবিলে ছোট বড় নানা রং এর কত টিপ, পাউডার, লিপিস্টিক, নুপূর, পরচুলা, কাজল-সবই আছে এখানে। অখন্ড অবসর, সারাদিন শুয়ে বসে সময় কাটানো, টিভি দেখা- এত সুখ স্বাচ্ছন্দ্য ছকারনা চদন আসেনি বকুলের জীবনে। মাঝে তাকে সাথে নিয়ে বাজার থেকে দামী দামী জামা কিনে দেয়। তাকে দিয়ে কোন কাজ করায় না। ভালোবাসে, যত্নে রাখে। বকুল বোঝে না কেন এসব? মায়ের মুখের সাথে মাসীর মুখটা মেলানোর চেষ্টা করে। কিন্তু মায়ের মুখটা তো আজ পুরোটাই অস্পষ্ট তার কাছে। দূর থেকে আযান ভেসে এলে, আযানের সাথে বাড়ির সময় মেলানোর চেষ্টা করে বকুল। বাবা কি এখনো খুঁজে চলছে তাকে? বাবা কি এখন নিজে রান্না করে? দু মাস গড়িয়ে গেছে। সময়ের সাথে সাথে তার শরীরে বড় হচ্ছে সনৎ এর সন্তান। এই সন্তানকে নিয়ে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? সব কিছু হারিয়ে অন্ধকারে ডুব দিয়েছে সে। কোথাও তার তল নেই। কোথাও আলো নেই। বকুলের বুঝতে বাকি নেই, এখানকার মেয়েরা শরীর বেচেঁ জীবন চালায়। যেমন-সে দেখেছিল স্টেশনের লাইলাকে। গতর বেচার অর্থ এখন সে বোঝে। মাঝে মাঝে ঘরের ভিতর থেকে সে শুনতে পায় মেয়েদের কান্না, রাতে দিনে মেয়েরা এখানে ছেলে-ছোকড়া মধ্যবয়সী সব ধরণের পুরুষকে নিয়েই ঘরে ঢোকে। খুপরী ঘরের দরজাগুলো একে একে বন্ধ হয়। আবার বন্ধ দরজা খুলে পুরুষেরা বেড়িয়ে যায়। ছোট ছোট অবুঝ শিশুগুলো মায়ের জন্য দরজা ধরে দাঁড়িয়ে কাঁদে।
সেই চাঁদনী সিনেমা চলছে শহরের সিনেমা হলে। সবার সাথে বকুলও গিয়েছিল সিনেমা দেখতে। মাসীই পাঠিয়েছিল তাকে। সন্ধ্যা বেলা ফিরে এসে দেখে দরজা বন্ধ। এখন রাতের আযান দিচ্ছে। সময় পার হয়ে গেছে। তবুও দরজা খোলে না মাসী। আরও পরে মুক্তা মাসী দুলালের দোকানের দুই ছেলেকে নিয়ে এসে দরজা খোলে। এগিয়ে যায় বকুল। বিছানার ওপর নিস্প্রাণ দেহে ঘুমিয়ে আছে মাসি। বাতাসে উড়ছে তার লেখা চিঠি।
আরো পড়ুন: আঁধারে আলো || ৩য় পর্ব
বকুল,
এই চিঠি পেয়ে তুমি নিশ্চয় অবাক হচ্ছো। অবাক হওয়াটাই স্বাভাবিক। এই নিষিদ্ধ পল্লীর এতগুলো মেয়ের মাঝে আমি তোমায় লিখছি কারণ আমি তোমার গর্ভধারিনী মা। আজ তুমি আমাকে ক্ষমা করতে পারবে। কারণ- মৃত্যু জীবনের সাথে সাথে রাগ, ঘৃণা, অপমান সব নিয়ে যায়। তোমাদের ফেলে নিজের সুখের জন্য আমি একদিন সংসার ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম। সারা জীবন সেই অন্যায়ের শাস্তি পেয়েছি। কিন্তু তবুও শেষ হয়নি। আমার সেই পাপ তোমাকেও স্পর্শ করেছে। তাই তুমিও আজ এই নিষিদ্ধ পল্লীতে। প্রতিনিয়ত আমার জন্য এ আরো অনেক অনেক বড় শাস্তি। আজ তোমার মুখোমুখি দাঁড়াবার শক্তি ও সাহস কোনটাই আমার নেই। তাই জীবন থেকে পালাতে এই পথ আজ আমি বেঁছে নিলাম।
পুরোনো কত স্মৃতি আজ আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। বিয়ের পর তোমার বাবার সাথে আমার সিনেমায় যাওয়া, নৌকা করে ঘুরে বেড়ানো, তোমার বাবার কত টুকরো টুকরো ভালবাসার ঘটনা। তোমাদের দুই ভাইবোনের জন্ম, বেড়ে উঠা, তোমার স্কুলে পাওয়া, পলাশের আধো আধো কথা, হাঁটতে শেখা। এতদিন তোমাদের সব স্মৃতি আমার এখানেই থেমে ছিল। তোমাকে দেখার পর বুঝতে পারছি এর মাঝে জীবনের বিশ-বাইশ বছর পার হয়ে গেছে।
সেদিন ঝড়ের রাতে ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে রাতের ট্রেনে মনোজের সাথে ঢাকায় আসি আমি। ওর মানিব্যাগ চুরি হয়ে গেছে বলে, আমার হাতের সোনার চুড়ি বেঁচে দেয়। স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে আমরা হোটেলে থাকতে শুরু করি। মনোজ আমাকে ঢাকা শহরের জাদুঘর, শিশু পার্কে বেড়াতে নিয়ে যায়। নিউ মার্কেটে নিয়ে গিয়ে শাড়ি কিনে দেয়। শহরের মাঝে লেক, জলের ফোয়ারা, আলোর রোশনাই সব কিছু আমার কাছে স্বপ্নের মত মনে হয়। এমন জীবনই তো আমি চেয়েছিলাম। তখন একটি বারের মত বোঝার চেষ্টা করিনি যে, মনোজ আমার টাকাতেই ফূর্তি করছে। মাঝে মাঝে পলাশের জন্য আমার মন খারাপ হত। মনোজ বলত বিয়ের পর আমাকে নিয়ে ওর বাড়ি যাবে। তারপর পলাশকে সাথে নিয়ে রাখবে। পনের দিন যে, কিভাবে
কেটে গেল বুঝতে পারিনি। মনোজ আমাকে আরো বলত পূর্ণিমার রাতে আমাকে নিয়ে সমুদ্রের বালুতে হাঁটবে। কক্সবাজারে যাবার টিকিট কেনার কথা বলে সে একদিন সকালে বের হল। সমুদ্র দেখার স্বপ্নে বিভোর হয়ে আমার সকাল দুপুর বিকেল পার হল। সন্ধ্যায় আমার ঘরে এল অন্য পুরুষ। জানতে পারলাম আমাকে সে বিক্রি করে গিয়েছে। মূহুর্তের মধ্যে সব মিথ্যা স্বপ্ন, সব আশা ধুলায় মিশে গেল। বুঝতে পারলাম কি অন্যায়, কি পাপ করেছি আমি। জীবনের মোড় ঘুরে গেল অন্ধকার গলিতে। ছোট বেলা থেকে প্রতিনিয়ত অভাবের সাথে যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত সেই আমি প্রতি রাতে টাকা রোজগার করতে শুরু করলাম। জীবিকার প্রয়োজনে নিত্য নতুন শাড়ি, স্নো, পাউডার, পারফিউম কিনতে অথবা একবেলা পেট ভরে খেতে
কে যেন আমায় পিছু টানতো। প্রতিনিয়ত অনুতাপের জ্বালায় পুড়তে লাগলাম আমি। মনে হত পলাশের দুধের কৌটা শেষ হয়ে গেছে। তোমার পরণের জামাটা ছিড়ে গেছে। হাঁড়িতে ভাত কমে যাওয়ায় তোমার বাবা রাতে না খেয়ে আছে। প্রতি রাতের উপার্জনের টাকা আমি বারবার ছুঁয়ে দেখতাম। ট্রাঙ্ক থেকে বের করে সেগুলো গুণে গুণে হিসেব করতাম। খুব ইচ্ছে হত টাকাগুলো তোমাদের দিয়ে আসি। যেন তোমরা ভালোভাবে বাঁচতে পার। আবার কখনো মনে হতো রাতের অন্ধকারে গিয়ে দূর থেকে তোমাদের একবার দেখে আসি।
আমাদের এই জীবন, এই পথটা খুব কঠিন বকুল। আমাদের স্বামী নেই, সংসার নেই। আমরা কারো মা, বোন, মেয়ে, স্ত্রী কোনটাই নই। আমাদের কাছে হিন্দু, মুসলিম সবাই আসে। অথচ আমাদের কোন জাত নেই, ধর্ম নেই, আমাদের একটাই পরিচয়- আমরা বেশ্যা, পতিতা। জীবিত অবস্থায় পুরুষেরা আমাদের শরীরটাকে ভোগ করে তাদের লালসা, চাহিদা, ক্ষুধা সব মেটায়। আর মৃত্যু পর আমাদের শরীরই হয়ে যায় অস্পৃশ্য। তাই, আমাদের শেষকৃত্য বা কবরে জায়গা কোনটাই হয় না। অন্যান্য সবার মত আমার শরীরটাকেও ওরা রাতের অন্ধকারে বড় রাস্তার ধারে ঝোপের মধ্যে ফেলে দিয়ে আসবে। এতদিন সমাজের বিবেকবান মানুষেরা এই দেহটাকে খুবলে খুবলে খেয়েছে। আর মৃত্যুর পর বিবেকহীন শেয়াল-কুকুরেরা এই
দেহটাকে ছিড়ে খেয়ে মুক্তি দেবে।
বকুল, যে রাতে তুমি ঘর ছেড়ে বেড়িয়েছ, সেই রাতটুকু শেষ হতেই পৃথিবীর সব বাড়ির দরজা চির দিনের মত তোমার জন্য বন্ধ হয়ে গেছে। তোমার অনাগত সন্তান যদি ছেলে হয়, এই সমাজ তাকে পিতৃপরিচয়হীন জারজ সন্তান বলবে। আর সে যদি মেয়ে হয়, তাকে এই পেশাতে আসতেই হবে। আমি চাই না তোমার সন্তানের চলার পথ এত কঠিন, এত পঙ্কিলময় হোক। সারা জীবন ধরে আমার উপার্জনের টাকা আমি যক্ষের ধনের মত আগলে রেখেছি। এত দিন ধরে জমানো এই টাকা আমি তোমাকে দিয়ে গেলাম। এটা নিতে তুমি অস্বীকার করো না। যে মাসী তোমাকে কিনেছিল, তার চেয়ে বেশি টাকা দিয়ে আমি
তোমাকে কিনে নিয়েছি। তাই, তোমার ওপরে কারো কোন দাবী নেই। একজনের ঠিকানা লিখে রেখে গেলাম। এই জীবন থেকে বের হয়ে আসতে সে তোমাকে সাহায্য করবে। আরো একটা কথা বকুল, জীবনে তুমি আর কোন দিন মা হতে পারবে কিনা জানি না, তাই এই সন্তানকে তুমি নষ্ট করো না। ওর পিতৃ পরিচয়ে তুমি ওকে বড় করো।
আমি চলে আসার পর তোমার বাবা তোমাদের আঁকড়ে ধরে বেঁচে ছিলেন। কিন্তু বকুল, তুমি চলে আসার পর তোমার বাবার আর কোন অবলম্বনই নেই। যদি কোনদিন তার সাথে তোমার দেখা হয়, তবে তাকে বলো তিনি যেন আমাকে ক্ষমা করে দেন। দশ বছরের সংসার জীবনের কত কথাই না মনে পড়ছে আজ । কেন জানি না, আরো কত কিছু লিখতে ইচ্ছে করছে তোমায়। কিন্তু ঘুমে আমার চোখ জড়িয়ে আসছে। লেখার জন্য হাতেও আর কোন শক্তি পাচ্ছি না। সব শেষে, তোমার ও তোমার অনাগত সন্তানের জন্য আমার প্রার্থনা রইল-তোমাদের মঙ্গল হোক।
ইতি
তোমার মা।
পুনশ্চঃ খুব লোভ হচ্ছে বকুল। ইচ্ছে করছে ছোট বেলার মত একবার তোমাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরি। তোমার গায়ের গন্ধ নেই। শেষবারের মতো একবার তুমি আমায় মা বলে ডাকো। আমি তোমার মা ডাক শুনতে চাই।