মীর মোনাজ হক, বার্লিন: জগৎবিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী, আলবার্ট আইনস্টাইন স্কুলে গণিতে কাঁচা ছাত্র ছিলেন বলে পরিচিত আছেন!
১৪ই মার্চ, ১৮৭৯ সালে জার্মানির উলম শহরে আলবার্ট আইনস্টাইন জন্মগ্রহণ করেন। তার জন্মদিনটি “পাই ডে” হিসেবেও পালিত হয়। এই বিশেষ অনন্ত সংখ্যা π, একটি বৃত্তের পরিধি এবং তার ব্যাসের অনুপাতকে নির্ণয় করার গাণিতিক ধ্রুবক π=𝟯.𝟭𝟰 নামে পরিচিত।
১৯০৫ সালে, আইনস্টাইন আপেক্ষিকতার মতো বিষয়গুলোকে মোকাবিলা করে এবং ‘ভর’ এবং ‘শক্তি’ এর ওপর তার সবচেয়ে বিখ্যাত সমীকরণ 𝗘=𝗺𝗰𝟮 প্রবর্তন করে বেশ কয়েকটি প্রভাবশালী কাজ প্রকাশ করেছিলেন। তিনি ১৯২১ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন।
১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ৪ মাস আগেই শেষ হয়ে গেলেও যখন জাপান যুদ্ধ না থামিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলো, তখন জাপানের হিরোশিমায় প্রথম পারমাণবিক বোমা ফেলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সে সময় আইনস্টাইন প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন, — হিরোশিমায় বোমা হামলার খবর শুনে আলবার্ট আইনস্টাইন চমকে গিয়ে বলেছিলেন “হায় এটা তো আমি!” যদিও আইনস্টাইন পারমানবিক বোমা তৈরির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন না কিন্তু তার এনার্জির সমীকরণ 𝗘=𝗺𝗰𝟮 পারমানবিক বোমা তৈরির আদিসমীকরণ হিসেবে ধরা হয়।
হিরোশিমায় বোমা হামলার তিন দিন পর ১৯৪৫ সালের ৯ আগস্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাপানের নাগাসাকি শহরে আর একটি পারমাণবিক বোমা ফেলে। ১৯৪৫ সালের শেষ নাগাদ এই দুটি শহরে আনুমানিক ২০০,০০০ মানুষ মারা গিয়েছিল।
কিভাবে এই মারাত্মক অস্ত্র এটোম বোমা তৈরি হলো:
১৯৩৮ সালে বার্লিনের একটি গবেষণাগারে কাজ করা তিনজন রসায়নবিদ ও পদার্থবিজ্ঞানী একটি আবিষ্কার করেছিলেন যা ইতিহাসের গতিপথ পরিবর্তন করবে: তারা ইউরেনিয়াম পরমাণুকে বিভক্ত করে যখন এই বিভাজন বা বিদারণ ঘটে তখন যে শক্তি নির্গত হয় তা প্রচণ্ড এক শক্তি — এটি একটি এটোমিক বোমা তৈরির শক্তি দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু এই ধরনের অস্ত্র তৈরি করার আগে অনেক প্রযুক্তিগত সমস্যা অতিক্রম করতে হয়েছিল।
যখন আইনস্টাইন জানতে পারলেন যে জার্মানরা এই সমস্যাগুলো সমাধানে সফল হতে পারে, তখন তিনি প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টকে তার উদ্বেগ নিয়ে চিঠি লিখেছিলেন। আইনস্টাইনের ১৯৩৯ সালের চিঠিটি একটি পারমাণবিক বোমা তৈরির জন্য মার্কিন প্রচেষ্টা শুরু করতে সাহায্য করেছিল, কিন্তু কাজটি প্রথমে ধীরে ধীরে এগিয়েছিল। ১৯৪০ এবং ১৯৪১ সালে আরও দুটি আবিষ্কার চূড়ান্তভাবে প্রমাণ করে যে বোমাটি সম্ভবপর ছিল এবং বোমা তৈরি করাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি শীর্ষ অগ্রাধিকার দিয়েছিল: ইউরেনিয়ামের প্রয়োজনীয় ভর “critical mass” নির্ধারণ এবং নিশ্চিতকরণ যে প্লুটোনিয়াম ফিশনের মধ্য দিয়ে যেতে পারে এবং ব্যবহার করা যেতে পারে। একটি বোমা, ১৯৪১ সালের ডিসেম্বরে, মার্কিন সরকার বোমা তৈরির জন্য বৈজ্ঞানিক ও সামরিক উদ্যোগ ম্যানহাটন প্রকল্প চালু করে, “The Manhattan Project”
মার্কিন প্রেসিডেন্ট এর কাছে আইনস্টাইনের একটি চিঠি ১৯৩৯ সালের আগস্টে পৈছায়, যা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্র্যাঙ্কলিন রুজভেল্টকে সতর্ক করার জন্য চিঠি লিখেছিলেন তিনি, তাতে বর্ননা করে তিনি যে, নাৎসিরা একটি নতুন এবং শক্তিশালী অস্ত্র, একটি পারমাণবিক বোমা নিয়ে কাজ করছে। সহকর্মী পদার্থবিজ্ঞানী লিও সিলার্ড আইনস্টাইনকে চিঠিটি পাঠাতে অনুরোধ করেছিলেন এবং তাকে এটির খসড়া তৈরিতে সহায়তা করেছিলেন।
১৯৪০ সালের জুলাই মাসে, ইউএস আর্মি ইন্টেলিজেন্স অফিস আইনস্টাইনকে ম্যানহাটন প্রজেক্টে কাজ করার জন্য প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ছাড়পত্র অস্বীকার করে। প্রকল্পের শত শত বিজ্ঞানীকে আইনস্টাইনের সাথে পরামর্শ করতে নিষেধ করা হয়েছিল, কারণ বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মীকে একটি সম্ভাব্য নিরাপত্তা ঝুঁকি হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছিল।
শেষপর্যন্ত পারমাণবিক অস্ত্র কিভাবে তৈরি হলো:
যদিও আআইনস্টাইন পারমাণবিক বোমার উপর সরাসরি কোনো কাজ করেননি, আইনস্টাইন প্রায়শই ভুলভাবে পারমাণবিক অস্ত্রের আবির্ভাবের সাথে যুক্ত হয়েছেন।
তার বিখ্যাত সেই সমীকরণ 𝗘 = 𝗺𝗰𝟮 একটি পারমাণবিক বোমায় নির্গত শক্তি ব্যাখ্যা করে, কিন্তু কীভাবে এটি তৈরি করা যায় তা ব্যাখ্যা করে না। তিনি বারবার মানুষকে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, “আমি নিজেকে পারমাণবিক শক্তির উদ্ভাবক এর জনক মনে করি না। এতে আমার অংশ মোটেও ছিলনা।” তা সত্ত্বেও, আইনস্টাইনকে প্রায়ই তার ভূমিকা ব্যাখ্যা করতে বলা হয়েছিল – যেমনটি তিনি বলেছিলেন যখন একজন জাপানি ম্যাগাজিন সম্পাদক তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “আপনি কেন পারমাণবিক বোমা তৈরিতে সহযোগিতা করেছিলেন, তার ভয়াবহ ধ্বংসাত্মক শক্তি সম্পর্কে ভালভাবে জেনেও?”
আইনস্টাইনের উত্তর সর্বদা ছিল যে তার একমাত্র কাজ ছিল রাষ্ট্রপতি রুজভেল্টকে চিঠি লেখার পরামর্শ দেওয়া যে জার্মানরা এই মারাত্মক প্রযুক্তি ব্যবহার করার আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে গবেষণা করা উচিৎ। এমনকি এই পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য তিনি অনুতপ্ত হয়েছেন। নিউজউইক ম্যাগাজিনের সাথে একটি সাক্ষাত্কারে তিনি বলেছিলেন যে “আমি যদি জানতাম যে জার্মানরা পারমাণবিক বোমা তৈরিতে সফল হবে না, আমির তখন প্রেসিডেন্ট রুসভেল্টেকে পরামর্শ দিতামনা।
প্রকৃতপক্ষে পারমানবিক বোমা বা এটম বোমা তৈরির পরিকল্পনা প্রথমে নাৎসি শাষক হিটলারের পরিকল্পনা ছিলো। ১৯৩৬-এর মাঝামাঝি সময়ে, পদার্থবিজ্ঞানী ওয়ার্না হাইজেনবার্গ প্রথম তার মহাজাগতিক রশ্মি ঝরনার তত্ত্ব দুটি গবেষণাপত্রে উপস্থাপন করেন। ১৯৩৮ সালের ডিসেম্বরে, জার্মান রসায়নবিদ অটো হ্যান এবং ফ্রিটজ স্ট্র্যাসম্যান ‘দ্য ন্যাচারাল সায়েন্সেস’ পত্রিকায় একটি গবেষনা আর্টিকেল ছাপিয়ে রিপোর্ট করেন যে, তারা নিউট্রন দিয়ে ইউরেনিয়াম পরমাণু বিভাজন করার পরে মৌল বেরিয়াম সনাক্ত করেছেন। এই আবিস্কারটির খবর হিটলারকে আকৃষ্ট করে এবং অটো হ্যান এর পরবর্তি ইউরেনিয়াম নিউক্লিয়াস ফেটে যাওয়ার উপসংহারে যখন পৌঁছেছেন; তখন তার এক অস্ট্রিয়ান বন্ধু লিসে মাইটনারেকে সেই গবেষনায় যুক্ত করেন তবে মাইটনার সেই বছরের জুলাইয়ে নেদারল্যান্ডসে পালিয়ে যান এবং তারপর সুইডেনে চলে যান। মাইটনার, এবং তার ভাগ্নে অটো রবার্ট ফ্রিশ, হ্যানস এবং স্ট্রাসম্যানের ফলাফলকে পারমাণবিক পারমাণবিক বিভাজন হিসাবে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন। ফ্রিশ ১৯৩৯ সালে পরীক্ষামূলকভাবে এটি নিশ্চিত করেন। সেই থেকেই নাৎসি হিটলারের এই এটোমিক বোমা তৈরির পরিকল্পনা আরো দ্রুতগতিতে চলতে থাকে।
আইনস্টাইনের লেখা প্রেসিডেন্ট রুসভেল্টের কাছে চিঠির পরেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জার্মান বিজ্ঞানিদেরকে একের পর এক যুক্তরাষ্ট্রে ভালো চাকুরির অফার দিয়ে নিয়ে যাওয়ার ফলে হিটলারের এটোমিক বোমা তৈরির প্রজেক্টে ভাটা পড়েযায় এবং যুক্তরাষ্ট্রে এই এটোমিক বোমা তৈরির গবেষনা শুরু হয়।
এক গবেষণায় বলা হয়েছে পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত আবিস্কার করা ১৩ হাজার এটোম বোম দিয়ে আমাদের এই সুন্দর পৃথিবী সারে সাত বার ধ্বংস করা যাবে। বুঝতেই পারছেন এর কি ধ্বংসাত্মক শক্তি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার পর, তৎকালীন বিশ্বের দুই সেরা বিজ্ঞানী ‘হাইজেনবার্গ’ ও ‘ওপেনহাইমার’ -এর ভিতর চলছিল আরেক অদৃশ্য যুদ্ধ। এই দুই বিজ্ঞানীর কাঁধে দায়িত্ব দিয়ে সে সময় জার্মানী ও যুক্তরাষ্ট্র খুঁজতে থাকে ‘এটম বোমা’ বা ‘পারমাণবিক বোমা’ তৈরীর কৌশল। বিজ্ঞানী হাইজেনবার্গের নেতৃত্বে জার্মানরা হয়তো যেকোনো মুহূর্তে ‘পারমানবিক বোমা’ আবিষ্কার করে ফেলতে পারে এই ভয়ে আমেরিকানরা খুব শংকিত ছিল। কারণ হাইজেনবার্গের নেতৃত্বে জার্মানরা এটোম বোম বানাবার প্রজেক্ট অনেক আগেই শুরু করেছিল। কিন্তু জার্মান দের কিছু ভুলের কারণে পরবর্তীতে আমেরিকানরাই সর্বপ্রথম ‘পারমাণবিক বোমা’ বানাবার কৌশল আবিস্কার করে পৃথিবীতে যুদ্ধের ইতিহাসকে আমূলে বদলে দেয়।
১৯৪৫ সালের ১৬ই জুলাই প্রথম মার্কিন যুক্ত্রাষ্ট্র এটোম বোমা আবিস্কারের পরে, সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন, ফ্রান্স, বৃটেন সহ প্রায় ১০ টি দেশ এখন পারমাণবিক শক্তি রাষ্ট্র হিসেবে শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। একসাথে, এই রাষ্ট্রগুলির কাছে আজ প্রায় ১৩,৮৬৫টি পারমাণবিক ওয়ারহেড রয়েছে; ১৯৮০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে প্রায় ৭০,০০০ ছিল। এটি বেশ কয়েকবার মানবজাতিকে ধ্বংস করার জন্য যথেষ্ট ।
তথ্য: জার্মান পত্রিকা “Die.Zeit” এবং
The American Musrum of Natural History.