আকাশ ভাঙ্গা বৃষ্টি

শম্পা সাহা

রাস্তায় নেমেই অপু বুঝতে পারে, টিপ টিপ বৃষ্টি হচ্ছে। হাত ঘড়িতে সময় দেখে সে। রাত ১১টা ৩০। তাই হয়ত রাস্তাটা এত নিস্তব্ধ। বুকের মধ্যে আবার সেই পুরনো কষ্ট। মনের অতল গভীরে কিছুটা বিস্মৃত হয়ে যাওয়া মুখ আবার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। সেই চোখ; সেই চাহনি; সেই হাসি। তার ছোট্ট জগতের মাঝে আরো এক জগৎ। তার মনের মধ্যে আরো একটি মন। যে মনের সাথে আজও সে সারাদিন কথা বলে। মন বলে, কার হোক, পরশু হোক, সে আসবে। তারপর চোখে চোখ রেখে শান্ত গলায় বলবে “Ñকতদিন তোমায় দেখেনি। কেমন আছ তুমি?” অপুর বিস্ময় জাগে। অপলক দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে থাকে শীলার দিকে। …..হঠাৎ পিছন থেকে সে তার কাঁধে হাতের স্পর্শ অনুভব করে। তার হৃদ স্পন্দন যেন বন্ধ হয়ে আসে। কিন্তু একি! শীলার পরিবর্তে যে দাঁড়িয়ে আছে, সে না পুরুষ না নারী। পুরুষের গঠন শরীরে, অথচ নারীর বেশ ভ‚ষা। কপালে বড় টিপ, ঠোঁটে গাঢ় রং, কানে বড় দুল।
“Ñটাকা দেন সাব। কিছু সাহায্য করেন।” অপুর সারা শরীরে যেন শীতল স্রোত বয়ে যায়। সম্বিত ফিরে পায় সে। পকেটে হাত দিতেই একটা দশ টাকার নোট পায়। তাই এগিয়ে দেয় সে। খুশির আতিশয্যে তৃতীয় লিঙ্গটি অপুর গলা জড়িয়ে ধরে, ওর গালে একটা চুম্বন দেয়। জোড় করে নিজেকে ছারিয়ে নেয় অপু। শরীরে একটি ভঙ্গি তুলে হাসতে হাসতে চলে যায় সে। অপু পকেট থেকে রুমাল বের করে তার গালে বসে যাওয়া রং উঠানোর চেষ্টা করতে থাকে। ৪/৫ বছর আগের ঘটনা। স্মৃতিতে ঝাপসা হয়ে আসা, শীলার সাথে প্রথম দেখা হবার কথা মনে পড়ে অপুর। ক্যাফেটেরিয়ার টেবিলে চায়ের কাপ নিয়ে একাই বসে ছিল অপু। অন্য কোন টেবিলে বসার জায়গা না পেয়ে ওর বান্ধবী অনুকে সাথে নিয়ে অপুর টেবিলে এসে বসার অনুমতি চেয়েছিল শীলা। এর ঠিক ১২ দিন পরে দু’জনের আবার একসাথে দেখা হয়েছিল লাইব্রেরীতে। সেই থেকে শুরু। বাংলা বাজারের টিউশনি শেষে ফিরতে রাত হয়, তাই অপু ওর ছাত্র পড়িয়ে অপেক্ষা করতো শীলার ছাত্রীর বাসার সামনে। শীলাকে হোস্টেলে নামিয়ে দিয়ে অপু ফিরতে ওর বাদামতলীর মেসে। এক সাথে চলতে চলতে ওরা অনুভব করে, আর্থিক অ¯^চ্ছলতার কারণেই হয়ত ওদের দু’জনের জীবন বোধ এক; ¯^প্ন এক। তাই তো দু’টি প্রাণ, দু’টি ¯^ত্তা মিশে যায় একই সাথে।
পরীক্ষা শেষে ওরা জগন্নাথ কলেজের ক্যাফেটেরিয়া, টি.এস.সিতে বসে আড্ডা দেয়, সাথে থাকে তনু, সুজন, আরিফ, ইমন ও রিয়া। বৃষ্টিতে ওরা সবাই একসাথে ক্যাম্পাসে ভেজে, ১লা বৈশাকে রমনার বটমূলে আসে; বই মেলায় এসে বাংলা একাডেমীর পুকুর পাড়ে গিয়ে সময় কাটায়, তার পর ফেরার পথে ইমন, রিয়া আর আরিফ পাল্লা দিয়ে ¯^পন মামার কাঁচা মরিচ মেশানো চা খায়। ১লা ফাল্গুনে শীলা দু’চোখে কাজল এঁকে, দুই ভ্রæরুর মাঝে লাল টিপ পড়ে; খোপায় ফুল দেয়। হলুদ শাড়ীতে কি অপূর্ব ই না লাগে ওকে! শীলার উপর থেকে চোখ ফেরাতে না অপু। এক রিক্সায় পাশাপাশি বসে ওরা ঘুরতে থাকে। দু’জনের সেই একই ¯^প্নের ছোট পরিধি আজ অনেক বিস্তৃত। অপুর গ্রামের বাড়িতে দালান নয়, টিনের চালের ঘর উঠবে; শীলা সেই টিনের চালের বৃষ্টির শব্দ শুনবে; গাব গাছের নীচে দাঁড়িয়ে পুকুরের জলে বৃষ্টি পড়া দেখবে; পূর্ণিমার রাতে চাঁদের আরো ছড়িয়ে পড়বে বাঁশ ঝাড়ের মাথায় মাথায়; জোৎ¯œা এসে লুটিয়ে পড়বে উঠোনে; মাটিতে লেবু গাছের ছায়া দুলবে; উঠোনের এক কোণায় থাকা কদম ফুলের গন্ধে বাতাস ভরে উঠবে;…..আর…..আর আমাবশ্যার রাতে অপুর কাঁধে মাথা রেখে আকাশের তারা দেখবে। ঝিঁ ঝিঁ ডাকা অন্ধকার রাতে জোনাকির সবুজ আলো দেখবে। অপুর শার্টের বোতাম খুলে যায়। সে রেখে দেয় শীলার জন্য। শীলা বলে, “Ñআর যা যা ছিঁড়ে যায়, সব জমাতে থাক। যেদিন তোমার বাড়ীতে যাব, সেদিন সব সেলাই করে দেব।”
সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নামলেও ওরা রিক্সায় করে ঘুরতে থাকেÑ নবাবপুর, তাঁতি বাজার, মিডফোর্ড, মালিটোলা, সদর ঘাট। পূর্ণিমার চাঁদ উঠে আকাশে। হাইরাইজ বিল্ডিং আর গাছের মাথার ফাঁক দিয়ে উঁকি দেয় সেই চাঁদ। দক্ষিণা বাতাস আর আমের মুকুলের গন্ধ জানিয়ে দেয় এটা বসন্ত ঋতু। ঘিঞ্জি, যানজট, সুয়েরেজ আর ডাসবিনের গন্ধের মাঝেও সব কিছুÑ এত মায়াময় মনে হয়; এত ভাল লাগে সব কিছুÑ শুধু কি এই ভালবাসার জন্য?
দিন যায়, মাস যায়, বছর ঘুরে তিন বছর কেটে যায়। অপুর পরীক্ষা শেষ হয়েছে আজ প্রায় ছ’মাস। বাদামতলীর মেস ছেড়ে সে এসে উঠেছে পাঁচ তলার উপরে চিলে কোঠার এক ঘরে। ব্যাংক, কলেজ শিক্ষক আর বি.সি.এস পরীক্ষা তার সামনে। শীলার পরীক্ষা শেষ হয়েছে গতকাল। এই মাস শেষে কলেজের হোস্টেল ছেড়ে দিতে হবে। তনুকে সাথে নিয়ে হোস্টেল খুঁজতে বের হয়েছিল শীলা। দুপুর গড়াতে না গড়াতেই যেন বিকেল নেমেছে। গাছের মাথায় মাথায় দিন শেষের আলো। উত্তরের বাতাস। গাছের হলুদ পাতাঝড়ে পড়ে সেই বাতাসে। কাল বৈশাখীর ঝড় উঠার সময় এটা নয়। কিন্তু তবুও ঈষাণ কোনে মেঘের পরে মেঘ জমতে থাকে। অন্ধকার হয়ে আসে চারিদিক। বাড়ী থেকে খবর আসে, শীলার বাবার অসুখ। শীলার ফুপুর আত্মীয়Ñ এন.জি.ও’র বড় কর্মকর্তা; তার সাথে শীলার বিয়ের কথা শোনা যায়। ক্যান্টিনে বসে অপুর হাত ধরে শীলা বলে, Ñতোমার আমার এত ¯^প্ন; এত আশাÑ সব,…..সব মিথ্যা হয়ে যাবে?
Ñতুমি যদি হারিয়ে দাও, আমি সত্যি বাঁচন না শীলা।
নতুন হোস্টেলে আর উঠা হয়নি শীলার। সে চেয়েছিল, বাড়ীতে গিয়ে অপুর কথা জানাবে; অপুর জন্য সে অপেক্ষা করবে। কিন্তু কাকে বলবে সে অপুর কথা? ওর বাবার একটা কিডনি সম্পূর্ণভাবে বিকল হয়ে গিয়েছে। অন্যটার অবস্থাও ভাল নয়। আত্মীয়েরা মিলে সেই ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক করে। তারপর শীলাকে বাড়ী ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এক দুপুরে ওর চাচা, চাচী আর ফুপু আসে হোস্টেলে। তনুকে সাথে নিয়ে সন্ধ্যার সময় শীলা আসে অপুর কাছে। অপুর হাত ধরে পাগলের মত হু হু করে কাঁদতে থাকে সে। বলে, Ñআর কোন দিন ত তোমার ঘরে, তোমার কাছে আসতে পারব না। তোমার শার্টগুলো দাও। সেলাই করে দিয়ে যাই। এক এক করে শার্টের সবগুলো বোতাম লাগিয়ে দেয় শীলা। শেষে দু’টো বোতাম অপুর কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে বলে,
“আমার সারা জীবনের সঞ্চয় হয়ে থাকবে এগুলো।” শীলার চোখের জলে অপুর শার্ট ভিজে উঠে। এর নাম ভালবাসা! যার বিচ্ছেদ এত কষ্টকর! চার দিন বাদে শুক্রবারে বিয়ে ঠিক হয়েছে শীলার। এই চার দিন টিউশনিতে যায়নি অপু। সে অপেক্ষা করেছে শীলার জন্য। প্রতি মুহূর্তে মনে হয়েছে সব কিছু ছেড়ে শীলা চলে আসবে তার কাছে। …প্রহরের পর প্রহর কেটেছে। অবশেষে, সেই বিয়ের দিন কেটে গেলে, শীলার ফিরে আসার ক্ষীণ সম্ভবনাটুকু যখন শেষ হয়ে গেল তখন অপুর প্রতীক্ষারও অবসান ঘটল। যে ছিল তার সবচেয়ে আপন, যে হতে পারত তার জীবনেরÑ চিন্তা, চেতনা, দুঃখ, কষ্ট, আনন্দ, বেদনার সঙ্গী; সে চীর দিনের মত হারিয়ে গেল তার জীবন থেকে। রাতে ছাত্র পড়িয়ে ঘরে ফিরে ঘর অন্ধকার করে বসে থাকে তপু। হৃদয় ভাঙ্গার এক তীব্র কষ্ট কুড়ে কুড়ে খায় তাকে। পাশের বাড়ী থেকে একটা গান প্রায়ই ভেসে আসে। শীলার প্রিয় রবীন্দ্র সঙ্গীত। অপু জানালার গ্রীলে মুখ গুজে গান শুনেÑ
“আজি বিজন ঘরে নীশিথ রাতে
আসবে যদি শুন্য হাতে
আমি তাইতে কি ভয় মানি!
জানি, জানি বন্ধু জানি,…..
তোমার আছে দু’হাত খানি \
ওর ঘরের জানালার পাশ দিয়ে উঠে গিয়েছে মাধবীলতার গাছ। বাতাসে ফুলের মিষ্টি গন্ধ ভাসে। সাদা, গোলাপী, লাল রকম রঙ এর ফুল। সে ফুল দিয়ে অপু কত ভাবেই না সাজায় তার ভালবাসার বাসর ঘরকে। ছাই পাশ কত কি ই না ভাবে সে। টেবিলের উপরে রাখা ব্যাংক রিক্রুমেটের অথবা শিক্ষক নিয়োগ গাইড কিংবা বি.সি.এস বইগুলো নিয়ে বসলে দূর্বোধ্য লাগে। বুয়া রান্না করে টেবিরের উপর খাবার ঢাকা দিয়ে রেখে যায়। সে খাবার টেবিলে রয়েই যায়। কোনদিন না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়ে, আবার কোনদিন নিদ্রাহীন রাত কাটে। নিস্তব্ধ রাতের কালো অন্ধকার বাইরে। উঠোনের বারান্দায় বসে অপুর কাঁধে মাথা রেখে আকাশের তারা গুনতে চেয়েছিল শীলা। আর আজ! জানালা দিয়ে দেখা এক টুকরো আকাশের মাঝে একাই তারা গুনতে থাকে অপু।
লোকাল বাসে করে ফিরছে অপু। কয়েটা ব্যাংকে গিয়ে বায়োডাটা দিয়ে এসেছে সে। এর আগে শীলাকে সাথে নিয়ে সিটিং সার্ভিস বাসগুলোতে উঠেছে সে। লোকাল বাসে এই তার প্রথম। রাস্তায় রাস্তায় বাসের জন্য অপেক্ষ্যমান শত শত মানুষ দেখে মনে হয়Ñ এদের প্রত্যেকেরই কি ঘর আছে? প্রত্যেকেই কি ঘরে ফেরে? নাকি এদের অনেকেরই ঠিকানা পতের পাশের ফুটপাত কিংবা রাস্তার মাঝে মাঝে থাকা গোল চত্বর? তীব্র গরম, ঘামের উৎকট গন্ধ, সিগারেটের ধোয়া, কিস্তি খেউর আর যানযটে আটকে থাকে অপু। শীলার কথা মনে পড়ে তার। দিন যায়, মাস যায় তবুও কষ্ট শেষ হয় না। কয়েক মাস আগেও এই শহর কত আনন্দের ছিল অপুর কাছে। আর সেই একই শহর আজ কত নিরানন্দের, কত বিষাদের। হঠাৎ ব্রেক কষাতে বাস থামে। আগে দু’টো বাস থেমে আছে। তার সামনে জটলা, চিৎকার, শোরগোল। একটা ছেলেকে বাস থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছে। দুই জন হিজরা বাসে উঠে সবার কাছ থেকে টাকা চাইছিল। ছেলেটি দিতে অ¯^ীকার করে, আর তাতেই অন্য একজন তার কোলে এসে বসে। বাসের কোন যাত্রী এগিয়ে আসে নাÑ শুধু হাসে আর তামাশা দেখে। ছেলেটি উঠে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করতেই ওরা দু’জন ধাক্কা দিয়ে বাস থেকে ফেলে দেয় ছেলেটিকে। জানালা দিয়ে ছেলেটিকে দেখার চেষ্টা করে অপু, কিন্তু ভিড়ের মধ্যে কিছু দেখতে না পেয়ে ও শুনতে পেলÑ ছেলেটি পলিটেকনিকের ছাত্র। নাক দিয়ে রক্ত ঝড়ছে, পায়ে চোট লেগেছে। তাদের মত অপুরা মেসের ১০/১২ ফুট ঘরে ৪/৫ জন মিলে থাকে। বুয়া রান্না করতে না এলে হোটেলে খেয়ে জন্ডিসে ভোগে। সেশন জটে পড়ে বছরের পর বছর ধরে পড়া শেষে একটা ভাল চাকরির জন্য এরা দিনের পর দিন অপেক্ষা করে। বাসের হেলপার, হিজরাদের হাতে এরা মার খায়। অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে পুলিশের টিয়ার শেলের আঘাতে এরা চিরদিনের জন্য অন্ধ হয়ে যায়। আর শীলা! তাদের মত শীলারা সেনানিবাসের ভিতরে কিংবা চলন্ত বাসে গণ ধর্ষণের ¯^ীকার হয়ে মৃত্যু বরণ করে অথবা ধর্ষিতের নতুন পরিচয়ে সারা জীবন বেঁচে থাকে। অথচ! অন্যায়কারীদের কোন বিচার হয় না এদেশে।
দুপুর থেকে বিদ্যুৎ নেই। ছাদের উপর চিলে কোঠার ঘরে তার সেদিন ভাদ্রের অসহ গরম। পশ্চিমের রোদ দেয়ালে পড়ে ঘরটাকে আরো তাতিয়ে তুলেছে। আজ কোন টিউশনিও নেই অপুর, তাই ঘর থেকে বের হয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাহাদুর শাহ পার্কের দিকে আসে। তারই মত একটি ছেলে ডিজিটাল ওজন মাপার যন্ত্র নিয়ে অপেক্ষা করছে। অপুকে দেখে ডাকে ওজন নেওয়ার জন্য। পাশে একজন বৃদ্ধ লোক ছাতা সারাই এর বড় থলি নিয়ে বসে আছে। অপুর মনে হল, দিন শেষে, কত রোজগার হয় এদের? সংসারের মানুষগুলো, এদের রোজগারের টাকার আশায় অপেক্ষা করে। সামান্য এই টাকায় কিভাবে বেঁচে থাকে এরা? পার্কে রোদ নেই। বড় বড় গাছের ছায়া মাটিতে। তবে বাতাস নেই। গুমোট গরম। ঘাসের উপর বসে প্রায় সমবয়সী দু’টি শিশু পাত-পা ছড়িয়ে কাঁদছে। এক চা-ওয়ালার কাছ থেকে দু’টো পাউরুটি কিনে অপু দিয়ে আসে ওদের। তবুও কাঁদতে থাকে ওরা। চা-ওয়ালা বলে, Ñ“ওদের কান্না থামবো না ভাইজান। দুই দিন হলÑ ওদের মাইর কোন খবর নাই।” শিশু দু’টির দিকে ফিরে তাকায় অপু। মায়ের আঁচল থেকে হারিয়ে গিয়ে শিশু দু’টি হয়ত বিক্রি হয়ে যাবে, কিংবা পাচারকারীর কবলে পড়বে। পাচার হয়ে যাবে ভারতে কিংবা মধ্যপ্রাচ্যে। হঠাৎই চোখ আটকে যায় অপুর। পাশাপাশি দু’টো ছেলেমেয়ে হেঁটে চলেছে। কাঁধে বই-এর ব্যাগ। হয়ত ওদের কলেজেরই স্টুডেন্ট ওরা। মেয়েটির দিকে তাকিয়ে শীলার কথা মনে পড়ে অপুর। শীলার সাথে একদিন সেও পাশাপশি হাঁটত। ছেলে মেয়ে দু’টি Ñ হাসে, কথা বলে, এক আইসক্রীম দুজনে মিলে খায়। হঠাৎ মুখোমুখি দাঁড়ায় ওরা। ছেলেটি মেয়েটি কপাল থেকে চুলগুলো সরিয়ে দেয়। মনে পড়ে একদিন দুপুরে শীলাকে ডাকতে গিয়ে গেস্ট রুমে বসে অপেক্ষা করছিল অপু। জ্বর গায়ে নিয়ে শীলা এসেছিল দেখা করতে। ইচ্ছা করলেই অপু সেদিন শীলার কপাল স্পর্শ করে ওর শরীরের তাপমাত্রা অনুভব করতে পারত; কিন্তু করেনি। ওদের যাবার পথে তাকিয়ে থাকে অপু। ঐ ছেলে-মেয়ে দু’টিও কি ভ‚ল করছে তাদের মত? ভালবাসা কি শুধুই ভ‚ল? সারা জীবন ধরে সে ভ‚লের কষ্ট বয়ে বেড়াতে হয়? নাকি, Ñ ভালবাসাÑআশা জাগায়, ¯^প্ন নিয়ে বাঁচতে শেখায়? …কোনটা, হাঁটতে হাঁটতে অপু দেখেÑ ছোট্ট এক হাড়িতে ভাত রান্না করছে এক নারী; তার কোলের অপুষ্ট শিশুটি তার মায়ের শীর্ণ স্তন চুষতে চুষতে ঘুমাচ্ছে আর ঐ মাকে ঘিরে ৪/৫টি শিশু ভাতের থালা নিয়ে অপেক্ষা করছে। এক জনের ঐ সামান্য ভাত ক’জন মিলে খায় এরা! সারা পার্ক জুড়েই ছড়িয়ে আছেÑ রুগ্ন, অপুষ্ট ছিন্নমূল শিশুরা। বাবা মায়ের ¯েœহ ভালবাসা থেকে প্রকৃতির নিয়মে এরা বড় হচ্ছে। এদের ঘর সেই, আশ্রয় নেই। রাতের অন্ধকারে বৃষ্টি হলে ঘুমন্ত অবস্থায় এরা বৃষ্টিতে ভেজে; মাঘের কনকনে শীতেও এরা ফুটপাতে থাকে। পার্কের এক কোণে ১০/১২ বছরের ৫/৬টি ছেলেমেয়ে, একটা ধোঁয়া ভর্তি পলিথিন থেকে এক এক করে সবাই সেই ধোঁয়া নিচ্ছে। নেশার টাকা যোগাড় করতে দু’দিন পড়ে, এরাইÑ হয়ে উঠবে সন্ত্রাসী, ছিনতাইকারী কিংবা ভাড়াটিয়া খুনি। আন্তর্জাতিক ¯^াক্ষরতা দিবস উপলক্ষে রাস্তায় রাস্তায় বড় বড় ব্যনার টানানো হয়েছে। কিন্তু, কে শেখাবে এদের অক্ষর জ্ঞান? মাদকের অন্ধকারাচ্ছন্ন পঙ্কিল জীবন থেকে টেনে এসে কে এদের আলোর পথ দেখাবে? ১০ টাকার বাদাম কিনে নিয়ে পার্কের বেঞ্চিতে গিয়ে বসে অপু।
আসার সময় দেখে এসেছে রাস্তার মোড়ে ট্রান্সফরমার বদল হচ্ছে। এত তাড়াতাড়ি কাজ শেষ হয়নি, তাই ঘরে ফেরারও তাড়া নেই অপুর। প্রতিদিনের মত সেই পুরানো নম্বরে আজও ফোন করে সে, যদি তোন দিন শীলা ফোন ধরে! কিন্তু এখনও সেই একই উত্তর, “এই মুহূর্তে মোবাইল সংযোগ দেয়া সম্ভব নয়।” অপু চেয়েছিল, শীলার সাথে যোগাযোগ রাখতে। কিন্তু শীলা রাখেনি। চিরদিনের জন্যই সে অপুকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে। Ñতবে কেন এই বন্ধনে জড়িয়ে থাকা? কেন সে পিছন ফিরে ডাকবে অপুকে? কোন অধিকারে?
একটি একটি করে দিন গিয়ে দু’বছরের বেশী হয়ে গিয়েছে। অপুর চাকরি হয়েছে ধানমণ্ডির এক প্রাইভেট ব্যাংকে। এরপর ও সামনে বি.সি.এস-এর ভাইবা। অপুর তবুও মনে পড়ে শীলার কথা। শীলাকে আজও যেন সে খুজে পায়Ñ তার অস্তিত্বের মাঝে, হৃদয়ের গভীরে। এই ঘরে শীলার স্পর্শ আছে, তাই তো অপু এই বাসা ছেড়ে যায় না। অনেক রাতে এক টুকরো জোৎ¯œার আলো এসে পড়ে অপুর বিছানায়। সে এক ভাবে তাকিয়ে থাকে চাঁদের দিকে। এরপর, এক সময়Ñ শীলার ঐ মায়াভরা মুখটা তার দু’হাতের মধ্যে নিয়ে জিঙ্গে করে,
Ñ“তুমি কেমন আছ শীলা”?
গভীর রাতে কৃষ্ণপ¶ের আধা খাওয়া চাঁদের আলো আঁধারের মাঝে শীলার কাছ থেকে কোন উত্তর না পেলেও, আজ সকালে অপ্রত্যাশিতভাবে শীলার ফোন পায় অপু। নিজেকে কিছুতেই বিশ্বাস করাতে পারে না সে! একি সত্যি শীলার কণ্ঠ¯^র! তবে সেই কণ্ঠ¯^র অনেক বেশী ভারী, অনেক বেশী সাবধানী। আগামী পরশু, ভার্সিটিতে- ওর ভাই শাওনের ভর্তি পরী¶া। দু/তিন দিনের জন্য তাই শাওন এসে থাকবে অপুর কাছে।
অপুর সারাদিনের প্রতী¶া আর গভীর উৎকণ্ঠার শেষে হয় একসময়। শাওন আসে রাত ১০টায়। ব্যাকুল হয়ে শাওনের মাঝে শীলাকে খুঁজে পেতে চায় অপু। কেমন আছে শীলা? ওকি আগের চেয়েও সুন্দর হয়েছে? ওকি মা হয়েছে? তার কথা কিছু বলে না শীলা? কিন্তু এসবের কোন উত্তরই পায় না অপু। সে শুধু জানতে পারেÑ শীলার কণ্ঠার হার উঁচু হয়ে উঠেছে। চোখের নীচে কালি পড়ছে। সারা শরীরে ওর অত্যাচারের চিহ্ন। টিউশনি করে শীলা। টিউশনির সব টাকাই তুলে দিতে হয়, ওর শ্বশুড়ীর হাতে, টাকা না দিলেই শীলা গায়ে হাত তোলে ওর ¯^ামী। মুহূর্তের মধ্যে বিবর্ণ হয়ে যায় সব কিছু। নিঃশ্বাস নিতে ঘর ছেড়ে বাইরে এসে হাঁটতে শুরু করে অপু। ঘণ্টা খানেক কিংবা হয়ত তারও বেশী সময় গড়িয়ে গিয়েছে এর মধ্যে। তার গালে বসে যাওয়া সেই রঙ কি উঠেছে? হঠাৎ পায়ে বাধা পেয়ে থমকে দাঁড়ায় সে। দেখে, Ñফুটপাতে ফেলে দেওয়া একটা তোষক; বৃষ্টিতে ভিজে গেছে, তার উপরে কোন মতে শুয়ে রয়েছেন একজন বৃদ্ধ, আর তার পাশে কুন্ডলী পাকিয়ে ঘুমাচ্ছে এক কুকুর। হাঁটতে হাঁটতে কখন যে অন্ধকারে ঘেরা নির্জন এই ফুটপাতে চলে এসেছে খেয়াল করেনি অপু। হঠাৎই বিদ্যুৎ চমকানোর তীব্র আলোর ঝলকানি, আর এরপর শব্দ। একটা বড় গাছের নীচে এসে দাঁড়ায় সেÑ আর দৃশ্যটা তখনই তার চোখে পড়ে। একটু দূরে পলিথিনে ঘেরা খুপড়ি ঘর থেকে একটি পুরুষের ছায়ামূর্তি বেড়িয়ে আসে, তারই সাতে একটি নারীর ছায়াও আসে। মেয়েটি, পুরুষের পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে, “Ñস্যার আমার বাচ্চার অসুখ স্যার; খিধায় কাঁদাতছে স্যার বাচ্চাটা; অনেক কষ্ট স্যার। আমার টাকাটা দিয়া যান স্যার।” পুরুষ লোকটি পা ছাড়িয়ে হন হন করে হেঁটে চলে যায়। অপু জানে, তার শার্টের পকেটে ১০০ টাকা আছে। একবার মনে হয়Ñ টাকাটা সে মেয়েটাকে দিয়ে যাবে। খুপড়ি ঘরের সামনে এসে দাঁড়ায় অপু, কিন্তু মেয়েটিকে আর ডাকতে পারে না সে। প্রতি রাতে, এভাবে কত কিশোরী, কত নারী পুরুষের বিকৃত লালসার ¯^ীকার হয়Ñ তার খোঁজ কেউ রাখে না। প্রতি রাতে এরা হাতে হাতে বদলায়। সে সন্তানের জন্য ঐ মায়ের এত আকুতী, তার জন্ম হয়ত এভাবেই হয়েছে। ক্ষুধার রাজ্যে তার মায়ের ভাতের থালার কাছে, আরো একটি মুখ বেড়েছে। জ্বড়ে আক্রান্তÑ ক্ষুধার্ত শিশুটির কান্না, তার মায়ের কান্নার সাথে মিশে আরো জোড়ালো হয় ঠিকই, কিন্তু সেই কান্না আর কারো কানে পৌঁছে না। পলিথিনে ঘেরা ছোট্ট খুপরির মাধ্যে ঘুর পাক খেতে থাকে।
বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আবার হাঁটতে শুরু করে অপু। নিজেকে বড় অসহায় মনে হয়। জীবন যেন এক অন্ধকারাচ্ছন্ন পাত কুয়া। একই বৃত্তে বার বার পথ চলা। মুক্তির কোন পথ নেই। একদিন তার চাকরি ছিল না, কিন্তু শীলা ছিল। আর আজÑ আজ তার চাকরী আছে, মাস গেলে বেতনের পঁচিশ হাজার টাকা আছে, কিন্তুÑ শীলা নেই, আছে তার অবিবাহিত বড় বোন। টাকা জমিয়ে তাকে ভাল ঘরে বিয়ে দেওয়ার ¯^প্ন দেখে অপু। শীলাকে নিয়েও তো দিনের পর; বছরের পর বছর ধরে কত ¯^প্ন দেখেছিল সে! তাই তো আজ নতুন কোন ¯^প্ন দেখতে বড় ভয় হয় তার। মাঝে মাঝেই ইচ্ছে হয়, Ñযত বারই সে হারিয়ে যেতে চেয়েছে, তত বারই তার বিধবা মা আর বোন যেন জড়িয়ে ধরে তাকে। পিছন থেকে ডেকে বলে,Ñ “ফিরে আয়, ফিরে আয়।” এই দুই নারীর সাথে আরো এক নারী তাকে অবলম্বন করে বেঁচে থাকতে চেয়েছিল। কিন্তু অপু তাকে গ্রহণ করতে পারেনি। নিজেকে বড় অপরাধী মনে হয় অপুর। সে শুধু চেয়েছিল, ¯^ামী, সংসার, সন্তান নিয়ে শীলা সুখে থাক, এর বেশী কিছু নয়। ছোট্ট আশা, তবুও মেটেনি। বৃষ্টির জলে সম্পূর্ণ ভিজে উঠে অপু। কিন্তু সে ঘরে ফেরে না। রাস্তার দু’পাশে বৃষ্টির জল জমতে শুরু করে। সারি সারি স্ট্রিট ল্যাম্পের হলুদ আলোর ছায়া ভাসতে থাকে সে জলে। চোখ ফেটে জল আসে অপুর। চোখের জলে আরো ঝাপসা হয়ে আসে চারিদিক। রাত বাড়তে থাকে। আরো জোড়ে বৃষ্টি নামে। আকাশ ভাঙা বৃষ্টি।

মানবধিকার কর্মী, টরন্টো, কানাডা।