বাংলাদেশ পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী দেশের কাতারে সামিল হওয়া এবং বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী নিউক্লিয়ার ক্লাবের কার্যকর সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্তের বিষয়টি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আজ বাংলাদেশের জনগণের জন্য অত্যন্ত গর্বের ও আনন্দের দিন।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের নিরলস প্রচেষ্টায় পারমাণবিক জ্বালানি গ্রহণের মধ্য দিয়ে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র সফল পরিণতি লাভ করছে।
বৃহস্পতিবার (৫ অক্টোবর) বিকেলে রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি হস্তান্তর অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যোগ দিয়ে বক্তব্যে একথা বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এসময় রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনও ভার্চুয়ালি অংশ নেন।
অনুষ্ঠানে পারমাণবিক জ্বালানির একটি নমুনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমানের হাতে হস্তান্তর করেন রুশ পরমাণু শক্তি করপোরেশন রোসাটমের মহাপরিচালক আলেক্সি লিখাচেভ।
ঐতিহ্যবাহী নিউক্লিয়ার ক্লাবের কার্যকর সদস্য হওয়ার এই দিনে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় চার নেতা, মহান মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ বীর শহিদ এবং ২ লাখ নির্যাতিত মা-বোনকে স্মরণ করে সব বীর মুক্তিযোদ্ধাকে সালাম জানান প্রধানমন্ত্রী।
তিনি কৃতজ্ঞতা জানান বন্ধুপ্রতীম রাশান ফেডারেশনের সরকার এবং জনগণের প্রতি, যারা মহান মুক্তিযুদ্ধে ও যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনে অসামান্য সহযোগিতা করেছিলেন এবং আমাদের এই স্বপ্নের প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।
দেশ স্বাধীনের পর ধ্বংসপ্রাপ্ত একটি জনপদকে মাত্র ৩ বছরে রাশিয়া ও ভারতসহ অন্যান্য বন্ধু রাষ্ট্রের সহায়তা নিয়ে অবকাঠামো গড়ে তোলা, অর্থনীতিতে গতিশীল করা, জিডিপি প্রবৃদ্ধি রেকর্ড ৯ শতাংশের ওপরে অর্জন করেছিলেন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধু ১৯৫৬-৫৭ সালে প্রাদেশিক সরকারের শিল্প, বাণিজ্য, শ্রম, দুর্নীতিরোধ এবং গ্রামীণ সহায়তা মন্ত্রী থাকাকালে এ অঞ্চলে উৎপাদনমুখী শিল্পায়নের ওপর জোর দিয়ে নানা উদ্যোগ হাতে নিয়েছিলেন।
তিনি বলেন, ১৯৬১ সালে পশ্চিম পাকিস্তানে একটি এবং পূর্ব বাংলার রূপপুরে একটিসহ মোট দু’টি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। ‘৭০ সাল পর্যন্ত নামমাত্র জমি অধিগ্রহণ ছাড়া সেই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য তারা কিছুই করেনি।
বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার পর প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিদ্যুতায়নের উদ্যোগ নিয়েছিলেন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সমুদ্র সম্পদ, এমনকি খনিজ সম্পদ জাতীয়করণ করেছিলেন এবং বিদেশি ও বহুজাতিক কোম্পানিগুলো থেকে আমাদের গ্যাস ফিল্ডগুলো কিনে নিয়ে রাষ্ট্রীয় মালিকানা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন এবং নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগের নির্দেশ দিয়েছিলেন।
বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়াকে প্রস্তাবিত রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের পরিচালকের দায়িত্ব দিয়েছিলেন জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, সে অনুযায়ী কিছু কাজও হয়েছিল। দুর্ভাগ্য, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকেরা জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করার পর এই মেগা প্রকল্পটিসহ সব জনবান্ধব ও উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড থেমে যায়।
‘এরপর দীর্ঘ ২১ বছর পাকিস্তানি কায়দায় এই দেশ পরিচালিত হয়েছিল। গণতন্ত্র ছিল না। এই ২১ বছর আমরাই জনগণের ভোট-ভাতের জন্য সংগ্রাম করেছি। ’৭৫ এর পর ৬ বছর আমাদের রিফিউজি হিসেবে থাকতে হয়েছে। পিতা-মাতা-ভাইদের এবং আত্মীয়-স্বজন হত্যার বিচার চাইতে পারিনি। মানবাধিকার বলে তখন কিছুই তো ছিল না। খুনিদের রক্ষা করতে ইনডেমনিটি দেওয়া হয়েছিল। আমাদের দূতাবাসগুলোতে চাকরি দিয়ে তাদের পুরস্কৃত করা হয়েছিল। সংবিধানের উপর খড়্গ চালানো হয়েছিল। দুখী মানুষের অধিকার হরণ করা হয়েছিল।’
১৯৯৬ সালে সরকার গঠন করে ‘সবার জন্য বিদ্যুৎ’ সরবরাহের লক্ষ্য নিয়ে ‘ভিশন স্টেটমেন্ট ও পলিসি স্টেটমেন্ট অন পাওয়ার সেক্টর রিফর্মস’ প্রণয়নও অনুমোদন করার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, আমরা জ্বালানি নীতিতে পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করি। ‘রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প’ বাস্তবায়নের কার্যক্রম শুরু করি। ‘বাংলাদেশ নিউক্লিয়ার পাওয়ার অ্যাকশন প্ল্যান-২০০০’ প্রণয়ন করি। ‘আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা-আইএইএ’র সহযোগিতা চাই।
‘বিষয়টি যেহেতু আমাদের কাছে একেবারেই নতুন ছিল, সে কারণে জটিল আইন-কানুন বুঝতেই আমাদের ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। ২০০১ সালের পর বিএনপি-জামাত জোট সরকার ক্ষমতায় এসেই আমাদের নেওয়া সব জনবান্ধব ও উন্নয়নমূলক কর্মসূচি/প্রকল্প বন্ধ করে দেয়। আবারও হিংসা জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ, বেপরোয়া লুটপাট এবং সেনাশাসনের আবরণে গণতন্ত্র ঢাকা পড়ে। তবে ২০০৮ সাল থেকে পরপর ৩ দফা সরকারে থাকার কারণেই আমরা আজ বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী নিউক্লিয়ার ক্লাবের সদস্য হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পেরেছি।’
অনেকগুলো মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করে সেগুলোর সুফল জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার কথা জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ এক বদলে যাওয়া দেশ।
‘রূপকল্প-২০২১’ এর সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ‘পাওয়ার সেক্টর মাস্টার প্ল্যান-২০১০’ প্রণয়ন করার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, আবার রূপপুর প্রকল্পটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করি। বন্ধু রাষ্ট্র রাশিয়া এটি বাস্তবায়নে এগিয়ে আসে। তাছাড়া, আইএইএ শুরু থেকেই আমাদের নানাভাবে সহায়তা করে আসছে।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখন পর্যন্ত আপনার সর্বাত্মক সহযোগিতায় অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয়ে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি সফলতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে।
পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিতে জ্বালানি সংযুক্ত হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, পরমাণু শক্তি আমরা শান্তি রক্ষায় ব্যবহার করবো। আমরা বিশ্বব্যাপী পারমাণবিক অস্ত্রের সাধারণ ও সম্পূর্ণ নির্মূল এবং পারমাণবিক অস্ত্র নিষিদ্ধকরণ চুক্তির বাস্তবায়নের প্রতি দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করছি। আমরা ‘বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি নিয়ন্ত্রণ আইন’ প্রণয়ন করেছি এবং একটি স্বাধীন পরমাণু শক্তি নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা করেছি।
২০২৩ সালের মধ্যে প্রথম ইউনিট থেকে এবং ২০২৪ সালের মধ্যে দ্বিতীয় ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার কথা জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, অচিরেই প্রথম ইউনিট থেকে ১২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে।
যে কোনও ধরনের দুর্যোগে আমাদের এই পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেদিক খেয়াল রেখে এই প্ল্যান্টের ডিজাইন প্রণয়ন এবং নির্মাণকাজ পরিচালনা করা হচ্ছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ব্যবহৃত জ্বালানি (স্পেন্ট ফুয়েল) ব্যবস্থাপনার জন্য আমরা রাশান ফেডারেশনের সঙ্গে চুক্তি সই করেছি। রাশান ফেডারেশন এসব স্পেন্ট ফুয়েল তাদের দেশে ফেরত নিয়ে যাবে।
অনেক চড়াই-উৎরাই পার হয়ে বাংলাদেশ পৃথিবীর বুকে উন্নয়নের রোল মডেল উল্লেখ করে শেখ হাসিনা এসডিজি পুরস্কার, চ্যাম্পিয়ন অব দ্য আর্থ, সাউথ-সাউথ পুরস্কার অর্জনের কথা উল্লেখ করেন।
আজ থেকে পরমাণু স্থাপনার মর্যাদা পেল রূপপুর প্রকল্প। অনুষ্ঠানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক মন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সচিব মো. আলী হোসেন ও আরএনপিপি নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক ড. মো. শৌকত আকবর উপস্থিত রয়েছেন।
রূপপুর বিদ্যুৎ প্রকল্পটি মোট ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার। দুটি ইউনিটে বিভক্ত এ প্রকল্পের প্রথম ইউনিটের কাজ এরই মধ্যে ৯০ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে এবং দ্বিতীয় ইউনিটের কাজ ৭০ শতাংশ এগিয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা।
গত ২৮ সেপ্টেম্বর রাশিয়া থেকে দেশে আসে রূপপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জ্বালানি। কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে পরদিনই তা প্রকল্প এলাকায় নেওয়া হয়। রূপপুর প্রকল্পসংশ্লিষ্ট সূত্র জানা গেছে, জ্বালানি হস্তান্তর হওয়ার এক বছর পর অর্থাৎ আগামী বছরের সেপ্টেম্বরে কেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট পরীক্ষামূলক উৎপাদনে যাবে।