আফসান চৌধুরী: এবারের ওয়ার্ল্ড কাপ আমাদের মনে থাকবে ৭টি পরাজয় আর টাইম আউট নিয়ে হাঙ্গামার জন্য। জয়ের সন্ধানে গুড়ে বালি! সেটা জানার পরও মানুষ নতুন করে কষ্ট পায়। এতো আবেগ কেন? ফুটবলের খবর তো কেউ রাখেই না প্রায় আজকাল; মানে জাতীয় দলের। আসলে ক্রিকেট খেলাটা মোটেও খেলার বিষয় নয়। তবে কী? সোজা কথায় খেলা হয়ে গেছে গোটা দেশের NID কার্ড।
২
বাংলাদেশের টিমের কি জেতার কথা ছিল? কে নাকি বলেছিল- আমরা সেমিতে খেলব? সবাইকে হারাবো- এসব। সে কে ভাই? আর পাবলিক তাই গিলে খেল টং দোকানের চয়ের মতো। এটা ছিল শুরুর কথা। আর টুর্নামেন্ট শেষে শঙ্কা ছিল- আমরা কি চ্যাম্পিয়নশিপ ট্রফিতে যেতে পারব যদি না ৮ নম্বরে থাকতে পারি? এটা হলো একটা আগরতলা, অন্যটা চৌকিরতলা। মাত্র দুই সপ্তাহে বিশ্বে নয়, নিজেদের কাছে প্রমাণ দিলাম- আমরা পারি না জিততে। এমন কি মাননীয় হাই কোর্টের বিচারপতিরা পর্যন্ত এ নিয়ে কথা বলেছেন। তাঁরা একটি কেসের রুল জারি করতে গিয়ে বলেন, ‘প্লেয়াররা টাকার পিছনে ছুটছে জয়ের পিছনে নয়’। পৃথিবীর কয়টা দেশের বিচারপতিগণ একটা ফেল্টু টিম নিয়ে এতো ক্ষোভ প্রকাশ করেন? প্লেয়ারদের কপাল ভালো সবার গণহারে ফাঁসির হুকুম হয়নি। এত ধাক্কা দেয় কেন আমাদের সকলকে ক্রিকেটের জয়-পরাজয়ে যেটা নাকি দেশে জনপ্রিয় নয়, মাত্র ক’জনার খেলা?
৩
অনেকে বলেন, ক্রিকেট একটা ঔপনিবেশিক খেলা এবং এটা নিয়ে আমাদের এতো মাতামাতি ঠিক নয়। আমাদের পূর্বপুরুষরা এটি কখনও খেলেননি এবং আমাদের সাংস্কৃতি, ঐতিহ্য সব এর বিরোধী। ভাগ্যিস, এটা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী খেলা- এটা কেউ বলেননি। আসলে দুনিয়াজুড়ে ক্রিকেট নতুন খেলা। ২০০ বছর আগে ছিল না, খোদ ইংল্যান্ডেও অর্থাৎ মাতৃভূমিতেও। আর এখন সেখানে এই খেলা বাংলাদেশের চেয়ে অনেক কম জনপ্রিয়। যদিও এটি বিশ্বকাপ কিন্তু ব্রিটিশ মিডিয়াতে এর কোনো উল্লেখ প্রায় নেই! বিবিসি’র খেলাধুলার খবরে এটি সাধারণত শেষ আইটেম। তাদের কাছে যা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো ফুটবল এবং তারপর রাগবি এবং অন্যান্য খেলা। জন্মভূমিতেই ত্রুকেট অদৃশ্যপ্রায়।
৪
তাহলে ফুটবলের কি অবস্থা? এটা মঞ্জুর যে ঔপনিবেশিক চ্যানেলের মাধ্যমে ক্রিকেট আমাদের দেশে এসেছে এবং তাই এটি ‘অবৈধ এবং বিদেশী এবং উচ্চ শ্রেণীর’ ইত্যাদি। কিন্তু ইতিহাস বলে, ফুটবলও এসেছে সায়েবদের হাত ধরে। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি ব্রিটিশ সৈন্যরা ভারতে ফুটবলের প্রচলন করেছিল। নগেন্দ্র প্রসাদ সর্বাধিকারীর প্রচেষ্টায় এটি ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। ১৮৮৮ সালে ভারতের শিমলায় ডুরান্ড কাপ প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি ভারতের মাটিতে প্রথম কাপ। ১৮৯৩ সালে IFA শিল্ড বিশ্বের চতুর্থ প্রাচীনতম ট্রফি হিসাবে আসে। তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতা ভারতীয় ফুটবলের কেন্দ্র হয়ে ওঠে। সারদা এফসি ছিল প্রাচীনতম ভারতীয় ফুটবল ক্লাব (উইকিপিডিয়া)। অর্থাৎ মাইন্ড খাইয়েন না, ফুটবল, ক্রিকেট দুইটাই সায়েবদের উপহার। তাহলে আমরা এতো ফুটবল পাগল কেন?
৫
দুনিয়াজুড়ে ফুটবল জনপ্রিয়। মানসিকভাবে সকল আদিম ক্ষুধা মেটায় এই খেলা। এটা দৈহিক খেলা, দ্রুত খেলা, ১১ জন সৈন্য বনাম ১১ জন লড়িয়ের যুদ্ধ। দৌড়, লাথি, গোল, চিৎকার, ধাক্কাধাক্কি, ফাউল, মারপিট, আহত, দর্শকদের মারপিট, তীব্র উত্তেজনা- সব আছে এবং ১২০ মিনিটে শেষ। ফুটবল আমাদের আদিম অতীতে ফেরত নেয় তাই ওটা থেকে কেউ ফিরতে চায় না।
৬
আসলে খেলাধুলা হলো আত্মপরিচয়ে সন্ধান করার পথ, মানে NID কার্ড। এবং যেহেতু আমাদের একটি বিশ্বব্যাপী ফুটবল দল নেই, আমরা ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনার উন্মাদ ভক্ত হয়ে উঠি, আমরা তারা হয়ে যাই বা হতে চাই। আমরা নিজ কল্পনায় নিজেদের ‘তারা’ মনে করি। কিন্তু তারা তো আমরা নই এবং দিন শেষে এটা আমরা বুঝি।আর যতই মেসি, রোনালদো থাকুক, সাকিব, তামিমকে লাগে। বেশির ভাগ মানুষের জন্য নিজেদের পতাকা লাগে। তাতে ফুটবল নাই, পছন্দ হোক আর না হোক আছে ক্রিকেট I
৭
যারা অনুসরণ করে এবং এখন যারা কোটির চেয়ে বেশি, তারা খেলা দেখেন তো বটেই কিন্তু আসলে স্বদেশকে দেখেন। তার মানে আমরা খেলার মধ্য দিয়ে প্রমাণ করতে চাই আমরা দেশ হিসেবে কতটা মাথা উঁচু করতে পারি। ক্রিকেট খেলা বিশ্বকে আমাদের শৌর্য দেখানোর একটি সুযোগ এনে দেয়। আমাদের তো অন্য তেমন কিছু নেই যাতে আমরা পৃথিবীর দশের ভেতর একজন, হোক ৮/৯ নম্বরে। যদি বলেন এই উৎসাহের প্রমাণ চাই। তাহলে বলব, সোশ্যাল মিডিয়ায় যান, দেখতে পাবেন। পরাজয়ের কষ্ট, বেদনা, রাগ, ক্ষোভ, ব্যঙ্গ ও ঘৃণা সব দেখতে পাবেন। যারা একসময় আমাদের শাসন করেছিল বা বিশ্বব্যাপী সুপারস্টার হিসাবে বিবেচিত দেশ তাদের পাশের দাঁড়াবার সুযোগ শুধু ক্রিকেট দেয় বাস্তবে। ফুটবল তো কল্পনার দুনিয়ার জাদুকরী আমাদের জন্য, যখন আর্জেন্টিনার জার্সি পরে পতাকা পাল্টাই। ক্রিকেট বাস্তব। এই কারণে ক্রিকেট গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এটা মোটেও খেলার বিষয় নয়, আমরা নিজেকে কি ভাবি এবং হতে চাই সেটা নিয়েই নির্মিত আমাদের ক্রিকেট।
৮
সাকিব আর তার পোলাপানদের বোকামি হলো তারা খেলা হারছিল না, তারা দেশের NID কার্ডটা হাতছাড়া করছিল। বোঝে নাই। এখন প্লিজ কার্ডটা খুঁজে বার করেন ভাইয়েরা আমার।
লেখক : সাংবাদিক, গবেষক, কথাসাহিত্যিক