জসিম মল্লিক
লেখক পরিচিতিঃজন্ম বরিশাল শহরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন। কলেজ জীবন থেকেই তাঁর লেখালেখির শুরু এবং দেশের বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক ও সাপ্তাহিক-এ নিয়মিত লিখছেন। ১৯৮৩ সালে তৎকালীন সাপ্তাহিক বিচিত্রায় কাজের মধ্য দিয়ে তার সাংবাদিকতার শুরু। দীর্ঘ প্রায় চল্লিশ বছরের সাংবাদিকতা ও লেখালেখির অভিজ্ঞতা।এ পর্যন্ত তার প্রায় পঁয়ত্রিশটির মতো গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।
১) আমার প্রায়ই একলা হয়ে যেতে ইচ্ছে করে। একলা বাঁচতে ইচ্ছে করে। বৈষয়িক ভাবনা, ঘরবাড়ি, দালান কোঠা এসব খুব বিষময় মনে হয়। প্রচুর সম্পদের ভার আমি নিতে পারব না। ডেবিট ক্রেডিটের হিসাব খুব অসহ্য লাগে আমার কাছে। আমি স্বীকার করি যে সুন্দরভাবে বাঁচার জন্য অর্থের প্রয়োজন আছে। আবার এটাও ঠিক যখন আমার কিছুই ছিল না তখনও আমি সুন্দরভাবে বেঁচেছিলাম। আনন্দময় ছিল সেই দিনগুলি। অনেক কিছু যে নাই সেই বোধটাই তৈরী হয়নি, তাই কিছু খারাপ লাগেনি। অনেক কিছু যে ছিল না তাতে কোনো কষ্ট পাইনি কখনো। ওই সময়ের জন্য ওটাই ছিল স্বাভাবিক। আমার খুব হালকা হয়ে বাঁচতে ইচ্ছে করে। পাখির পালকের মতো হালকা। আগে যেমন বেঁচেছিলাম। নির্ভার একটা জীবন ছিল। উদ্বেগহীন জীবন। ঘুম ভেঙ্গে যেনো কোনো অনাকাঙ্খিত খবর আমাকে বিচলিত না করে। কিন্তু সংসাৱেৱ এমনই নিয়ম যে প্রতিদিন কিছু লড়াই থাকে। বাঁচার লড়াই। স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো সামনে এসে পড়ে। প্রতিপক্ষ তৈরী হয়।
২) আমার খুব একলা বাঁচতে ইচ্ছে করে। চারিদিকে সবই থাকবে। সবকিছুর মধ্যে আমি একলা হয়ে যাব। কিন্তু এই পৃথিবী এতো কোলাহলমুখর যে একলা হয়ে বাঁচা কষ্টকৱ। এতো স্বার্থের সংঘাত যে নিজের মতো ডুব দিয়ে থাকা যায় না। আমাকে নিয়ে অনেকের অনেক অভিযোগ। স্ত্রীর অভিযোগ, ভাই বোনের অভিযোগ, বন্ধুর অভিযোগ, আত্মীদের অভিযোগ। আমি মানি যে আমার অনেক ত্রুটি আছে, সীমাব্ধতা আছে। আমি চাইলেও এসব ত্রুটি কাটিয়ে উঠতে পারব না। আমার অনেক কাছের আত্মীয়রাও আমাকে খারিজ করে দিয়েছে। ডিলিট করে ফেলেছে আমার নাম। যাদের জন্য অনেক করেছি, অনেক মমতা দিয়েছি তারাও আমার কাছ থেকে দূরে সরে গেছে। কেনো গেছে সেই কারন জানা নাই। জানতে পারলে ভাল হতো। কিন্তু জানতে ইচ্ছা করে না। আবার আমাকে ভালবাসে এমন আত্মীয়র সংখ্যাও কম না। আমার খুব একলা বাঁচতে ইচ্ছা করে।
৩) আমাকে নিয়ে কখনো কোনো অভিযোগ করে না আমার ছেলে মেয়ে। ভুল ত্রুটি খুঁজে বেড়ায় না। আমার সবকিছুতে ওদের সায় আছে। কখনো কোনো অবান্তর প্রশ্ন করেনা আমাকে। আমার ব্যর্থতা নিয়ে কোনো কথা বলে না। কোনোদিন কোনো কিছুর জন্য জোর করেনি যা আমি করতে পারব না। কোনো রাগ অভিমান করে থাকেনি। বরং আমি রাগ করে আমিই সরি বলেছি অনেকদিন। আমি যে লিখি তাতে ওরা প্রাউড ফীল করে। আমি যে দেশে যাই তাতেও সবসময় সম্মতি থাকে। ওদের বক্তব্য হচ্ছে বাবার যা ভাল লাগে তাই করবে। ওরাই আমার শক্তির জায়গা। সবসময় সমর্থন থাকে বাবার পক্ষে। কোনো কিছু না চাইতেই বাবার জন্য করতে চায়। তাই ওদেরকে কিছু বলা থেকে বিরত থাকি আমি। আমি সবসময় অকপটে ওদের কাছে আমার জীবনের গল্পগুলো বলি। আমার না পাওয়াৱ গল্প, বেদনার গল্প বলি। কিন্তু এমনভাবে বলি যেনো ওটাই বিরাট আনন্দের কিছু ছিল। যেনো কোনো বিষাদ ভর না করে ওদের মনে। কাউকে বিষাদ দিতে চাই না।
৪) আমার অনেক একলা বাঁচতে ইচ্ছা করে। একলা হয়ে যেতে ইচ্ছা করে। কিন্তু কিভাবে একলা হতে হয় তাই জানি না। চারিদিকের নানা ঘটনা অষ্ঠে পৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকে তাই একলা হওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। মায়া জিনিসটা খুব খারাপ, খু্ব পোড়ায়। মায়া কিছুতে ছাড়ে না। সন্তানের জন্য মায়া, স্ত্রীর জন্য মায়া, ভাই বোন, আত্মীয়, বন্ধুর জন্য মায়া। তাই আর একলা হওয়া হয়ে ওঠেনা। এই যে বেঁচে আছি, এই যে দীর্ঘ ঘরবন্দী জীবন, এই যে বস্তুগত জীবন তার মধ্যেও নিজেকে খুব একলা মনে হয়।
সেদিন গাড়িতে যেতে যেতে অরিত্রিকে বললাম,আমার কোথাও চলে যেতে ইচ্ছা করে।
অরিত্রি কথাটার অর্ন্তনিহিত অর্থটা বুঝতে পরেনি।
মনে করেছে আমি কোথাও ঘুরতে যেতে চাই বা দেশে যেতে চাই।
অরিত্রি বলল,তাহলে বাংলাদেশে যাও।হ্যাঁ যাব।ভ্যাকসিন নিয়েই যাও, ঘুরে আসো।
কিন্তু অরিত্রিকে তো আর বলা যায় না যে আমি একলা বাঁচতে চাই। এসব শুধু কল্পনায়ই থেকে যায়।