শেক্সপিয়র সরণিতে শুক্রবার রাতের জাগুয়ার গাড়ির দুর্ঘটনার তদন্ত নাটকীয় মোড় নিয়েছে। ওই গাড়ির চালক হিসেবে অভিযুক্ত আরসালান পারভেজ নামে এক যুবককে শনিবার গ্রেফতার করে পুলিশ। তার চার দিন পরে, বুধবার বিকেলে বয়ান বদলে লালবাজারে বসে গোয়েন্দা-প্রধান মুরলীধর শর্মা বলেন, ‘‘আরসালান নয়, তাঁর দাদা রাঘিব পারভেজই দুর্ঘটনা ঘটান।’’ দুর্ঘটনার পরে রাঘিব প্রথমে সল্টলেক, পরে দুবাই চলে যান বলে জানাচ্ছে পুলিশ।
এ দিন বেকবাগানের একটি নার্সিংহোম থেকে রাঘিবকে গ্রেফতার করা হয়। তবে আরসালানের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্নচিহ্ন ঝুলে আছে এখনও। তিনি বেকসুর খালাস পাবেন, নাকি প্রমাণ লোপাটের দায়ে তাঁর বিরুদ্ধেও ২০১ ধারায় মামলা করা হবে, সেই সিদ্ধান্ত নেবে পুলিশ। রাঘিবকে গা-ঢাকা দিতে, পালাতে সাহায্য করার অভিযোগে রাঘিবের মামা মহম্মদ হামজাকেও গ্রেফতার করা হয়েছে।
জাগুয়ার দুর্ঘটনার তদন্ত নয়া মোড় নেওয়ায় মুম্বইয়ের সলমন খানের বৃত্তান্ত মনে পড়ে যাচ্ছে অনেকের। সলমনের দুর্ঘটনার দায় তাঁদের পারিবারিক গাড়িচালকের উপরে চাপানোর চেষ্টা হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের ‘শাস্তি’ গল্পটিও মনে পড়ছে কারও কারও। দুঃখীরামের স্ত্রী-হত্যার দায় তেতো মুখে বহন করেছিল তার ভ্রাতৃবধূ চন্দরা। আরসালানের বদলে রাঘিবের মূল অভিযুক্ত হয়ে ওঠার মূলে তেমন কোনও রহস্য আছে কি না, চলছে সেই জল্পনাও। ঘটনাচক্রে এ দিনই দিঘায় ‘সেফ ড্রাইভ সেভ লাইফ’ প্রসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘এক জন দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে, অন্য জন আত্মসমর্পণ করছে— এটা চালাকি! এগুলো বন্ধ করতে হবে।’’
কী ভাবে মোড় নিল তদন্ত?
তদন্তকারীরা জানান, ১৭ অগস্ট দুপুরে আরসালান জেরার মুখে যা বলছিলেন, তাতে অসঙ্গতি ছিল। দুর্ঘটনার পরে চালকের মুখে ‘ট্রমা’ বা আতঙ্কের ছাপ থাকে, যেটা ওই যুবকের মুখে ছিল না। এলাকার সিসি ক্যামেরার ফুটেজে তদন্তকারীরা এক জনকে জাগুয়ার গাড়ি থেকে নেমে দৌড়তে দেখেন। সেই ব্যক্তির সঙ্গেও আরসালানের মিল ছিল না। তা ছাড়া জাগুয়ার গাড়ির নির্মাতা সংস্থার প্রতিনিধিরা এসে তদন্তকারীদের জানান, দুর্ঘটনার জেরে গাড়িতে রাখা ‘এয়ারব্যাগ’ খুলে চালকের মুখে লাগলে তা থেকে ‘সিলিকন বাইট’ নির্গত হয়। সেই সিলিকন বাইটের চিহ্নও ছিল না আরসালানের মুখে। জাগুয়ার পরীক্ষা করে গাড়ির সফটওয়্যারে একটি মোবাইলের নম্বর মেলে। সেই নম্বরের হোয়াটসঅ্যাপ ছবির সঙ্গে আরসালানের মুখের ছবি মিলছিল না। ছবিটি ছিল রাঘিবের।
তদন্তকারী অফিসারেরা জানান, আরসালানদের বাড়ির সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখে গিয়েছে, রাত সাড়ে ১১টায় রাঘিবই গাড়ি নিয়ে বেরোচ্ছেন। বেকবাগান, মৌলালি, মল্লিকবাজার, রফি আহমেদ কিদোয়াই রোড, পার্ক স্ট্রিট, জওহরলাল নেহরু রোড হয়ে শেক্সপিয়র সরণি-লাউডন স্ট্রিটের মোড়ে দুর্ঘটনা ঘটান তিনি।
১৬ অগস্ট, শুক্রবার রাত ১টা ৫০ মিনিটের পরে এলাকার ৪৫টি সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা যায়, রাঘিব শেক্সপিয়র সরণি ধরে কলামন্দির হয়ে মল্লিকবাজারের দিকে যাচ্ছেন। তদন্তে জানা যায়, রাঘিব তাঁর মামা, ব্রাইট স্ট্রিটের বাসিন্দা মহম্মদ হামজাকে ফোন করেন। মামা গাড়ি নিয়ে এসে রাঘিবকে সল্টলেকে এক আত্মীয়ের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে তোলেন। পরে পাঠিয়ে দেন দুবাইয়ে। সেখান থেকে ২০ অগস্ট, মঙ্গলবার ফেরেন রাঘিব।
আরসালান-রাঘিবের বাবা পারভেজ আখতারের অভিযোগ, ‘‘পুলিশই কোনও কথা না-শুনে তড়িঘড়ি আমার ছোট ছেলেকে গ্রেফতার করেছিল।’’ রাঘিবের দুবাই-যাত্রা প্রসঙ্গে তাঁর দাবি, ‘‘আমার ছেলে ব্যবসার কাজে দুবাই গিয়েছিল। মঙ্গলবার সকালে ফিরেও আসে। পালানোর মতলব থাকলে ফিরবে কেন?’’ তবে কী ভাবে দুর্ঘটনা ঘটেছে, তা তিনি জানতেনই না বলে দাবি পারভেজের। তিনি জানান, মঙ্গলবার ফিরে এসে গা-হাত-পা ব্যথার কথা বলে বাড়িতেই ছিলেন রাঘিব।