দেলওয়ার এলাহী
বীর মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ারুল আলম শহীদ আর নেই। বাঙালি জাতির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ কীর্তি একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের সময়কার বিশ্ব খ্যাত ‘কাদেরিয়া বাহিনীর’ বেসামরিক প্রধান ও বাহিনীর ‘সেকেন্ড ইন কমাণ্ড’ ছিলেন আনোয়ারুল আলম শহীদ। পরবর্তীতে তিনি সচিব ও রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেছেন৷ সেক্টর কমান্ডার ফোরামের সহসভাপতি ছিলেন। অটোয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত ছিলেন আনোয়ারুল আলম শহীদ। পরবর্তীতে মধ্যপ্রাচ্য ও স্পেনে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেছেন। আজ থেকে দীর্ঘ বছর আগে ‘দেশে বিদেশে’ পত্রিকার প্রধান সম্পাদক নজরুল ইসলাম মিন্টো ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক, তৎকালীন ‘দেশে বিদেশে’র সম্পাদক তাজুল মোহাম্মদ আনোয়ারুল আলম শহীদ ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে আমারও তাঁদের সঙ্গে থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল। অটোয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশনে আমরা গিয়েছিলাম তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। দীর্ঘদেহী সুদর্শন পুরুষ আনোয়ারুল আলম শহীদ ছিলেন হাসিখুশি বন্ধুবৎসল। অতি আন্তরিকতার সাথে আমাদের সবার সঙ্গে গল্প করেছেন। অবাক বিস্ময়ে শহীদ ভাইকে দেখে ভেবেছি, বিশ্বখ্যাত এক বীর মুক্তিযোদ্ধার সামনে আমি বসে আছি!
কাদেরিয়া বাহিনীর গোয়েন্দা প্রধান ছিলেন ড. নূরুন নবী। নবী ভাইয়ের সঙ্গে যখনই দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে, প্রায়শই আমি শহীদ ভাইয়ের কুশল জানতে চেয়েছি। শহীদ ভাই ছিলেন নবী ভাইয়ের আত্মার একটি অংশ। তাঁদের পরস্পরের প্রতি এরকম ভ্রাতৃত্ববোধ ও সম্মান প্রদর্শন দেখেই আমি নবী ভাইয়ের কাছে শহীদ ভাইয়ের কুশল জিজ্ঞাসার উৎসাহ ও প্রেরণা পেতাম। নবী ভাইয়ের যেরকম অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্ব, তেমনি সাত আকাশের মতো বিশাল তাঁর আন্তরিকতা। যে কেউ, যে কোন কিছু তাঁর কাছে জানতে চাইলে তিনি অতি উৎসাহের সঙ্গে জিজ্ঞাসার উত্তর দেন। জিজ্ঞাসুর আগ্রহকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে গণ্য করেছেন এরকম এক সম্মান প্রদর্শন তাঁর মুখশ্রুত উত্তরে লেগে থাকতো। বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে কাদের সিদ্দিকী, আনোয়ারুল আলম শহীদ, নূরুন নবী আমাদের জাতীয় বীর। তাই, যখনই সুযোগ হয় নবী ভাইয়ের কাছে আমার নানা জিজ্ঞাসার উৎসুকভাব লেগেই থাকে। শহীদ ভাই সম্পর্কে নবী ভাইয়ের অনুভব অনুভূতির বিষয়টি এভাবেই আমি বুঝতে পেরেছি।
শহীদ ভাই বেশ কিছুদিন থেকেই অসুস্থ। ভিতরে ভিতরে একটি আশংকা কাজ করছিল কি হয়, কি হয়! আজ সকালে চোখ মেলতেই খবর জানলাম তিনি আর আমাদের মাঝে নেই। খবরটি জানার সঙ্গে সঙ্গেই আমার চোখের সামনে ড. নূরুন নবীর মুখটি ভেসে উঠলো। আহা, প্রিয় নবী ভাই তাঁর আত্মার আত্মীয়কে হারিয়ে কী কষ্টই না পাচ্ছেন! ভয়ে ভয়ে তাঁকে ফোন দিতেই তিনি ধরলেন। কিন্তু কোন কথা বলতে পারলেন না। তাঁর বুক ফাঁটা কান্নায় কাঁপা ঠোঁট গড়িয়ে পড়া চোখের অশ্রুতে ভিজে গেল। আমি নিশ্চুপ রইলাম। একবার শুধু বলতে পারলাম – নবী ভাই!
দীর্ঘ নিরবতার পর নবী ভাই বললেন -‘ দেলওয়ার – শহীদ ভাই ওয়াজ মাই সোল ম্যাট! টাঙ্গাইলের মধুপুরের দক্ষিণে সখিপুর পাহাড়ের গভীর জঙ্গলে কাদেরিয়া বাহিনীর হেডকোয়ার্টার। শহীদ ভাইয়ের সঙ্গে আমার সেই জঙ্গলের হেডকোয়ার্টারে দেখা হতো, কথা হতো। যুদ্ধের বিভিন্ন বিষয়াদি নিয়ে আমরা আলাপ আলোচনা করতাম। আমি যেহেতু কাদেরিয়া বাহিনীর গোয়েন্দা প্রধান, আমার দায়িত্ব বড় কঠিন! গোয়েন্দাগিরি করে খবরাখবর আদানপ্রদান। ৭১ সালের নভেম্বর মাসে আমি তৃতীয়বারের জন্য ভারত যাচ্ছি লেফটেন্যান্ট জেনারেল অরোরার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। সেটা আমার তৃতীয়বার ভারত যাত্রা। যমুনা নদী দিয়ে যাবো। শহীদ ভাইও যাবেন আমার সঙ্গে। তবে তাঁর যাত্রা মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা। সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীন আহমেদের সঙ্গে তিনি দেখা করবেন। একসাথে আমরা যমুনা নদী দিয়ে নৌকায় করে ভারতে গিয়ে পৌঁছলাম। শহীদ ভাই চলে গেলেন কলকাতায়। আমি গেলাম লেফটেন্যান্ট জেনারেল অরোরার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। তুরা পাহাড়ে তখন আওয়ামী লীগ নেতা লতিফ সিদ্দিকীও অবস্থান করছিলেন। আমার মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বরাদ্দকৃত ভারত সরকারের দেওয়া ঔষধ, কম্বল ও অর্থ আসবে। আমি সব বুঝে নিলাম। আমার কাছে তারচেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ হলো লেফটেন্যান্ট জেনারেল অরোরার দেওয়া অত্যন্ত গোপন একটি খবর। অরোরা আমাকে গোপনে এই গুরুত্বপূর্ণ খবরটি শুধুমাত্র আমাদের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে জানানোর জন্য বললেন। বলা বাহুল্য সেই ব্যক্তি আমাদের কাদেরিয়া বাহিনীর প্রধান কাদের সিদ্দিকী। আমার সকল কাজ শেষ করে আমাকে দেওয়া অরোরার গোপন খবর, কম্বল, ঔষধ ও টাকা নিয়ে আমি ফেরত আসবো। শহীদ ভাই কলকাতা থেকে এসে আমার সঙ্গে যোগ দিলেন। লতিফ ভাই আমাদের দু’জনের একসাথে আসা দেখে বললেন – তিনিও আমাদের সঙ্গে আসবেন। আমরা নৌকা যোগে যাত্রা শুরু করলাম। বিরতিহীনভাবে তিনদিনের নৌপথ। রাতদিন আমরা নৌকায়। এই তিনদিনে লতিফ ভাই ও শহীদ ভাই বারবার আমার কাছে জানতে চেয়েছেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল অরোরার সঙ্গে বৈঠকে আমার কি আলাপ হলো? কাদেরিয়া বাহিনীর জন্য আমি কী গোপন সংবাদ নিয়ে যাচ্ছি? আমি নিশ্চুপ। একথা সেকথা বলে আমি গোপন সংবাদকে এড়িয়ে গেলাম। এই খবরটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিজয় ত্বরান্বিতকরণের এক প্রধান কৌশল। ডিসেম্বরের প্রথম দিকে ভারতীয় বাহিনীর প্যারাট্রুপস বা ছত্রিসৈন্য এসে নামবে আমাদের পরামর্শ মতো টাঙ্গাইলের কোন জায়গায়। ছত্রিসৈন্যদের সঙ্গে যোগ দিয়ে কাদেরিয়া বাহিনী, মুক্তিবাহিনী যৌথভাবে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ঘাঁটিতে আক্রমণ করবে। হয়েওছিলো তাই৷ ডিসেম্বরের ১১ তারিখ ১০ টি ভারতীয় বিমান বাহিনীর বিমান থেকে প্রায় সাড়ে চারশত প্যারাট্রুপস প্যারাসুট দিয়ে টাঙ্গাইলের মাটিতে নেমেছিল। তারপরে তো আমাদের ক্রমান্বয়ে বিজয়ের ইতিহাস।
আজ খুব মনে পড়ছে, আমার আত্মার অংশের মতো এক টুকরো ভালোবাসার ভাই-বন্ধু-সহযোদ্ধা হয়েও শহীদ ভাইয়ের কাছে সেদিনের দায়িত্বশীলতার কারণে আমি তাঁকে অরোরার সঙ্গে সাক্ষাতের গোপন তথ্য সম্পর্কে কিছুই বলিনি। দেলওয়ার, শহীদ ভাইকে আমি ভুলি কি করে!’ এই সময় ভাবি ড. জিনাত নবী এসে নবী ভাইয়ের পাশে দাঁড়ালেন। নবী ভাই জানেন কি না এই ভেবে শহীদ ভাইয়ের মৃত্যুর খবরটি তাঁকে বললেন৷ নবী ভাই আবার কান্না জড়িতভাবে একটি শব্দ বললেন- ‘শহীদ ভাই!’