এবিএম সালেহ উদ্দীন, লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক।
বাংলা সাহিত্যের প্রাণ পুরুষ আহমদ ছফার জন্ম ১৯৪৩ সালের ৩০শে জুন । চট্টগ্রামের হাসিমপুরের গাছবাড়িয়া গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবার থেকে বেড়ে আহমদ ছফার মাঝে শিশুকালেই মেধা ও প্রতিভার দিকটি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।প্রাইমারিতে পড়ার সময়ে রামচন্দ্রকে নিয়ে একটি পদ্য রচনার মধ্যদিয়ে তিনি স্কুলের শিক্ষক ও ছাত্রমহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।পুত্রের এই কৃতিত্বে বাবা হেদায়েত আলী (ধনমিয়া)’র নির্দেশে জুমার নামাজের পর মসজিদের মুসল্লির সামনে পাঠ করতে হয়েছিল।উদ্দেশ্য,সকল গুরুজনের দোয়া ও শুভাশীষ।ছোটবেলা থেকেই তাঁর ভেতর মেধা ও মনন চিন্তার একটা বিস্ময়কর প্রতিভার পরিলক্ষিত হয়।
পরবর্তীতে হাইস্কুলে পড়ার সময় তিনি বাম রাজনীতির ছাত্র সংগঠনের সংগে যুক্ত হয়ে যান । অন্যতম কারণ হল,সমাজের নানা রকম অন্যায়,অনাচার ও অসঙ্গতি দেখতে দেখতে স্কুল জীবন থেকেই আহমদ ছফার চিন্তা ও দর্শনে এই পরিবর্তন আসে।তাঁর যুক্তি ছিল কোন প্রতিকার এককভাবে করা যায় না। এজন্যে সংঘবদ্ধ শক্তির ভূমিকার প্রয়োজন। সেই জন্য সংগঠেন যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে মানুষকে যাবতীয় কুসংস্কার থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করেছেন । সর্বদা তাঁর আকুতি ছিল,সামাজিকভাবে মানুষকে শিক্ষিত ও আত্মনির্ভর হিসাবে গড়ে তোলা । মনের একান্ত বাসনায় মানুষের মুক্তি ও অধিকারের সমব্যবহার।তিনি সামাজিক অবক্ষয় ও রাজনৈতিক অস্থিরতায় গণমানুষের দুর্ভোগে খুব কষ্ট পেতেন।ফলে,ঐসব কষ্টবোধ ও সংক্ষুব্ধতায় তাঁর সাহিত্যকর্মে এক ধরণের প্রতিবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটে।আমাদের সমাজের মানবতা বিবর্জিত কুসংস্কার আর অনাচারবৃত্তির ঔদ্ধত্য আস্ফালনের জবাব মেলে আহমদ ছফার লিখনীতে। অসাধারণ মেধা ও মননের ছাপ তাঁর প্রতিটি প্রবন্ধ ও গল্প উপন্যাসের পরতে পরতে। সাহিত্যের পরমতম প্রাসঙ্গিক উপাদানে ভরপুর তাঁর লেখায়।তাঁর কয়েকটি কবিতার বইও আছে যার অনেকগুলো কবিতা কালজয়ী।এছাড়া বেশ কিছু চিরন্তন গানও আছে তাঁর।প্রবন্ধ নিবন্ধ,গল্প,উপন্যাস এবং উপলক্ষ্যের লেখাগুলো পাঠককে নাড়া দেয়, শিহরিত করে।পাঠককে কাঁদায় ও ভাবতে শেখায়।আমাদের চলমান সমাজ ও রাষ্ট্রপুন্জকে নাড়া দিয়ে যায়।
বাংলা সাহিত্যের আকাশে আহমদ ছফার আবির্ভাব অনেকটা ধ্রুবতারার মতো। সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় তাঁর আশ্চর্য জনক বিচরণ ছিল। তাঁর মনন ক্ষমতা এতই ঈর্ষনীয় যে, অনেকটা বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম জীবনধারার সাথে কিছুটা তুলনা করা যায়।নজরুলের অপ্রতিরোদ্ধ সাহসী চেতনার মতো আহমদ ছফা সবসময় রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন ও সমাজে চেপে থাকা কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন।অসঙ্গতির বিরুদ্ধে কথা বলেছেন , লিখেছেন এবং মাঠ পর্যায়ে কাজ করেছেন।
তেমনই সাহিত্য দর্শনেও তার সৃজন ও মননের শক্তিময়তা পরিলক্ষিত । কখনো কোন একপেশে মতবাদে তিনি বিশ্বাস করতেননা।এই ক্ষেত্রে তিনি সমাজের সুবিধাবাদী বুদ্ধিজীবীকেও পরোওয়া করেননি।সাহিত্যাদর্শে যেকোন অসংলগ্ন প্রশ্নে নিজের লেখায় রবীন্দ্রনাথ এবং বঙ্কিমচন্দ্রকেও ছাড় দেননি।ব্যক্তিগতভাবে কবিগুরুর প্রতি তাঁর অগাধ ভক্তি ছিল। কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে সর্বব্যাপী সব মানুষের কথা বলতে ও লিখতে কিংবা সব মানুষের মূল্যায়নে ঘাটতি পরিলক্ষিত হওয়ায় কতিপয় মৌলিক প্রশ্নে আহমদ ছফা আপোষ করেননি ।এ প্রসঙ্গে “জীবিত থাকলে রবীন্দ্রনাথকেই জিজ্ঞেস করতাম” শিরোনামে একটি কালজয়ী প্রবন্ধে স্পষ্টত: তাঁর প্রতিবাদী চেতনা, সংক্ষুব্ধতা ও সাহসের দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় যা রীতিমত বিস্ময়ের ব্যাপার । এখানে তিনি স্পষ্টভাবে রবীন্দ্রনাথ কে উদ্দেশ্য করে লিখেন—“গোত্রের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ ছিলেন আমার জীবনের মহত্তম মানুষ । জীবনের সমস্ত রকম সমস্যা সংকটে আমি তার রচনা থেকে অনুপ্রেরণা সন্চয় করতে চেষ্টা করেছি। আমার বোধবুদ্ধি যখন একটু সেয়ানা হয়ে উঠল,একটা প্রশ্ন নিজের মধ্যেই জন্ম নিল। আমি মুসলমান চাষা সম্প্রদায় থেকে আগত একজন মানুষ।রবীন্দ্রনাথ আমাদের নিয়ে কিছু লিখেন নি কেন? এ প্রশ্নটা মনের মাঝে জাগলেও প্রকাশ্যে উচ্চারণ করতে সাহস করিনি।আমাদের গোঁড়া মুসলমানেরা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে যে সকল অপপ্রচার করে থাকে,আমার প্রশ্নটিকে তাদের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলে আমাকে রবীন্দ্র-বিরোধীদের সঙ্গে এককাতারে দাঁড় করার ভয়ে অনেকদিন চুপচাপ ছিলাম। এখন আমার একটি উপলব্ধি এসেছে যে, যেভাবে ইচ্ছে গ্রহন করুক ,আমার মন যেভাবে বলছে আমি প্রশ্নটা সেভাবে উচ্চারণ করব । এখানকার রবীন্দ্রভক্তরা হয়তো রুষ্ঠ হবেন।তবে আমি নিশ্চিত রবীন্দ্রনাথের রূহ মোবারক আমার প্রশ্নে কষ্ট পাবেনা । রবীন্দ্রনাথের অনুভূতি অত্যন্ত সূক্ষ্ম। তিনি ফুলের গন্ধ, পাখির গান, এমনকি গোধূলির আলোর কাছেও নিজেকে ঋণী ভাবতেন। সম্প্রতি ‘ফায়ার অব বেঙ্গল’শীর্ষক এক হাঙ্গেরিয়ান মহিলার একটি চমৎকার উপন্যাস আমি পেয়েছি। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লেখা। ঐ উপন্যাসের চরিত্রের একটি উক্তি ‘রবীন্দ্রনাথ যখন ধ্যানে বসতেন ঘাসের অঙ্কুর গজানোর শব্দও তিনি শুনতে পেতেন’।
আমার প্রশ্নে আসি। অত্যন্ত সহজও সরল প্রশ্ন। কোনো ঘোরপ্যাঁচ নেই । রবীন্দ্রনাথ তাঁর মুসলমান প্রজাদের নিয়ে একটা পূর্ণাঙ্গ গল্প কিংবা উপন্যাস কেন লিখলেন না? এই মুসলমান প্রজারাই তো রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথের পূর্বের ঠাকুর জমিদারদের অন্নসংস্থান করত । এই মুসলমান প্রজাদের জীবনের সমস্যা-সংকট সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ যত বেশি জানতেন,গোটা ভারতবর্ষে সেরকম আর একজন মানুষও ছিলেন কিনা সন্দেহ”।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের উপর আহমদ ছফার শ্রদ্ধাবোধ ও ভক্তির নিদর্শন বিষয়ে সর্বদাই ছফাভাই ছিলেন গুরুত্বশীল।তিনি ১৯৬৭ সালের দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে রবীন্দ্রনাথের উপর একটি প্রবন্ধ সংকলন বের করেছিলেন।যার সম্পাদকীয় লিখেছেন ড, আনিসুজ্জামান এবং বাংলাবাজারের স্টুডেন্ড ওয়েজ থেকে বই আকারে প্রকাশিত হয়। রবীন্দ্রনাথের প্রতি তাঁর অকুন্ঠ শ্রদ্ধাবোধ ছিল আকাশ সমান।তবু সাহিত্যের অসঙ্গতির উপর তিনি তাঁর আক্ষেপ,দু:খবোধ ও কষ্টের কথা প্রকাশ করতে দ্বিধা করেননি।
তেমনই “শতবর্ষের ফেরারি:বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়”নামে সুদীর্ঘ প্রবন্ধ পুস্তক লিখেও বঙ্কিমের উপন্যাসে মুসলমান বিদ্বেষী লেখার কঠোর সমালোচনা করেছেন।যা নিয়ে বঙ্কিমপন্থিরা ঢাকা ও কলকাতায় সমালোচনা করার চেষ্টা করেছেন।তাছাড়া জীবনের শেষ প্রান্তে এসে ‘উত্থানপর্ব’ নামে সমৃদ্ধ সাহিত্য পত্রিকার মাধ্যমে সমাজের বৈষম্য ও রাষ্ট্রীয় অনাচারের বিরুদ্ধে ক্ষুরধার কলাম চালিয়েছেন।স্বাধীনতার পর অন্যান্য কবি- সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে আহমদ ছফা স্বাধীন দেশের আলো ও বাতাসের স্নিগ্ধ পরশের দোলায় দোলতে দোলতে মুক্তহাতে লেখা-লেখি শুরু করলেন।কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রব্যবস্থাপনায় মানবতাহীন বৈষম্য স্পষ্ট হয়ে উঠল।একশ্রেণীর উগ্র বখাটে আনাড়ি রাজনীতির নেতা কর্মীদের দ্বারা ঢাকা শহরসহ অন্যান্য শহরগুলোতে অবাঙালি ব্যবসায়ীদের ধন-সম্পদের সাথে মুক্তিযুদ্ধের সময় পালিয়ে যাওয়া সংখ্যালঘু হিন্দুদের সম্পতিগুলো সরকারীদলের লোকের দখলে চলে যেতে শুরু করল ,আহমদ ছফা প্রতিবাদ করলেন। তিনি কলাম লিখতে শুরু করলেন।এছাড়া ব্যাপক লুটতরাজ , রক্ষীবাহিনীর অত্যাচারের বিরুদ্ধেও কলাম লিখলেন।এই সময় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল হলে থাকতেন।চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের কল্যাণে লিখতে শুরু করলেন এবং আওয়ামী লীগ বাদ দিয়ে বাকশাল প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে সরকারি নীতির কঠোর সমালোচনা করেন ।কিন্তু তিনি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কখনো সমালোচনা করেননি।স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি হিসাবে বঙ্গবন্ধুর প্রতিও ছিল তাঁর আকাশ পরিমান শ্রদ্ধাবোধ।তিনি কখনো বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কোন কুটুক্তি করেছেন বলে আমার জানা নেই।এই সব স্পর্শকাতর বিষয়ে তাঁর বিরুদ্ধে কারো কারো সমালোচনা ও বক্রোক্তিকে তিনি কখনো আমলদেননি।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও বুদ্ধিদীবীরা যেন বাকশালের খাতায় স্বাক্ষর না দেন,সেজন্যে লিখেন এবং ঘরে ঘরে গিয়ে নিষেধ করেন।এক পর্যায়ে সরকার দলীয় ক্যাডারদের দ্বারা বাধা ও তাঁকে প্রাণনাশের হুমকি দেয়া হয়।এই সময় অধ্যাপক কবির চৌধুরী ও ড, আনিসুজ্জমান , ড, আহমদ শরীফসহ কয়েকজন বুদ্ধিজীবীর কথায় ছফাভাই কুমিল্লার পল্লী উন্নয়ন একাডেমি বার্ডএ যোগদান করেন।এখানে নিরিবিলি পরিবেশে ফাউস্ট অধ্যয়ন ও অনুবাদ শুরু করেন।
প্রসঙ্গত: বলা যায় যে , আহমদ ছফার মেধা ও মননের তীক্ষ্নতার কারণেই বোধহয় এমএ পাশ করার পূর্বেই অধ্যাপক কবির চৌধুরী(বাংলা একাডেমির তৎকালীন পরিচালক)-এর মাধ্যমে নিয়ম ও প্রটোকলের বাইরে তাঁকে বাংলা একাডেমিতে তিন বছরের জন্য(পিএইচডি)ফেলোশিপ প্রোগ্রামের জন্য মনোনীত হন।ছফাভাই তাঁর প্রতি কবির চৌধুরী স্যারের অসামান্য অবদানের কথা একদিন আমাদের এক ঘরোয়া আসরে গল্পের ছলে বলে ফেলেছিলেন।
তখন থেকে অথবা তারও আগে আহমদ ছফার কিছু লেখা নিয়ে ঢাকা ও কলকাতার সাহিত্যাঙ্গনে তুমুল আলোড়ন ও হৈচৈ শুরু হয়ে যায়।আহমদ ছফার উপর আঠারো শতকের ইয়ং বেঙ্গল প্রতিষ্ঠাতা ক্ষণজন্মা কবি ও বুদ্ধিজীবী হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও-এর প্রভাব ছিল।যিনি তৎকালীন সময়ে সমাজের চেপে থাকা মানববিদ্বেষী কুসংস্কার, যেমন সতীদাহসহ এধরণের ভয়ংকর কি প্রথার মূলৎপাটনের পক্ষ্যে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন।ডিরোজিও’র সেই আন্দোলন ভারতবর্ষে ক্ষীপ্রতর ও জোরদার হয়েছিল । আহমদ ছফার মাঝেও সেরকম একটা উজ্জ্বল চেতনার নিদর্শন দেখা যায়।চিন্তা ও দর্শনে সামাজিক ও কুট রাজনীতির অবক্ষয় মুক্ত সুশীল সমাজের নবজাগরণের পথে তিনি ছিলেন সক্রিয় সৈনিক।তাঁর মাঝে ব্যক্তিগত স্বার্থপরতা ও হীনমন্যতা ছিলনা।আমাদের সময়ের নিজস্ব চাহিদা কিংবা কোন লোভনীয় চাতুর্যের ফাঁদে পা দিতে অনেক বিদ্যজনকেও দেখা যায়।কিন্তু আহমদ ছফা ছিলেন তার সম্পূর্ণ উল্টো।কোন লোভ ও স্পর্শকাতর স্বার্থপরতায় তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি।
সাধারণত: মানুষের স্বভাব যেমন থাকে; সেসব উৎড়িয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন অন্যরকম চরিত্রের একজন মনুষ্যত্ববোধের পূর্ণায়ত মানুষ।আচার-ব্যবহার,চাল-চলন ও স্বভাব চরিত্রের মধ্যে অনেকটা নজরুল ,নীটসে,ডিরোজিও কিংবা ইয়েটস এর প্রভাব পরিলক্ষিত।চিন্তা চেতনায় প্রকৃতি ও প্রাণীকুলের প্রতি গভীর গুরুত্বশীল এবং সর্বোপরি মানবীয় গুণাবলীর একজন রোমান্টিক মানুষ।যেকোন হীনমন্যতা স্বার্থপরতার উর্দ্ধে অন্যরকম চৈতন্য ছিল তাঁর মাঝে।তিনি ছিলেন স্বার্থবিরোধী বিত্তবৈভবের প্রতি ঔদাসিন্ন্যময় একজন সাদামাটা মানুষ।মানুষের কল্যাণ চিন্তাই ছিল তাঁর জীবনের অন্যতম আদর্শ।চিন্তা চেতনায় আপাদমস্তক একজন খাঁটি বাঙালি।
তাঁর রচিত উপন্যাসের মধ্যে ‘পুষ্প ,বৃক্ষ এবং বিহঙ্গপুরাণ, ‘গাভী বৃত্তান্ত’ , ‘অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী’ ”আলাতচক্র’, ‘সূর্য তুমি সাথী’ ,’অঙ্কার’, ‘একজন আলী কেনানের উত্থান-পতন’,এবং ‘মরণবিলাস’ । কাব্যগ্রন্থের মধ্যে ‘জল্লাদ সময়’, ‘লেনিন ঘুমোবে এবার,’বস্তি উজাড়,’দু:খের দিনের দোহা,’একটি প্রবীন বটের কাছে প্রার্থনা ও ‘আহমদছফার কবিতা(কাব্য সমগ্র) বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সম্পদ ।এছাড়া অনুবাদ গ্রন্থ ‘ফাউস্ট’,ভ্রমন কাহিনী ‘Prospective Germany ‘,গল্পগ্রন্থ ‘নিহত নক্ষত্র’, ‘দোলা আমার কনকচাঁপা(ছোটদের),প্রবন্ধের বইয়ের মধ্যে ‘জাগ্রত বাংলাদেশ’,’বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’,বাংলাভাষা:রাজনীতির আলোকে’,’বাংলাদেশের রাজনৈতিক জটিলতা’,’বাঙালি মুসলমানের মন’,শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য প্রবন্ধ,’ আহমদ ছফার নির্বাচিত প্রবন্ধ’, ‘রাজনীতির লেখা’, ‘আনুপূর্বিক তসলিমা ও অন্যান্য স্পর্শকাতর প্রসঙ্গ ,’নিকট ও দূরের প্রসঙ্গ ‘,’সাম্প্রতিক বিবেচনা:বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’,’শতবর্ষের ফেরারি: বঙ্কিমচন্দ্র চট্টপাধ্যায়’, ‘শান্তিচুক্তি ও নির্বাচিত নিবন্ধ ‘, ‘আহমদ ছফার প্রবন্ধ’,’রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক প্রবন্ধ’,’বাঙালি জাতি ও বাংলাদেশ রাষ্ট্র ‘,আমার কথা ও অন্যান্য প্রবন্ধ’,’উপলক্ষ্যের লেখা’এবং ‘সংকটের নানান চেহারা’ । জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাককে নিয়ে স্মৃতিধর্মী বই’যদ্যপি আমার গুরু।এছাড়া ‘সিপাহী যুদ্ধের ইতিহাস’ গ্রন্থ এবং আহমদ ছফার বেশ কিছু সাক্ষাৎকার নিয়ে একটি বড় সংকলনও প্রকাশিত হয়েছে ।বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে এবং মহান মুক্তিযোদ্ধসহ দেশের জনজীবনের দুর্ভোগ ,রাজনৈতিক ,সামাজিক অস্থিরতা ও রাষ্ট্রীয় অনাচারবৃত্তির প্রতিবাদ সংবাদপত্রে তাঁর সমকালীন লেখাগুলো ছিল একেকটা তীরের মতো।ঢাকার দৈনিক গণকণ্ঠের প্রধান সম্পাদক থাকাকালীন সময়ে বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস নামে ধারাবাহিক কলামের মধ্যদিয়ে তাঁর মেধা,মনন ও সৃজনে তীক্ষ্ন বুদ্ধিমতার উজ্জ্বলতর দিকটি প্রকাশ পায় ।লেখক সাহিত্যিকদের প্রতি ছিল অগাধ ভালোবাসা।তাদের স্বার্থে তিনি সর্বদা ছিলেন উদার । বিশেষ করে নবীন ও তরুণ কবি সাহিত্যিকদের ভালো লেখা প্রকাশ করবার জন্য তিনি সব সময় প্রেরণা দিতেন।তিনি নিজের অর্থে অনেক তরুণ মেধাবী লেখকদের বই প্রকাশের ব্যবস্থা করেন।নন্দিত কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ-এর প্রথম উপন্যাস প্রথম বই’নন্দিত নরকে’ আহমদ ছফার উদ্যোগে প্রকাশের ব্যবস্থা করেন।তেমনই রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ’র প্রথম কবিতার বই ‘উপদ্রুত উপকুল’ছফা ভাই’র খরচে প্রকাশিত হয়। অকাল প্রয়াত তরুণ ছড়াকার বাপ্পী শাহরিয়ারসহ অনেকের বই প্রকাশ করেন । তাদেরকে সাহিত্য জগতে পরিচিত করেন ।আহমদ ছফা লেখক সাহিত্যিকদের স্বার্থে তাদেরকে একটি প্লাটফর্মে নিয়ে আসার প্রত্যয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম লেখক শিবির প্রতিষ্ঠা করেন। কবি-সাহিত্যিকদের তিনি এতই পছন্দ করতেন যে, একই সময় তিনি সাহিত্যের শুরু করেন এবং আড্ডাগুলো জমে উঠেছিল।ড, আহমদ শরীফ , রনেশ দাশগুপ্ত ,কাজী সিরাজ,মুহম্মদ নুরুল হুদা,সরদার ফজলুল করিম,আবদুল মান্নান সৈয়দ,সন্তোষ গুপ্ত,আবদুল হালিম,সৈয়দ আকরম হোসেনসহ অনেকেই সাহিত্য আসরে যোগ দিতেন । এছাড়া মাঝে মাঝে কবি শামসুর রাহমান ঐসব সাহিত্য আড্ডায় যোগ দিতেন ।বাংলা সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় আহমদ ছফার বিচরণ ও মননের ছাপ আছে।মেধা ও সৃজনের প্রকাশ আছে।তাঁর চিন্তা ,দর্শন ও সাহিত্যার্শের প্রতিটি দিক উজ্জ্বল হয়ে থাকবে ।সাহিত্যাদর্শের ঔজ্জ্বল্যেই তিনি অমর।অনির্বাণ ।।
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক।
(২৮ জুলাই আহমদ ছফার মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে প্রকাশিত) ।