বাংলাদেশের পথশিশুদের জন্য নির্ভরযোগ্য এক ভালবাসার বিশ্ব
জাহাঙ্গীর নাকির:বাংলাদেশের বড় শহরগুলোর বস্তি, পার্ক, ফুটপাত, বাস টার্মিনাল, রেল স্টেশন এবং লঞ্চ ঘাটসমূহে ছিনড়বমূল মানুষের বসবাস। এদেরই একটি বিরাট অংশ হলো পথশিশু। অবহেলা আর বঞ্চনার মাঝে ওরা ফুটপাথে বেড়ে উঠে। এই পথশিশু এখন আমাদের দেশের একটি বড় সামাজিক সমস্যা। এদের সংখ্যা প্রতিনিয়তই বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে এদের সংখ্যা প্রায় ১৩ লক্ষ।
জাতীয় শিশু নীতি ২০১১ এর ৬.২.৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে “পথশিশু সহ সকল দরিদ্র শিশুর পূনর্বাসন ও যথাযথ বিকাশ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সামাজিক নিরাপত্তা বলয় স¤প্রসারিত করতে হবে”। খান বাহাদুর আহ্ছানউল্ল্যা (র:) স্রষ্টার এবাদত সৃষ্টির সেবা মূলনীতির আলোকে সরকারের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন সুবিধাবঞ্চিত পথশিশুদের পুনর্বাসনের লক্ষে পঞ্চগড় জেলার হাফিজাবাদ ইউনিয়নের জলাপাড়া গ্রামে কেএনএইচ জার্মানীর সহায়তায় ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠা করে আহ্ছানিয়া মিশন শিশু নগরী।
এইসব শিশুদের যাদের বয়স ৬-৮ বছর তাদেরকে দেশের বিভিনড়ব এলাকা থেকে সংগ্রহ করে শিশু নগরীতে নিয়ে এসে তাদের কে শারীরিক, মানসিক ও নৈতিক বিকাশ, মানসম্মত শিক্ষা, ভরন-পোষন এবং স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলা হচ্ছে। বর্তমানে এখানে রয়েছে প্রায় ২৫০ জন সুবিধাবঞ্চিত শিশু। প্রতিটি শিশু ১৮ বছর পর্যন্ত এই শিশু নগরীতে থাকবে।
শিশু নগরীতে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তা; তাদের জন্মগত সামর্থ ও মেধার বিকাশের জন্য শিক্ষা ও কারিগরি প্রশিক্ষণ; সুষম খাদ্য, নিরাপদ আবাসন, পোষাক-পরিচ্ছেদ, মনোসামাজিক সহায়তা ও স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক শিক্ষাসহ দক্ষ জনশক্তি হিসাবে গড়ে তোলার জন্য বৃত্তিমূলক কারিগরি প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়ে থাকে। এছাড়াও শিশুদের মনোভাব ও আচরন পরিবর্তন, নৈতিক মূল্যবোধ সৃষ্টি, জীবনধারার ইতিবাচক পরিবর্তন এবং দায়িত্ববান সুনাগরিক হিসাবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিভিনড়ব অনানুষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যবস্থা বিদ্যমান। আর প্রতিটি শিশুর সামর্থ্য বিবেচনায় রেখে তাদের এমনভাবে প্রশিক্ষিত করে গড়ে তোলা হবে যাতে প্রতিটি শিশু তার পরিপূর্ণ মেধার বিকাশ ঘটাতে সক্ষম হবে এবং যাতে শিশুরা সমাজ ও জাতীয় জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। সেইসাথে প্রতিটি শিশুকে উপযুক্ত করে তার পরিবার কিংবা সমাজে পুন: একত্রীকরণ করা হবে।
আহ্ছানিয়া মিশন শিশু নগরীতে এরা নিরাপদ আবাসন; আধুনিক ও কারিগরি শিক্ষাসহ সকল ধর্মের চর্চা; ইনডোর ও আউটডোর গেইম; গান, নাচ, অভিনয়, আবৃতি; ছবি আঁকা, ক্রীড়া ও সৃজনশীল কাজের উচ্চতর প্রশিক্ষণ পাবে; বই পড়া; উচ্চতর শিক্ষা; শিক্ষামূলক বিনোদন; বিভিনড়ব প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের সুযোগ দিয়ে ভবিষ্যত কর্মসংস্থানের সুযোগ পাবে।
শিশুদের সার্বিক তত্ত্বাবধানের জন্য রয়েছে আবাসিক কর্মী, শিক্ষক, ক্রীড়া ও মিউজিক্যাল শিক্ষক এবং মনোসামাজিক সহায়তার জন্য ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ও নিয়মিত স্বাস্থ্য পরিচর্চ্যার জন্য প্যারামেডিক ও প্রশিক্ষিত মেডিক্যাল অফিসার। এদের কে হাতে-কলমে নিয়মিত কৃষিকাজ, হাঁস-মুরগী ও গরু ছাগল পালন করার বিষয়ে শিক্ষা দেয়া হয়।
ট্যালেন্ট হান্ট হল শিশুনগরীর শিশুদের মধ্য থেকে বিশেষ বিশেষ বিষয়ে প্রতিভাবান শিশু খুঁজে বের করা। প্রত্যেক শিশুর মধ্যে সুপ্ত অবস্থায় অল্প বিস্তর কোন না কোন প্রতিভা থেকে থাকে। উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি ও বিভিনড়ব প্রকার সহায়তার মাধ্যমে উক্ত সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটানো সম্ভব। নেতৃত্ব বিকাশের লক্ষ্যে তাদের পিয়ার এডুকেটর ও জীবনদক্ষতামূলক প্রশিক্ষণ দেয়া হয় নিয়মিতভাবে। প্রতিমাসের নির্দিষ্ট তারিখে শিশুরা পালন করে থাকে শিশু দিবস। ঐদিন নির্বাচিত শিশুরা শিশুনগরীর সকল দায়িত্ব¡ পালন করে। শিশুদের মতপ্রকাশ নিশ্চিত করতে শিশু নগরীর ব্যবস্থাপনা কমিটিসমুহে শিশু প্রতিনিধি সμিয় অংশগ্রহণ করে। গণতান্ত্রিক চর্চার জন্য প্রতি বছর শিশুরা ৭টি পৃথক বিভাগের জন্য সরাসরি ভোট দিয়ে
শিশু কাউন্সেলর নির্বাচন করে। শিশু নগরীতে এই শিশু বিভাগগুলো হলো, পরিবেশ, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক, বৃক্ষরোপন ও বাগান তৈরি, পানিসম্পদ, স্বাস্থ্য, পুস্তক ও শিখন সামগ্রী, অভ্যর্থনা ও আপ্যায়ন কাউন্সিলর। এছাড়াও রয়েছে ক্ষুদে ডাক্তার।
শিশুদের বিনোদনের জন্য রয়েছে মিনি পার্ক। পাঠদান দেয়া হয় সম্পূর্ণ আনন্দময় পরিবেশে। প্রতিটি শিশুর ডিটেইল তথ্য সংরক্ষণ এবং ঝুঁকি নিরূপন করে তার সামর্থ্য দূর্বলতা বিশ্লেষণ করে ইন্টারভেনশন প্ল্যান তৈরি করা হয় এবং সে অনুযায়ী নিয়মিতভাবে ফলোআপ রাখা হয়। এখানকার শিশুরা মাতৃস্নেহে বড় হচ্ছে। শিশু নগরী এখন তাদের আপন ঠিকানা। শিশু এবং শিক্ষক মিলেমিশে একসাথে খেলাধূলায় অংশগ্রহণ করে প্রতিটি অনুষ্ঠানে, দৈনন্দিন বাজার, খাবার মেন্যু পছন্দ করা, ডাইনিং ও আবাসিক ব্যবস্থাপনায় শিশুরা সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়।
২০১৬ সালে প্রথমবারের মত পঞ্চগড় শিশু নগরীর ৬ জন শিশু প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ২জন শিশু সাধারণ বৃত্তি সহ শতভাগ সাফল্য অর্জন করেছে। একইধারা অব্যাহত রেখে এপর্যন্ত ৫৪ জন শিশু শতভাগ সাফল্য এনে দিয়েছে এবং ৮ জন সাধারন বৃত্তি লাভ করেছে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০১৫ সালে পথশিশু মুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। শিশু নগরী প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার বাস্তবায়নে সহায়ক ভূমিকা রাখবে। পরবর্তীতে এই শিশু নগরীর অনুরূপ মডেল সরকারী বেসরকারী ও ব্যক্তিগত অনুদানে সারাদেশের প্রতিটি জেলায় সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য গড়ে তোলা হবে পৃথকভাবে। যাতে কোন শিশুকে আর রাস্তায় মানবেতর জীবন যাপন করতে দেখা না যায়। এইসব শিশুরা তাদের মেধার সঠিক বিকাশের মাধ্যমে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিষ্ঠা পেতে পারে সে জন্য সমন্বিত আধুনিক সেবা ও প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের উপযুক্ত করে গড়ে তোলা হবে। আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। শিশুদের নাগরিক সুবিধাবঞ্চিত করে কাংখিত উনড়বয়ন সম্ভব নয়।
পথশিশুমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে অন্যান্য সমমনা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সাথে নিয়ে পথশিশুদের স্বার্থে সরকারী নীতি নির্ধারনী মহলে এডভোকেসী করা হচ্ছে। সেলক্ষ্যে ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন যুক্ত হয়েছে “স্ট্রিট চিলড্রেন একটিভিস্ট নেটওয়ার্ক” নামক সংগঠণ নেটওয়ার্কের সাথে। উদ্দেশ্য আজকের পথশিশু যারা আমাদের দেশ ও সমাজের জন্য হুমকী এইসব পথশিশুদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বলয় তৈরী করা। যেন পথশিশুরা দেশের জন্য বোঝা না হয়ে মানবসম্পদে পরিণত হয়ে জাতীয়ভাবে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে অবদান রাখতে সক্ষম হয়। জাতীয় শিশু অধিকার সনদের ২০(১) অনুচ্ছেদে এদের জন্য সুষ্পষ্টভাবে বলা আছে, “পারিবারিক পরিবেশ থেকে যে শিশু সাময়িক বা চিরতরে বঞ্চিত বা স্বার্থ রক্ষায় যে সকল শিশুর পারিবারিক পরিবেশ উপযুক্ত নয় সে সকল শিশুরাষ্ট্র থেকে বিশেষ সুরক্ষা ও সহায়তার অধিকারী।”
আহ্ছানিয়া মিশন শিশু নগরী সবাইকে সাথে নিয়ে সে লক্ষ্যেই নিরন্তর কাজ করে যাবে। আর এই কাজে সারাবিশ্বে বাংলাদেশী সামর্থ্যবানদের কাছে মানবিক সহায়তা কামনা করছি।