ওয়াশিংটন ডিসি: নতুন প্রজন্মের অঙ্গীকার স্লোগানে ‘অদম্য বাংলাদেশ-অবাক বিশ,’ ‘সবুজ জমিতে লাল বৃত্ত’ বিশেষ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশনার মধ্যদিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী এবং মুজিববর্ষকে প্রবাসেও মহিমান্বিত করার সংকল্পে ফোবানা’র সর্বস্তরে ইস্পাতদৃঢ় ঐক্যের বন্ধন ঘোষণা দেয়া হলো ৩১ আগস্ট শনিবার ’মিট দ্যা প্রেস এন্ড ফোবানা লিডার্স’ থেকে।
তিন দিনব্যাপী সম্মেলনের বিভিন্ন পর্বে থাকবে মুক্তিযোদ্ধা সম্মাননা ও সমাবেশ, বাংলাদেশের সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষে সেমিনার, বাঙালির জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জন্মশত বার্ষিকী-সমাবেশ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শততম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী এবং জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০ বছর পূর্তি উৎসব, বাংলাদেশের উন্নয়ন-অগ্রগতিতে তথ্য-প্রযুক্তির অবদান, প্রবাস প্রজন্মের সমন্বয়ে সেমিনার, নৃত্য-নাট্য এবং সঙ্গীতানুষ্ঠান। যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডার বিভিন্ন সিটি থেকে শতাধিক সংগঠন এতে অংশ নেবে বলে আয়োজকরা আশা করছেন।
৩৫তম ফোবানা সম্মেলনের হোস্ট ‘আমেরিকান বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ সোসাইটি’ (এবিএফএস)র এ অনুষ্ঠানে জড়ো হয়েছিল ফোবানার বর্তমান কমিটির শীর্ষ কর্মকর্তা ছাড়াও সাবেক বেশ কয়েকজন চেয়ারম্যান। ছিলেন হোস্ট কমিটির সর্বস্তরের কর্মকর্তারাও। উল্লেখ্য, করোনা মহামারির পরিপ্রেক্ষিতে ফোবানার আসন্ন বাংলাদেশ সম্মেলন লেবার ডে উইকেন্ড (সেপ্টেম্বরের ৩-৫) থেকে পিছিয়ে থ্যাঙ্কস গীভিং উইকেন্ডে (২৬-২৮ নভেম্বর) নেয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ফোবানার নির্বাহী কমিটির মধ্যে কিছুটা অসন্তোষ দেখা দিয়েছিল। সেই মনোভাবের শান্তিপূর্ণ পরিসমাপ্তির ব্যাপারটি দৃশ্যমান হয়েছে এই ‘মীট দ্য প্রেস’ অনুষ্ঠানে। অভূতপূর্ব এক সম্প্রীতির মধ্যে এই অনুষ্ঠানে কাঁধে কাঁধ হাতে হাত মিলিয়ে বহুজাতিক এ সমাজে বাঙালিদের ঐক্য জাগ্রত সুসংহত করার কথা বললেন সকলে। একইসাথে হোস্ট কমিটির পক্ষ থেকেও এ যাবতকালের সবচেয়ে উত্তম একটি সম্মেলন উপহার দেয়ার অভিপ্রায়ে গৃহিত কর্মসূচিরও আলোকপাত করা হয়। জানানো হয়, দেশ ও প্রবাসের গুণীজনেরা আসবেন। বিশুদ্ধ বাঙালি সংস্কৃতি পরিবেশনের মধ্যদিয়ে নতুন প্রজন্মকে মা-বাবার সংস্কৃতির প্রতি আন্তরিক আগ্রহ তৈরীর বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে বলেও বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করা হয়।
হোস্ট কমিটির আহবায়ক জি আই রাসেল এর সভাপতিত্বে সদস্য-সচিব লেখক-সাংবাদিক শিব্বীর আহমেদের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বক্তব্যকালে ফোবানার নির্বাহী চেয়ারপার্সন জাকারিয়া চৌধুরী বলেন, ৩৪ বছর আগে যেখান থেকে শুরু, সেই সিটিতেই বাংলাদেশের ঐতিহাসিক একটি মুহূর্তে ৩৫তম সম্মেলন হচ্ছে। সম্মেলনের প্রতিটি পরতে ধ্বনিত হবে বাংলাদেশের সুবর্ণ জয়ন্তী, মুজিববর্ষ। তাই এটিকে সর্বাত্মকভাবে সফল করতে হাতে হাত রেখে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সকলেই নিজ নিজ অবস্থান থেকে হোস্ট কমিটিকে সহায়তা করবেন এই কামনা করছি। যারা সম্মেলনের স্পন্সর হতে চেয়েছেন, আইকন হয়েছেন এবং নানাভাবে সহযোগিতার অঙ্গিকার করেছেন-তারাও যেন তা অবিলম্বে পূরণ করে হোস্ট কমিটির কাজের গতি ত্বরান্বিত করেন। জাকারিয়া আরো বলেন, ফোবানা সম্মেলনকে প্রবাসীদের মহামিলনমেলা হিসেবে অভিহিত করা হয়। সে কারণে আমরা কাউকে মাইনাসে বিশ্বাসী নই। সকলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে বিভিন্ন পর্যায়ে সংলাপ অব্যাহত রয়েছে। অনানুষ্ঠানিক বৈঠকও করেছি। সুতরাং থ্যাঙ্কসগীভিং উইকেন্ডের ফোবানার সাথে সকলেই সপরিবারে একিভূত হবেন এবং ফোবানার মূলচেতনা এগিয়ে নিতে আন্তরিক অর্থে সকলে সোচ্চার হবেন এ আশা করছি।
সাবেক চেয়ারম্যান ও বীর মুক্তিযোদ্ধা, একুশে পদকপ্রাপ্ত লেখক নূরন্নবী বলেন, করোনার ভীতি সত্বেও স্বল্প সময়ের নোটিশে এই অনুষ্ঠানে এসেছি শুধুমাত্র সকলকে দেখানোর জন্যে যে, আমরা ঐক্যবদ্ধ এবং আসন্ন ফোবানা সম্মেলনকে সার্থক করতে বদ্ধ পরিকর।
ফোবানার নির্বাহী সচিব মাসুদ রব চৌধুরী বলেন, করোনা ভীতির মধ্যে অনেকেই স্বাচ্ছন্দে চলাফেরায় মনোনিবেশ করিনি। এতদসত্বেও ক্যালিফোর্নিয়া থেকে বিভিন্ন পথ ঘুরে উড়ে এসেছি এই অনুষ্ঠানে। কারণ হচ্ছে আমরা ফোবানাকে ভালবাসী, সবাই এক পরিবারের সদস্য ভাবি। আসন্ন সম্মেলনকেও এযাবতকালের সেরা সম্মেলন করতে আসুন সকলে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করি।
দেড় দশকেরও অধিক সময় যাবত প্রধান নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব চালিয়ে আসা ফোবানার সাবেক চেয়ারম্যান মাহবুব রেজা রহিম বলেন, যে প্রত্যাশায় ফোবানার যাত্রা শুরু হয়েছে, তারই পরিপূরক বিভিন্ন কর্মসূচি দেখছি এই সম্মেলনে। ‘অদম্য বাংলাদেশ-অবাক পৃথিবী’ এবং ‘সবুজ জমিতে লাল নৃত্য’ দেখে নতুন প্রজন্ম আমাদের সংস্কৃতি ধারণ ও লালনে উৎসাহিত হবে-এটা বলা যায় নির্দ্বিধায়।
সাবেক চেয়ারম্যান বেদারুল ইসলাম বাবলা বলেন, আমাদের সংস্কৃতি কিন্তু অনেক সমৃদ্ধ। তাই দীর্ঘ ৩৪ বছর থেকেই চেষ্টা করছি আমাদের বাঙালি সাহিত্য, সংস্কৃতি, কৃষ্টি নতুন প্রজন্মেরর চিন্তা-চেতনা-ভাবনা-মননে প্রবাহিত এবং প্রতিস্থাপিত করতে। সে আলোকেই আসন্ন সম্মেলনে নানা কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে। এগুলোকে সাফল্যমন্ডিত করতে আমাদের মধ্যেকার টিমওয়ার্ক আরো জোরদার করতে হবে। সে অঙ্গিকারই করে গেলাম।
ফোবানার সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলমগীর বলেন, ঐক্যবদ্ধ সম্মেলনের স্বার্থে সকলকেই কিছু না কিছু ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। সে মনোভাব থাকলেই ৩৫তম সম্মেলন সুন্দরভাবে অনুষ্ঠান করা সম্ভব। এক্ষেত্রে মিডিয়াসমূহকেও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা অব্যাহত রাখার পরামর্শ দিয়েছেন মোহাম্মদ আলমগীর।
ফোবানার নির্বাহী সদস্য গোলাম ফারুক ভূইয়া বলেন, এ আয়োজনে হোস্ট কমিটির আতিথেয়তায় আমরা গর্বিত, অভিভূত এবং অত্যন্ত আনন্দিত। এ থেকেই আমরা অনুমান করতে পারছি যে, ৩৫ তম সম্মেলনকে প্রবাসীদের মহামিলনমেলায় পরিণত করতে কতটা আন্তরিক ওয়াশিংটন মেট্রো এলাকার প্রবাসীরা।
ফোবানার সাবেক চেয়ারম্যান জসীমউদ্দিন, চেয়ারম্যান নাহিদ চৌধুরী মামুন, সদস্য ডা. মোহাম্মদ আলী, ভাইস প্রেসিডেন্ট ড. আহসান চৌধুরী হীরো, কোষাধ্যক্ষ নাহিদুল এইচ খান, আউস্ট্যান্ডিং মেম্বার সাদেক খান, সদস্য মাহবুবুর ভুঁইয়া ও দৃঢ় অঙ্গিকার ব্যক্ত করেন সর্বাত্মকভাবে সহায়তার।
হোস্ট কমিটির প্রেসিডেন্ট ইনারা ইসলাম বলেন, ২০১৯ সালে নিউইয়র্ক সম্মেলনে ভোটের মাধ্যমে আমরা হোস্ট নির্বাচিত হয়েছি। এরপর বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের সময়েই করোনা মহামারির কবলে পড়েছি। পুরো একটি বছর ভীতির মধ্যে নিপতিত থাকায় কোন কাজই করা সম্ভব হয়নি। আর্থিকভাবে গোটা কমিউনিটি ক্ষত-বিক্ষত হওয়ায় সম্মেলনের বিশাল বাজেটের ধারে কাছেও যেতে পারিনি। করোনা থেকে জেগে উঠার প্রত্যয়েই আমরা সকলে এখন মাঠে নেমেছি।
ইনারা ইসলাম বলেন, মহামারি থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে আমরা কাজ করছি। আশা করছি সকলের সহায়তা অব্যাহত থাকবে। তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেন যে, ওয়াশিংটন মেট্রো এলাকার প্রতিষ্ঠিত এবং পরিচিত সকল সংগঠনই তাদের এই সম্মেলনের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে। তাই অনৈক্যের কোন প্রশ্নই উঠে না।
হোস্ট কমিটির কনভেনর জি আই রাসেল বলেন, এর আগে আরো দুটি সম্মেলন করেছি। সে অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করেই এবারের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছি। কারন, ‘গ্যালর্ড রিসোর্ট এ্যান্ড ন্যাশনাল কনভেনশন সেন্টারের ভাড়া বাবদ অনেক অর্থ লাগবে। কমিউনিটির সকলের আন্তরিক সহযোগিতা অব্যাহত থাকলে আগের মত এই সম্মেলনকেও সাফল্যমন্ডিত করতে সক্ষম হবো। তিনি বলেন, বাংলাদেশের বিভিন্ন সেক্টরের খ্যাতনামা ব্যক্তিদেরকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। অনেকেই ভিসা পেয়েছেন। পরিবর্তিত তারিখের মধ্যে অন্যেরাও ভিসা পেয়ে যাবেন বলে আশা করছি।
অনুষ্ঠানের মধ্যেই বেশ কটি চেক গ্রহণ করে হোস্ট কমিটির কোষাধ্যক্ষ ড. ফাইজুল ইসলাম বলেন, সকলের চিত্ত উদার থাকলে কোন ভালো উদ্যোগই থমকে যায় না। এই ফোবানাও থামবে না। তিনি সকলের আন্তরিক সহযোগিতা অব্যাহত থাকার কামনায় বিশেষ মোনাজাতে মিলিত হন।
সম্মেলনের আইকন জেবা রাসেল, কবীর পাটোয়ারি এবং পারভিন পাটোয়ারি দম্পতি ছিলেন বেশ তৎপর। তারা নানাভাবে সকলকে উজ্জীবিত রাখেন গৃহিত কর্মসূচিকে চমৎকারভাবে এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে। সমবেত সকলের জন্যে তারা বাসা থেকে নানা ধরনের খাবারও এনেছিলেন।
মীট দ্য প্রেসে জড়ো হওয়া ফোবানার নেতৃবৃন্দ এবং মিডিয়া ব্যক্তিত্বদের ফুলেল শুভেচ্ছা জানান হোস্ট সংগঠনের কর্মকর্তারা। আর এভাবেই ভার্জিনিয়ার ম্যানাসাসে উইনধ্যাম গার্ডেনের বলরুম বাঙালিদের উচ্ছ্বল পদচারনায় মুখরিত হয়েছিল।
আয়োজকরা জানান, সম্মেলনে আগতদেরকেও প্রাণের সাথে প্রাণ মিলিয়ে অভ্যর্থনা জানানো হবে। এ সময় সম্মেলনের প্রস্তুতি আলোকে আরো বক্তব্য রাখেন জীবক বড়ুয়া, হিরণ চৌধুরী, মিজানুর রহমান, দেওয়ান আরশাদ আলী বিজয়, আকতার হোসেন, মোহাম্মদ মিয়া, রেদওয়ান চৌধুরী, রোকেয়া হাসী, নাজিয়া জাহান, তুহিন ইসলাম, আবু সরকার, হাসনাত সানি, দেওয়ান জমীর পলাশ, শিরিন আকতার, সেলিম ইব্রাহিম, জেবা রাসেল, পারভিন পাটোয়ারী, মাইনুদ্দিন দুলাল প্রমুখ।
সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর পর্বের আগে ফোবানার গান ’বন্ধন-দ্য ব্রীজ’র অবমুক্ত করেন একুশে পদকপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা ড. নূরন্নবীসহ কর্মকর্তারা। এটি লিখেছেন সদস্য-সচিব শিব্বীর আহমেদ এবং সুর দেন ইমতিয়াজ মজুমদার বিবেক। গানে কন্ঠ দিয়েছেন এই প্রজন্মেও শিল্পী ফাগুন, হৃদয়, তুহিন ও ইরফানা। উল্লেখ্য, আসন্ন ফোবানার মিডিয়া পার্টনার হচ্ছে চ্যানেল আই, বাংলাদেশ প্রতিদিন, নিউজ টোয়েন্টিফোর, খবর ডটকম ইত্যাদি। অনুষ্ঠানের শেষে প্রায় মধ্যভোর পর্যন্ত স্থানীয় শিল্পীদের পরিবেশনায় অনুষ্ঠিত হয় বিশেষ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এই পর্বে অংশগ্রহন করেন সেলিম ইব্রাহিম, মাহিনুর, তারিকুর, মাহিন সুজন, দেওয়ান বিজয়, আমিনুল, আফরোজা প্রমুখ।