ফারুক আহমেদ: ঘুম থেকে উঠেই আজ আমার মনের মাঝে এক অন্যরকম প্রশান্তি অনুভব করছি! আজ শুক্রবার, স্ত্রী শায়লা আক্তার প্রতিবেশীদের জন্য ইফতার বানাচ্ছে। বাঙালী জাতির সেই ঐতিহ্যবাহী ইফতারের আইটেম সামুসা, পিয়াজু, ছোলা, ভেজিটেবল রোল , আলুর চপ, মুড়ি কোন কিছুই যেন আজ বাদ পরেনি, সাথে শসা, তরমুজ, শাম্মাম, নিজ হাতে কেক এবং অলম্পিয়া রেস্টুরেন্ট থেকে আনা জিলাপীও আছে ইফতারির প্যাকেটে ।
স্ত্রী শায়লা আক্তারকে শসা কেটে রেডি করে দিতে গিয়ে আমার সেই আগের দিনের ইফতারীর কথা মনে পড়ে গেল :
আমাদের ১০টি ফ্যামিলি বন্ধু আছে যারা একসময় সবাই একটি আমেরিকান টেলিকম কোম্পানীতে চাকরি করতাম । রমজান মাস এলেই রমজানের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত চলত আমাদের প্রতি উইকেন্ডে ইফতারীর দাওয়াত থাকত কমিউনিটির বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন থেকে ইফতারী প্রোগ্রাম । হত ফ্যামিলি নিয়ে শহরের বড় মসজিদে তারাবী নামাজ পড়া । রমজান মাস এলেই যেন এক অন্য রকম আনন্দ, সারা রাত মার্কেট দোকান পাঠ খোলা, ১৫ রমজানের পর থেকেই চলে ঈদের কেনা কাটার এক রম রমা পরিবেশ এবং ২১ রোজা থেকে শেষ রোজা পর্যন্ত কেয়ামের নামাজ পড়া । ঈদের পরে হত ঈদপূর্ণ মিলনী বিভিন্ন অনুষ্ঠান । একবার এক ঈদপূর্ন মিলনী অনুষ্ঠানে, আমি ফুটবলে সেরা গোলদাতা এবং স্ত্রী শায়লা আক্তার পিলু পাসিং ইভেন্টে সেরা পুরস্কার পেয়ে কমিউনিটিতে মোস্ট ট্যালেন্টেড ফ্যামিলি হিসেবে উপাধিও পেয়েছিল ! সেই দিন গুলো ছিল অনেক আনন্দের । ইদানিং কালে অনেক কিছুই হয় না, বর্তমান সময় গুলোতে মানুষের মাঝে মায়া-মমতা-আন্তরিকতা- বন্ধুত্বের বন্ধন যেন অনেক কমে এসেছে । ব্যস্ততা, অর্থনৈতিক মন্দা এবং মানবিকতার অভাবে বর্তমানে মানুষের প্রতি মানুষের আন্তরিকতা এখন আর আগের মতো নেই । আর করোনা পেন্ডামিকের কারনে গত ২টি বছরে তা আরও ভয়াবহ অবস্থার রূপ নিয়েছে !
স্ত্রী শায়লার সাথে আমি যখন ইফতার পেকেট গুলো রেডি করছি, তখন আমি তাকে বললাম :
আমি: আজ ইফতারগুলো সত্যি অনেক সুন্দর হয়েছে, চলো এই সুন্দর ইফতারীর ছবি গুলো তুলি এবং আমাদের “ফ্যামিলি হোয়াটস আপ” গ্রুপে পোস্ট করি, ছেলে মেয়েরাও দেখুক ।
শায়লা: (এই কথা শুনেই ওর চোখ দুটি যেন টল মল হয়ে উঠল এবং বলতে লাগলো ) আজ আমার ছেলে মেয়েরা কেউ পাশে নেই, ওরা খেয়ে না খেয়ে থাকে, জানিনা ওরা কি দিয়ে ইফতার করছে বা কিভাবে সেহরি খাচ্ছে । এমন সব ছবি দেখলে ওদের মন খারাপ হবে, তাই আমি চাই না তুমি ছবি তুলে ওদের শেয়ার কর । প্রতিবেশীদের ইফতার করাবো তাই ইফতার বানিয়েছি এবং এতেই আমি খুশি, ছবি তোলার জন্য নয় !
স্ত্রী শায়লার কথা শুনে আমার মনটাও খারাপ হয়ে গেল ! পড়াশোনার কারণে ছেলে মেয়েরা দূরে থাকছে, গত বছর রমজানে সবাই এক সাথে ছিল, শায়লা ছেলে মেয়েদের প্রিয় ইফতারী বানাতো , ছেলে মেয়েরাও কেউ পুটিং, কেউ কেক বা চিকেন টিক্কা বানাতো । সবাই মজা করে একসাথে ইফতার করতাম, অনেক গল্প হত ওদের পড়াশুনা নিয়ে, ওদের ভবিষ্যত পরিকল্পনা নিয়ে নানা বিষয় নিয়ে। অথচ আজ ওরা কেউ পাশে নেই …………………এসব ভাবতে গিয়ে আমার চোখ দুটি ভিজে গেল !
শায়লা একজন পাকা রাধুনী একসময় “সিদ্দিকা কবীরের রেসিপি” বই দেখে নানা মজার খাবার বানালেও, এখন তার টেবলেট এ দেখে নেয় নানা ভিডিও রেসিপি, যখন যে মজার খাবার বানাতে চায়। একই সাথে কোন ভাল খাবারের ভিডিও পেলে পাঠিয়ে দেয় ছেলে মেয়েদের কাছে এবং ইমুতে কল করে বুজিয়ে দেয় রান্নার প্রসেসগুলো । ছেলে মেয়েরাও সব রেডি করে আম্মুকে ভিডিও কল দেয়, বুজে নেয় যখন যা রান্না করে । ছেলে মেয়েরা দূরে থাকলেও এই ভাবেই শিখে নিচ্ছে তাদের দৈনন্দিন জীবনের চলার জন্য খাবার দাবার প্রস্তুতি।
শায়লার রেডি করা ইফতারীর পেকেট গুলো আমি প্রতিবেশীদের বাসায় পৌঁছে দেওয়ার পর, যখন মসজিতে মাগরিবের নামাজ পড়তে গেলাম, সেখানে বন্ধু সাদিকুর রহমানের সাথে দেখা ।
আমি : কি সাদিক কেমন আছ, বাসার সবাই ভাল তো, রমজানে তোমার অফিস কেমন চলছে ? আজ কোন মসজিদে তারাবীর নামাজ পড়তে যাচ্ছ ?
সাদিক : ভাল আছি, বাসার সবাই ভাল আছে এবং অফিসও ভাল চলছে । তারাবীর নামাজ পড়তে প্রতিদিন যে মোবারাক মসজিদে নামাজ পড়তে যাই সেখানেই যাচ্ছি, আজ অন্য কোথাও যাওয়ার প্ল্যান আছে নাকি ?
আমি : হ্যাঁ ফ্যামিলি নিয়ে মোবারাক মসজিদেই আসছি তারাবি নামাজ পড়তে । নামাজের পর আমরা সবাই থাকব একটু আলোচনা আছে সবার সাথে । করোনা তো বলা চলে শেষ, সরকারও অনেক বিধি নিষেধ তুলে নিয়েছে, তাই এবার আমরা সবাই মিলে ঈদ পূর্নমিলনী প্রোগ্রাম করতে চাই কোন একটি রিসোর্সে ।
সাদিক: বাহ্ দারুন হবেতো, প্রায় দুটি বছর তো ঘরেই বন্ধী রইলাম, বউ বাচ্ছারা সবই যেন হাফিয়ে উঠছে । এবার ঈদ পূর্নমিলনী হলে ভালই হবে, ঈদ পূর্ণমিলনী প্রোগ্রামে কি কি ইভেন্ট থাকছে ?
আমি: সকাল ১০টার মধ্যে আমরা সবাই রিসোর্সে পৌঁছে যাব । প্রথমেই হবে অলিম্পিয়া রেস্টুরেন্টের পরোটা ভাজি, হালুয়া দিয়ে নাস্তা । তারপর:(১) ছোট মেয়েদের বেলুন ফোটানো ইভেন্ট (২) ছোট ছেলেদের বিস্কুট দৌড় (৩) ছেলে মেয়েদের ১০০ মিটার দৌড় (৪) কক ফাইটিং (৫) পুরুষদের হাঁড়ি ভাঙা (৬) দড়ি টানা টানি (৭) দুপুর ২টায় লাঞ্চ পোলাও -গরুমাংশ – চিকেন রোস্ট দিয়ে (৮) বিকেলে চা / কফি/কেক বিস্কুট হালকা নাস্তা (৯) ইভেন্টের পুরস্কার বিতরণী এবং (১০) সন্ধ্যার আগেই রিসোর্স থেকে বিদায় ।
সাদিক: বাহ্ অনেক সুন্দর ইভেন্টে তো, মহিলাদের ইভেন্ট থাকছে তো ?
আমি: অবস্যই মহিলাদের জন্য মজার মজার কিছু ইভেন্ট থাকছে (১) মিউজিকের তালে তালে পিলু পাসিং (২) চেয়ার সিটিং (৩) মেসেজ রিলে ইভেন্ট থাকছে ।
সাদিক: ইভেন্টে বিজয়ীদের জন্য পুরস্কার ?
আমি : হ্যাঁ সকল ইভেন্টের বিজয়ীদের জন্য পুরস্কার থাকছে । ছোট বাচ্ছাদের জন্য খেলনা, ওয়াল ঘড়ি, গ্লাস সেট, শো পিচ, বই সহ আরো অনেক পুরস্কার ! সর্বশেষ থাকছে টিকিট নম্বর দিয়ে লটারী পুরস্কার “মাইক্রোয়েভ ওভেন” ।
সাদিক: বাহ্ সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে অনেক দিন পর এবার খুবই চমৎকার ঈদ পূর্ণমিলনী প্রোগ্রাম হবে, এবং আমি শিউর সবাই অনেক আনন্দিত হবে । আচ্ছা প্রোগ্রাম শেষে একটি সংস্কৃতি অনুষ্ঠান থাকলে ভাল হতো না ?
আমি : সংস্কৃতিক ইভেন্টতো তোমার পার্ট । হ্যাঁ অবশ্যই খুব সুন্দর হবে তুমি যদি তোমার টীম নিয়ে একটি আকর্ষণীয় সংস্কৃতি ইভেন্ট উপহার দিতে পারো ।
সাদিক: আমার মাথায় একটি আইডিয়া আসছে, গত মাসে তোমার লেখা “ভাল মানুষ চাই” ছোট গল্পটি সত্যি অসাধারণ হয়েছে, তুমি বললে আমি আমার টীম নিয়ে তোমার সেই গল্পটি নিয়ে একটি স্টেজ নাটক করতে পারি । আসলেই তো তাই, আমরা সবাই কেবল আমাদের ছেলে মেয়েদেরকে ডাক্তার -ইঞ্জিনিয়ার -প্রফেসর – সায়েন্টিস্ট বানানোর জন্য মহাব্যস্ত, কিন্তু তাদেরকে ভাল মানুষ বানাতে হবে সেই ভাবনা আমাদের মাঝে অনেকেরই কম আছে । আমরা যদি তোমার লেখা “ভাল মানুষ চাই” গল্পটি নাটকের মাধ্যমে উপস্থাপন করতে পারি তাহলে, সত্যি তা খুবই চমৎকার হবে ।
আমি: হ্যাঁ তাহলে তাই কর, আমি গল্পটি নাটকের জন্য ক্রিপ্ট তৈরী করে দিচ্ছি, তুমি তোমার টীম নিয়ে নাটকের রিহার্সাল শুরু করে দাও ।
তারাবী নামাজ শেষে রাতের ডিনার করে আমি যখন টিভির সামনে বসলাম , আমার মনটা অনেক আনন্দে ভরে উঠল । একদিকে প্রতিবেশী সবাইকে ইফতার করাতে পারার আনন্দ, অন্য দিকে ঈদের পূর্ন মিলন প্রোগ্রামটি ফাইনাল করার আনন্দ, একই সাথে সারাদিনে রোজা পালন ও আল্লাহর ইবাদত পালন করতে পাড়ার আনন্দগুলো অনুভব করছিলাম ঠিক তখনই স্ত্রী শায়লার ডাক পড়ল “এই তুমি কোথায়, আজ অনেক পরিশ্রম করেছ, আসো শুয়ে পর রেস্ট কর, সকালে অফিস আছে “।