শাহেদ ইকবাল
কোথাও কেউ নেই।
একটা যুদ্ধ শেষ হয়েছে। মনে হচ্ছে কেউ বেঁচে নেই। চারপাশে বিশাল ধ্বংসস্তুপ। বাতাসে লাশের গন্ধ। মাংসের গন্ধ। এমন ভয়ংকর যুদ্ধ আগে কেউ কখনও দেখেনি।
যখন মনে হচ্ছিল কেউ বেঁচে নেই, তখন কেউ একজন উঠে দাঁড়ালো! যেন ধ্বংসস্তূপ থেকে জেগে উঠলো রূপকথার সেই ফিনিক্স পাখি।
বৃক্ষচারী পাখিগুলো অবাক হয়ে গেল। যে উঠে দাঁড়ালো, সে পরিচিত কেউ নয়! সে অচেনা কেউ! যাকে তারা বিজয়ী হবে ভেবেছিল, যাকে এতদিন বিজয়ী হতে দেখেছিল, সে আজ বিজয়ী হলো না। সে আজ উঠে দাঁড়ালো না। সে আজ পরাভুত। অতিকায় সেই ডাইনোসর হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে আছে কিছু দূরে। সারা শরীরে পাথরের ক্ষতচিহ্ন। আর ক্ষুদ্রকায় একটি প্রাণী বিজয়োল্লাসে উঠে দাঁড়িয়েছে। এ কি কাণ্ড!
মাথার উপরে প্রাগৈতিহাসিক সূর্য। আদিগন্ত নীল আকাশ। পায়ের নিচে রুক্ষ পাথুরে মাটি। গ্রীষ্মের তপ্ত হাওয়া। সবাই যেন হর্ষধ্বনি করে উঠল। সবাই যেন বরণমালা সাজিয়ে বরণ করে নিল নতুন এই বিজয়ী বীরকে।
ঈশ্বর নিজেও যেন বরণ করে নিলেন তার প্রতিনিধিকে। সবাইকে ডেকে বললেন, দেখো দেখো, মানবের হাতে দানব পরাজিত হয়েছে। যাকে আমার প্রতিনিধি বানিয়েছিলাম, সে বিজয়ী হয়েছে। সে আজ আপন শক্তিতে শক্তিমান।’
এ ঘটনা প্রস্তর যুগের। তখনও আগুন আবিষ্কার হয়নি। তখনও মানুষ রান্না শেখেনি। তখনও পোশাক আবিষ্কার হয়নি। মানুষ গাছের ছাল দিয়ে লজ্জা নিবারণ করেছে। তখনও পৃথিবীর জলে-স্থলে-মৃত্তিকায় পদে পদে ভয়াল মৃত্যুর হাতছানি।
এ ঘটনার আরও কয়েক লক্ষ বছর পরে বিশ্বে একটি নতুন কবিতা লেখা হলো। কবিতার নাম ‘মানব বন্দনা’। কবির নাম অক্ষয় কুমার বড়াল (১৮৬০-১৯১৯)। মানবজাতির বিস্ময়কর শক্তি ও সম্ভাবনা নিয়ে তিনি লিখলেন-
“নমি তোমা নরদেব, কি গর্বে গৌরবে
দাঁড়িয়েছ তুমি!
সর্বাঙ্গে প্রভাতরশ্মি, শিরে চূর্ণ মেঘ,
পদে শষ্প ভূমি।
পশ্চাতে মন্দির-শ্রেণী, সুবর্ণ কলস,
ঝলসে কিরণে;
কলকণ্ঠ-সমুত্থিত নবীন উদ্গীথ
গগনে পবনে।”
,(প্রদীপ গীতি-কবিতাবলী, ১২৯০)
আরও ৩৭ বছর পরে ১৯২১ সালে কলকাতার বিখ্যাত তালতলা লেনের ৩/৪ সি বাড়িতে বসে ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো এক রাতজাগা ক্ষ্যাপাটে কবি লিখলেন-
‘বল বীর-
বল উন্নত মম শির!
শির নেহারি আমারি নত শির ওই শিখর হিমাদ্রির!
মম ললাটে রুদ্র ভগবান জ্বলে রাজ-রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর!’
এই কবির নাম কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬)। তাঁর সেই কালজয়ী কবিতার নাম ‘বিদ্রোহী’।
এই কবিতা লেখার আরও ত্রিশ বছর পরে কিউবার জেলে পল্লীতে ঘটল আরেক বিস্ময়কর ঘটনা। এক বাউন্ডুলে লেখক লিখে ফেললেন দুনিয়া কাঁপানো উপন্যাস ‘দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি’ (১৯৫১)। নোবেলজয়ী এই মার্কিন ঔপন্যাসিকের নাম আর্নেস্ট হেমিংওয়ে (১৮৯৯-১৯৬১)। উপসাগরীয় স্রোতে বিশাল এক মারলিন মাছের সঙ্গে বৃদ্ধ জেলে সান্তিয়াগোর শ্বাসরুদ্ধকর যুদ্ধের উপাখ্যান লিখতে গিয়ে তিনি লিখলেন সেই কালজয়ী বাণী-
‘Man can be destroyed but not defeated’।
‘মানুষ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে, কিন্তু পরাজিত হতে পারে না।’
সেই যে মানুষ ধ্বংসস্তুপ থেকে উঠে দাঁড়াল-তার আর পতন হলো না। সে কেবল উঠে দাঁড়াতেই থাকল। প্রতিটি ধ্বংসের শেষে ফিনিক্স পাখির মত জেগে উঠতেই থাকল। সোনালী হরফে সোনালী বিজয়গাঁথা লিখতেই থাকল।
কত দানব এল রক্তচক্ষু নিয়ে। ডাইনোসর এল। দাবানল এল। আগ্নেয়গিরি এল। উল্কাপিণ্ড এল। বন্যা এল। মহামারী এল। কিন্তু মানুষ কখনও পরাজয় বরণ করলো না।
মানুষের এই যে বিজয়গাঁথা, এটা কিন্তু একতরফা। এখানে কোনো অংশীদার নেই। সে কারও কাছে মুকুট হারায়নি। প্রতিবারই মুকুট জিতেছে। হয়তো কখনও লড়াইটা কঠিন হয়েছে। কখনও উইকেট বেশি হারাতে হয়েছে। কখনও বেশি মূল্য দিতে হয়েছে। কিন্তু দিনের শেষে শেষ হাসিটা মানুষই হেসেছে। অন্য কেউ হাসেনি।
মহামারীর কথাই ধরা যাক। এই বিশ শতকেই গুটিবসন্ত প্রায় ত্রিশ কোটি মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। স্প্যানিশ ফ্লু’র আক্রমণে (১৯১৮-১৯১৯) পাঁচ কোটি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। ইবোলা ভাইরাসের আক্রমণে (২০১৪-২০১৬) আফ্রিকার ১১ হাজার ৩৩৩ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। রেবিজ বা জলাতঙ্ক রোগে বছরে প্রায় ৫৯ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। মৌসুমি ইনফ্লুয়েঞ্জায় বছরে সাড়ে ৬ লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু রোগে বছরে প্রায় ২৫ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। প্রাণসংহারক এইডস (এইচআইভি) রোগে প্রায় ৩ কোটি ২০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। মরণব্যাধি সার্সের (সিভিয়ার একিউট রেসপিরেটরি ভাইরাস) আক্রমণে সহস্রাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। পোলিও মহামারীতে লক্ষাধিক মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে! তারপর মানুষ টিকা আবিষ্কার করেছে। মানুষ সেই মহামারীগুলোকেও পরাজিত করেছে।
এখন চলছে এই অদম্য অপরাজেয় মানবজাতির সাথে হিংস্র করোনা মহামারীর এক শ্বাসরুদ্ধকর লড়াই। প্রাণঘাতী করোনা দানবীয় শক্তিতে চড়াও হয়েছে। সারাবিশ্বে বিশ লক্ষাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। আক্রান্ত হয়েছে নয় কোটিরও অধিক মানুষ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনাকে বৈশ্বিক মহামারী ঘোষণা করেছে। আলাস্কা থেকে টোকিও পর্যন্ত সর্বত্র নেমে এসেছে এক নিদারুণ মানবিক বিপর্যয়।
কিন্তু মানুষ এই যুদ্ধেও হারবে না, এটা একপ্রকার নিশ্চিত। বিজয় মানুষেরই হবে। আজ নয়-কাল নয়-পরশু। হয়তো আরও কিছু প্রাণ ঝরবে। আরও কিছু সম্মুখ সারির যোদ্ধা-চিকিৎসক, প্রশাসক, সমাজসেবক, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী প্রাণ হারাবেন। কিন্তু শেষ হাসি মানুষই হাসবে ইনশাআল্লাহ। চূড়ান্ত বিজয় এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের একটি ভ্যাকসিন ইতোমধ্যেই একাধিক ট্রায়াল অতিক্রম করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই ভ্যাকসিনকে প্রতিষেধক হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আরও ১২৫টি ভ্যাকসিন নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা চলছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী করোনা মহামারীর প্রতিষেধক বাজারে আসতে আর বেশি বিলম্ব নেই। সমগ্র বিশ্ব প্রতীক্ষার প্রহর গুণছে করোনার কার্যকর প্রতিষেধকের জন্য।
সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের (সিএমএইচ) Consultant Physician General মেজর জেনারেল প্রফেসর ডাঃ মোঃ আজিজুল ইসলাম ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন। লিখেছেন, করোনা আক্রান্ত হয়ে সিএমএইচে ভর্তিকৃত ৯৮% রোগীই নিরাময় লাভ করেছেন। এই প্রসঙ্গে তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন। সেটি হলো-
“I believe as a doctor, only treatment, disease evaluation, regular follow up, treatment modification, reassurance and interactions with patients and party are not enough; special prayer for patients is also essential for good outcome.”
অর্থাৎ শুধু চিকিৎসা, রোগ নির্ণয় কিংবা তদারকী নয়, রোগ নিরাময়ের জন্য প্রার্থনাও অত্যন্ত জরুরি একটা অনুষঙ্গ।
ঈশ্বরের প্রতিনিধি মানুষ অসুরের সাথে যুদ্ধ করবে, এটা যেমন প্রত্যাশিত, তেমনি ঈশ্বরের সাথেও যোগাযোগ অক্ষুণ্ন রাখবে এটাও কিন্তু প্রত্যাশিত।
আসুন, আমরাও প্রার্থনা করি-এই কৃষ্ণপক্ষ কেটে যাক। ঝলমলে পূর্ণিমা হাসুক। জীবন আবার ফিরে আসুক জীবনের কাছে। জয় হোক মানুষের। জয় হোক জীবনের। জয় হোক সত্য ও সুন্দরের।