প্রাণঘাতী নভেল করোনাভাইরাসের কারণে অবরুদ্ধ চীনের উহান শহরে আটকা পড়া বাংলাদেশিদের দিন কাটছে আতঙ্ক আর দুশ্চিন্তায়।
এক কোটি ২০ লাখ জনসংখ্যার ওই শহরে পড়াশোনা, গবেষণা আর ব্যবসার কাজে বসাবস করেন সাড়ে তিনশর মত বাংলাদেশি, যাদের বেশিরভাগই শিক্ষার্থী।
বাংলাদেশিদের মধ্যে কারও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া না গেলেও অবরুদ্ধ দশার মধ্যে তাদের খাবার ফুরিয়ে আসছে দ্রুত। প্রতিটি মুহূর্ত তাদের কাটছে অনিশ্চয়তার মধ্যে।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম ইতোমধ্যে জানিয়েছেন, চীন থেকে আগ্রহীদের দেশে ফিরিয়ে আনার নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তবে কীভাবে তাদের আনা হবে, অবরুদ্ধ দশা থেকে নিরাপদে বের করে আনার প্রক্রিয়া কী হবে সেসব বিষয় এখনও নিশ্চিত নয়।
মধ্য চীনের উহান শহরে ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর করোনাভাইরাসের প্রথম সংক্রমণ শনাক্ত করা হয়। নিউমোনিয়ার মত লক্ষণ নিয়ে নতুন এ রোগ ছড়াতে দেখে চীনা কর্তৃপক্ষ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে সতর্ক করে। এরপর ১১ জানুয়ারি প্রথম একজনের মৃত্যু হয়।
আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকায় ছয় দিন আগে ওই শহরের সব ধরনের গণপরিবহন অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়। অনেকে শহর ছেড়ে গেলেও বাকিরা কার্যত অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন সেখানে।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ইশরাত জাহান লিজা পিএইচডি করছেন উহান উইনিভার্সিটি অব জিও সায়েন্সেসে। তিনিও আটকা পড়ে আছেন সেখানে।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “ছয় দিন ধরে সবকিছু বন্ধ। আজ কিছু দোকানপাট খুলেছে। খাবার কেনা ছাড়া কোনো কাজে বের হচ্ছেন না কেউ। মাছ-মাংসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকায় সবাই সবজি আর ডিমের ওপর নির্ভর করছেন।
”উহান থেকে পণ্য আনা-নেওয়া বন্ধ থাকায় চাহিদা অনুযায়ী শাক-সবজিও পাওয়া যাচ্ছে না অনেক ক্ষেত্রে। আবার পাঁচ কিলোমিটার দূরের সুপারশপে তো হেঁটে যাওয়া সম্ভব না।”
বাংলাদেশি কেউ আক্রান্ত হওয়ার খবর না মিললেও আতঙ্ক আর ভয় কাজ করছে লিজার মধ্যেও। সরকার আগ্রহীদের দেশে ফেরানোর কথা বললেও সেটা কীভাবে কতটুকু কার্যকর হবে, তা নিয়ে তিনি সন্দিহান।
তিনি বলেন, “একটা ভয়ের জায়গা হল, যে কোনো সময় যে কেউ আক্রান্ত হতে পারে। সে কারণে চলা-ফেরায় নিষেধাজ্ঞার মত আছে।”
লিজার মত আরও যারা আছেন, তাদের সবার কথাও মোটামুটি এক। রাস্তাঘাট একেবারে জনমানবশূন্য। খাবারের দোকানে দুয়েকজন এলেও অন্যান্য জায়গা খা খা করছে।
চীনের বড় উৎসব চাইনিজ নিউ ইয়ারের ছুটির কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের সরবরাহ কম। ফলে খাবার জোগাড় করতে অনেককে বেগ পেতে হচ্ছে। যারা আগে থেকে খাবার সংগ্রহ করে রেখেছিলেন, তারা এখন সুবিধা পাচ্ছেন।
করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার প্রেক্ষাপটে যে কোনো জরুরি প্রয়োজনে যোগাযোগের জন্য বেইজিংয়ে বাংলাদেশ দূতাবাস একটি হটলাইন চালু করেছে।
শিক্ষার্থী ও গবেষকরা সপ্তাহের সাতদিন হটলাইনে +86 178-0111-6005 ফোন করে চব্বিশ ঘণ্টা সহায়তা নিতে পারবেন বলে জানানো হয়েছে ওই বিজ্ঞপ্তিতে।
গত কয়েকদিনে দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস চীনের সীমানা ছাড়িয়ে থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, নেপাল, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডা পর্যন্ত পৌঁছে গেছে।
সোমবার পর্যন্ত চীনে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা ৮১ তে পৌঁছেছে। আক্রান্তের সংখ্যা পৌঁছে গেছে তিন হাজারের কাছাকাছি।
উহানে সোমবারের পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়ে হুয়াজং ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির শিক্ষার্থী নাজমুল আলম নাঈম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ছয় দিন ধরে বাসার মধ্যে, বের হওয়ার কোনো উপায় নেই। তবে বের হতে কেউ বাধা দিচ্ছে না, নিজের সেফটির জন্য আমরা বের হচ্ছি না।”
তিনি বলেন, “নিউ ইয়ারের সময় এমনিতে অনেক দোকানপাট বন্ধ থাকে। সে কারণে আবাসিক হলে বাজার কিছু আমরা আগেই করে রেখেছি। পরিস্থিতি প্রলম্বিত হলে তখন বিকল্প অন্য কিছু ভাবতে হবে।”
উহান উইনিভারসিটি অব জিও সায়েন্সেসের আরেক শিক্ষার্থী নাসিম আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের পরিস্থিতি ভালো। এখান থেকে বের হতে হলে ভাইরাসের পরীক্ষা করেই যেতে হয়, আবার ফেরার সময়ও পরীক্ষা করাতে হয়। মাস্ক পরাও বাধ্যতামূলক।”
শিক্ষকরা আর হল প্রশাসন নিয়মিত শিক্ষার্থীদের খোঁজখবর রাখছে বলেও জানান তিনি।
উহান বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত এনামুল হক বলেন, “উহান শহরে প্রায় ৬ বছর ধরে আছি। সন্দেহ নেই বর্তমানে আমরা কঠিন সময় পার করছি। তবে ভাইরাস পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য উহান সবচেয়ে নিরাপদ শহর। চীনের অন্য শহরগুলো থেকেও বিশেষজ্ঞ ডাক্তার নিয়ে আসা হয়েছে এখানে।”
তিনি বলেন, চিকিৎসাকর্মীরা তাদের সবচেয়ে বড় উৎসবে (চাইনিজ নিউ ইয়ার) বাড়িতে না গিয়ে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। বিশ্ববিদ্যালগুলোর আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদেরকে এ পরিস্থিতি প্রতিরোধ ও মোকাবেলা করার নির্দেশিকা নিয়মিতভাবে জানানো হচ্ছে এবং ব্যক্তিগত পর্যায়েও খোঁজ নেওয়া হচ্ছে।
”যেমন আজ সকালে আমার অফিস থেকে আমাকে জানানো হয়েছে আমি যেন প্রতিদিন আমার শরীরের তাপমাত্রা সম্পর্কে তাদেরকে রিপোর্ট করি। অর্থাৎ যদি কোনো অসঙ্গতি বা বিপদ দেখা দেয় তাহলে তারা যেন দ্রুত ব্যবস্থা নিতে পারে।”
উহানের সেন্ট্রাল চায়না নরমাল ইউনিভার্সিটির পিএইচডি শিক্ষার্থী শামীমা সুলতানা বলেন, “এখানের অবস্থা খুব একটা ভালো না। আমি আতঙ্কের মধ্যে আছি। দুই বাচ্চা নিয়ে আমি উহানে আছি, আমার বিষয়টা ডিফিকাল্ট। রাস্তাঘাটে কোনও মানুষ নেই। কিছুদিন পর আমার খাবার-দাবারের সঙ্কট দেখা দেবে।”
উহানে থাকা শিক্ষার্থীদের অনেকেই আকুতি জানিয়েছেন দেশে ফিরে আসার।
পিএইচডির শিক্ষার্থী শামীমা সুলতানা বলেন, “সরকারের কাছে আবেদন জানাচ্ছি, আক্রান্ত হওয়ার আগেই আমাদেরকে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা নেওয়া হোক।”
আবার কেউ কেউ পরিস্থিতি বিবেচনায় থেকে যাওয়ার কথাও ভাবছেন।
‘জিংচু ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজিতে’ অধ্যয়নরত টুম্পা প্রামানিক বলেন, “আপনারা দয়া করে ফেইসবুকে করোনাভাইরাস নিয়ে প্যানিক না ছড়িয়ে সতর্ক থেকে মাস্ক ব্যবহার করুন। সাবধানে থাকুন। আমরা এখনো ভালো আছি, বেঁচে আছি।
”আমরাও দেশে যেতে চাই, তবে ভাইরাস নিয়ে নয়। আমরা নিয়ম মানছি, সতর্ক আছি। অবশ্যই এ কঠিন সময় শেষে সুস্থ অবস্থায় হাসি নিয়ে মায়ের কোলে ফিরে যাব।”
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম সোমবার এক ফেইসবুক পোস্টে লিখেছেন, বাংলাদেশের নাগরিক যারা চীন থেকে ফিরতে চাইবেন, তাদের ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। চীন সরকারের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনাও শুরু হয়েছে।
“কী প্রক্রিয়ায় এটি করা হবে তা বাস্তবতার নিরিখে স্থানীয় প্রশাসনের সাথে সম্মতির ভিত্তিতে করা হবে।”
চীন থেকে দেশে ফিরতে আগ্রহীদের তালিকা করতে সোমবার একটি প্রাথমিক নির্দেশনা জারি করা হবে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী।
বাংলাদেশ-চায়না ইয়ুথ স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট এ এ এম মুজাহিদ বলেন, “বাংলাদেশি ছাত্র-ছাত্রীদের তাদের নিজ নিজ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নির্দেশ মেনে চলতে বলা হচ্ছে। প্রতিটা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বা দুটি করে ক্যান্টিন খোলা রাখা আছে। তাই প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের না হতে বিশেষ অনুরোধ জানানো হচ্ছে সবাইকে।”
এদিকে, বাংলাদেশ দূতাবাস কোনও খোঁজ নিচ্ছে না বলে অভিযোগ করছেন দেশটিতে অবস্থানরত বাংলাদেশি অনেক শিক্ষার্থী।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করলে বেইজিংয়ে বাংলাদেশ দূতাবাসের উপ প্রধান মাসুদুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা বেশিরভাগ অভিযোগ পাচ্ছি উহান শহর থেকে। কিন্তু শহরটি অচলাবস্থায় আছে। দূতাবাসে ২৪ ঘণ্টা হটলাইন সেবা দিচ্ছি। দূতাবাস কর্মকর্তারা পালাক্রমে ডিউটি দিচ্ছেন। আমরা উহানসহ অন্যান্য লোকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছি। এখানে উইচ্যাটে বাংলাদেশি গ্রুপ ‘আই এম ইন উহান নাউ’ খোলা হয়েছে।
”এই গ্রুপে আমরাও আছি এবং সর্বশেষ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি। আমরা বাংলাদেশ সরকার, চীন সরকার এবং চীন সরকার স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছি।”
তিনি বলেন, “অনেকে অভিযোগ করেছে যে উহানে দোকানপাট বন্ধ। কিন্তু আসল ঘটনা হচ্ছে ওই শহরে কয়েকটি বড় শপিং মল খোলা। যেখানে সব ধরনের জিনিস পাওয়া যাচ্ছে। ওই মলগুলোতে যাওয়ার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে শাটল বাসেরও ব্যবস্থা আছে।”
উহানের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে মাসুদুর বলেন, “আমাদের প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী উহানে প্রায় ৩৫০ জন বাংলাদেশি আছেন। উহানে এখনও অচলাবস্থা বিরাজ করছে। সেখানে বা চীনের অন্য কোনও স্থানে বাংলাদেশি কেউ করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের খবর নেই।”
’জমজমাট সাংহাই যেন শ্মশান’
উৎপত্তিস্থল উহানের মতো অন্যান্য শহরেও করোনাভাইরাসের ধাক্কা লেগেছে। চার বড় শহর- বেইজিং, সাংহাই, জিয়ান ও তিয়ানজিন থেকে দূরপাল্লার বাস বন্ধ রয়েছে বলে বিবিসির জানিয়েছে।
অবরুদ্ধ থাকার কারণে জমজমাট সাংহাইয়ের জনমানবহীন দশার কথা জানালেন ইস্ট চায়না নরমাল ইউনিভার্সিটির পিএইচডি শিক্ষার্থী তাহেরা তমা।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, ”দুই-একটা সিটি বাস আছে, কিন্তু সাংহাইয়ের মত সিটি যেখানে রাতদিন সবসময় জমজমাট থাকত, তা এখন যেন শ্মশান।”
পাঁচ মাসের সন্তান ও স্বামীকে নিয়ে সাংহাইতে আছেন তমা। দেশে ফেরার টিকেট কিনতে চাইলেও ছোটো শিশু থাকায় তা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানান তিনি।
তাহেরা তমা বলেন, “টিকেট পেলেও যাদের বাচ্চা আছে, তাদের জন্য কী কী যেন রেস্ট্রিকশন। এভাবে বন্দি হয়ে থাকলে ভাইরাস ছাড়াই মানসিক টেনশনেই মারা যাব।”
তিনি বলেন, “আগে থেকে কিছু খাবার কিনে রেখেছিলাম, সেগুলো শেষের পথে। ভার্সিটি থেকে বলছে খুব শিগগির খাবার সরবরাহ করবে, দুশ্চিন্তা না করতে।”