আশিকুজ্জামান টুলু, টরন্টো
মোহামাদপুর পুরানো থানার সামনে আওরোঙ্গজেব রোড থেকে রিকশাটার পিছনে একটা বাইক ফলো করা শুরু করলো। রিকশাটা তাজমহল রোডে বাঁয়ে ঘুরলো এবং চলতে থাকলো। পিছে পিছে চলছে বাইকটা। রিকশায় বসা মহিলা বুঝতে পারেন নাই যে পিছনে পিছনে একটা বাইক আসছে খুব ধীর গতিতে। রিকশাটা সলিমুল্লাহ রোড, নুরজাহান রোড পার হয়ে মহাম্মোদিয়া হাউজিং সোসাইটির দিকে চলে যায়। ৪ নম্বর রোডে ঢোকার মাথায় কোনার বাড়িটার বিরাট গেটের সামনে রিকশাটা দাড়ায়। দারোয়ান দরজা খুলে দাড়ায়। ভদ্রমহিলা রিকশার সিটে বসেই ব্যাগ থেকে রিকশার ভাড়াটা বের করে রিকশাওয়ালার দিকে এগিয়ে ধরেন। রিকশাওয়ালা ভাড়া নিয়ে চলে যায়, উনি গ্যারেজের ভিতরে ঢুকে যান। ঠিক ঐ মুহূর্তেই পিছনে আসা বাইকটা এসে গ্যারেজের দরজায় থামে এবং ওরা দুইজন বাইক থেকে নেমে গ্যারেজের ভিতরে যায়। ভিতরে গিয়েই ওরা পেয়ে যায় ভদ্রমহিলাকে এবং একজন কোমর থেকে একটা রিভলভার বের করে মহিলার দিকে তাক করে বলে ওঠেঃ
আনটি, কিছু মনে কোরেন না, হাতের চুড়িগুলা দিয়ে দেন।
মহিলা বুঝে যান যে তিনি ছিনতাইকারীর হাতে পড়েছেন।
মহিলাঃ এই হারামজাদারা, তোদের দেয়ার জন্য চুড়ি পরেছি আমি?
ওরাঃ দিয়ে দেন, তা না হলে গুলি করবো।
এই অবস্থা দেখে দারোয়ান দৌড় দিয়ে সামনের দোকান যায় লোক জড়ো করার জন্য। বিষয়টা ছিনতাইকারীরা বুঝে ফেলে।
মহিলাঃ কর গুলি, আমি চুড়ি দিবো না।
ঠাশ করে একটা আওয়াজ হয়। ছিনতাইকারীরা গুলি করে দেয়। গুলি পেটের পাশ ঘেশে বেরিয়া যায়, ভাগ্য সুপ্রসন্ন হওয়ায় পেটের ভিতরে ঢুকে নাই বিধায় মহিলা বেচে যান। ইতোমধ্যে দোকানের লোকজন দারোয়ানসহ চলে আসায় ছিনতাইকারীরা বাইকটা ঘুরিয়ে টান দেয় এবং পালিয়ে যায়। এই ভদ্র মহিলা আর কেউ নন, উনি আমার শাশুড়ি।
রাত ১১টা। এক ভদ্রলোক সিএনজিতে করে ওয়ারী ক্লাব থেকে কাকলীর সামনে দিয়ে বারিধারার দিকে ফিরছেন। ক্লাব থেকে ছেলের এসে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিলো কিন্তু গাড়ি পথিমধ্যে নষ্ট হয়ে যাওয়ায় উনি একাই রওনা দিয়ে দেন। হঠাৎ সিএনজিটা রাস্তার পাশে দাড়িয়ে যায় এবং দুইপাশ দিয়ে ৩ জন সিএনজিতে উঠে পড়ে মুহূর্তের মধ্যে। উনি বুঝে যান যে ওনার ভাগ্য খারাপ। যখন সিএনজি স্লো করছিলো উনি প্রত্যপন্নমতির মতো তড়িৎ সিধান্ত নিয়ে পকেটে থাকা ৪ হাজার ডলার সার্টের পিছনে কলারের ভিতর দিয়ে পিছনে ফেলে দেন। ওরা ওঠার সাথে সাথেই ভদ্রলোক বলে ওঠেনঃ
দেখো বাবা, আমার কাছে কিছুই নাই, আমি চাকরিজীবী, খুজে দেখো আমার সেলফোনও নাই। (ভাগ্যক্রমে সেদিন উনি সেলফোন নিয়ে যেতে ভুলে গিয়েছিলেন ক্লাবে)।
ছিনতাইকারীরা একটু চোটে গিয়ে পকেট সার্চ করা শুরু করে দেয় এবং আসলেই পকেতে কিছু না পেয়ে হতাশ হয়ে পড়ে। ওদের মধ্যে একজন বলে ওঠেঃ
ও আপনি চাকরিজীবী? আমরা চাকরিজীবীদের কিছু করি না। ওয় সিএনজি খাড়া, আপনে বাইচা গেলেন।
ইতিমধ্যে সিএনজি থেমে যায়। ওনাকে ওরা নামিয়ে দেয়। ভদ্রলোকের কেন যেন মায়া হয় ওদের জন্য। উনি বলে ওঠেনঃ
বাবারা আমার কাছে ১০০ টাকা আছে, তোমরা ওইটা নিয়ে যাও, মিষ্টি খেও।
ছিনতাইকারীঃ কন কি আঙ্কেল!! মিষ্টি খামু??
ভদ্রলোকঃ হ্যাঁ বাবা, নাও এই ১০০ টাকা।
ওদের মধ্যে একজন নামে সিএনজি থেকে এবং ১০০ টাকার নোটটা পকেটে ঢুকিয়ে ভদ্রলোকের মুখটাকে দুইহাতে ধরে গালে একটা চুমু দেয়। ভদ্রলোক আশ্চর্য ও বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকেন ওর দিকে। ও আবার সিএনজিতে উঠে বসে, সিএনজি ছেড়ে দেয়। উনি একটা রিকশা ডেকে আবার রওনা দেন বাসার দিকে, সাথে রয়ে যায় সার্টের পিছনে থাকা ৪ হাজার ডলার আর ছিনতাইকারীর মিষ্টি চুম্বনচিহ্ন। উনি আর কেউ না, আমার শশুরমশাই।
আমি এবং আমার স্ত্রী আদাবর থেকে মোহাম্মদপুরে ফিরছি, সন্ধ্যা ৭টা হবে। সারা রাস্তা জমজমাট, এবং ভিড় হওয়ায় রিকশা একটু একটু করে এগোচ্ছে। ভীষণ ট্রাফিক জ্যাম, বিরাট রিকশার লাইন, আমাদের সামনে ও পিছনে রিকশা। একটু এগোয়, একটু থামে, এভাবেই চলছে। আমি রিকশার ডানের সিটে এবং আমার স্ত্রী বাঁয়ে। হঠাৎ খেয়েল করলাম লুঙ্গি পরা ছ্যামড়া প্রকৃতির কম বয়সী ছেলে (২০/২২ বছর) হাতে একটা ছুরি নিয়ে আমার স্ত্রীর দিকে উচিয়ে কিছু একটা বলছে। আমার স্ত্রীর কোন খেয়ালই নাই যে কানের পাশে ছুরি হাতে নব্য ছিনতাইকারী তার নিজের মনের ভাষা এবং আকুতি ওকে বোঝাতে চেষ্টা করছে। পুরা বিষয়টা ফ্রাকশণ অফ সেকে-ের মধ্যে ঘটছে। আমি শুধু উদ্যত হতে গিয়েছি কিছু একটা করার বা বলার জন্য, ঠিক ন্যানো সেকে-ের মধ্যেই আমার স্ত্রী ঐ ছিনতাইকারীর দিকে তাকিয়ে ওর চাঁদমুখটা দেখার পর ছিনতাইকারী কি বলছে বুঝতে চেষ্টা করার আগেই ওর চোখে গিয়ে আটকে যায় ছুরির দিকে। ব্যাস সব শেষ। আমার স্ত্রী সাধা গলা দিয়ে একেবারে গগণবিদারী চিৎকারে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে দেয়। অতো জোরে চিৎকারের আওয়াজে আমি অসম্ভব চমকে গিয়ে ধুম করে রিকশার ডান দিক দিয়ে রাস্তায় গিয়ে পড়ি, ছিনতাইকারী চিৎকারের তোড়ে কিংকর্তব্যবিমুড় হয়ে ছুরি ফেলে দিয়ে সামনের দিকে ১০০ মাইল স্পীডে চোঁচা দৌড় দেয়, পাশের রিকশার লোকটা আরেকটু হলে হার্টফেল করার উপক্রম। না ছিনতাইকারি দেখে নয় বরং আমার স্ত্রীর চিৎকারে। ঐ ছিনতাইকারী বোধহয় প্রবেশনারি পিরিয়ডে ছিলো এবং ওটাই হয়তো প্রথম অ্যাসাইনমেণ্ট ছিলো, কারণ অদ্যাবধি কোন ছিনতাইকারীকে ছুরি ফেলে দৌঁড় দিতে আমি দেখিনি। তবে চিৎকারের ডায়নামিক লেভেল এবং ফ্রিকয়েনসি রেঞ্জ যা ছিল তাতেতো আমি নিজেই ছিটকে পড়ে গিয়েছিলাম রাস্তায়, ছিনতাইকারী দৌঁড় কেন দিবে না। ছিনতাইকারী যে হার্টফেল করে নাই, আমরা বেঁচে গেসি। তা না হলে আবার “মহিলা দ্বারা ছিনতাইকারী নিহত” নামে পত্রিকার পাতায় হেডিং হতো।
আমাকে ধরাধরি করে সবাই উঠায়, আমি উঠে ওকে একটা কথাই জিজ্ঞাসা করিঃ
আচ্ছা তুমি এতো জোরে চিল্লাইলা কেন?
আমার কাছে ছিনতাইকারী বিষয়টার চাইতে হটাৎ করে জনসমক্ষে পপাতধরনিতল ব্যাপারটা বেশী লজ্জার মনে হচ্ছিলো। এ যেন হাঁটু পানিতে ডুবে মরার মতো অর্থাৎ বুঝে ওঠার আগেই রাস্তায় আমার গড়াগড়ি।
ওর মুখে কথা নাই, বাকরুদ্ধ।
এই ঘটনার পর থেকে আমি খুবই সাবধান হয়ে গেলাম, সন্ধ্যার আগেই বাসা আসার চেষ্টা করতাম। কোন দাওয়াত থাকলে বা অনেক রাত পর্যন্ত বাইরে থাকার বিষয় থাকলে লিটারেলি পকেটে একটা খাম রাখতাম, খামের ভিতর ১৫০০ টাকা এবং উপরে লেখা থাকতো “ছিনতাইকারী”। বউকে মিনিমাম দুইটা সোনার আংটি পরতে বোলতাম কারণ আমি বুঝে গিয়েছিলাম যে আমরা একটি পারিবারিক ছিন্তাই পার্টির সদস্য। আর তা-না হলে সব ছিন্তাই আমাদের ঘাড়ে এসে পড়ে কেন, ওরা কি আর লোক খুঁজে পায় না। টাকা, আংটি রাখার কারণ হলোÑ কমপক্ষে ১৫০০ টাকা আর দুইটা আংটি না পেলে ছিনতাইকারীদের চালান উঠবে না তাই রেডি হয়ে থাকাই ভালো।