হাসান মাহমুদ
একাত্তরে একাত্তর আকাশ থেকে টুপ করে পড়েনি, পূর্ণ বিজয়ের আগে অনেক পরাজয় ঘটেছে একাত্তরের।
সৃষ্টির আদি থেকে মানুষ কষ্ট পেয়েছে রোগে, শোকে, বার্ধক্যে জরায়, বন্যা, খরায়, সাইক্লোন, টর্নেডো, ভ‚মিকম্পে, শীতে উত্তাপে, ধ্বসে পড়া পাহাড় বা বাড়ির নিচে, দুর্ঘটনায়, হিংস্র জন্তুর আক্রমণে। কিন্তু ফুল-পাখি-চাঁদ আর রঙিন মাছ-প্রজাপতির এ সুন্দর গ্রহটায় মানুষের হাতেই মানুষ কষ্ট পেয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি। সংখ্যাতীত মৃতদেহ, আর্তনাদ আর পাঁজর কাঁপানো দীর্ঘশ্বাসে ভারাক্রান্ত হয়ে আছে মানুষের ইতিহাস।
সে ছলনা এসেছিল ১৯৪৭ সালে। প্রথমে চমৎকার লেগেছিল। পরে ভুল ভাঙল, চারদিকে শুধু ফাঁকি আর ফাঁকি। ভারতীয় মুসলমানদের মুক্তিসনদ পৃথক বাসভ‚মি, কে স্বপ্ন দ্রষ্টা? মহাকবি ইকবাল? ১৯৩০ সালে এলাহাবাদে মুসলিম লীগ অধিবেশনের ঘোষণায়? ফরগেট ইট! ছ’বছর আগে ১৯২৪ সালে খোলাখুলি ঘোষণায় লালা লাজপৎ রায় করেননি প্রস্তাবটা? তারও চার বছর আগে ১৯২০ সালে বাদাউন থেকে প্রকাশিত ‘জুলকারনাইন’ (চোখের আলো) পত্রিকায় গান্ধীজির কাছে খোলা চিঠিতে এ প্রস্তাব করেননি আব্দুল কাদের বিলগ্রামী? সেটাও প্রথম নয়। তারও আগে ১৯১৮ সালে দু’জন ভারতীয় ছাত্রনেতা ইতিহাসে সর্বপ্রথম স্টকহলমের (সুইডেন) ছাত্র-কনভেশনে এ প্রস্তাব করেন। নিরেট সত্য দলিল এসব। এ সত্যগুলো ধামাচাপা কেন?
ফিরে আসি রক্তবীজে। ১৯৪৭ সালের শুভঙ্করের ডাইনির সুন্দরী চেহারার আড়ালে রা¶সী রূপ যখন প্রকাশ পেল, তখন একাত্তরকে আসতেই হল এই বাংলায়। যে দানবকে যুগ যুগ ধরে মনে হচ্ছিল অপরাজেয় তাকে ধরাশায়ী করতে সময় লাগল মাত্র নয় মাস। মুক্তি পাগল মানুষের হাড়মাংস দিয়ে গড়া অনন্য কাহিনী সেসব। অভ‚তপূর্ব সে মৃত্যু-মিছিল। এক যায় আর এক আসে। ছবির পর ছবি।
১৯১৫ সালের প্রথমদিক। কাবুলে শীতের রাত। বাইরে ঝুরঝুর বরফ আর বন্ধ ঘরের ভেতরে ম্লান আলোয় টেবিলের কাগজে ঝুঁকে পড়া অবিস্মরণীয় কয়েকটি মুখ। বাঙময় চোখ, রুদ্ধ আবেগে কম্পিত কণ্ঠ, গভীর নিঃশ্বাসে ইতিহাসের ছিন্ন একটা অধ্যায়, স্বাধীন অখণ্ড ভারতবর্ষের একটা রেখাচিত্র অস্পষ্টে ফুটে উঠছে সেখানে। গড়ে উঠছে
স্বাধীন সরকার ও পতাকা।
মহেন্দ্রপ্রতাপ, বরকতুল্লা, অম্বাপ্রসাদ, অজিত সিং। গড়ে উঠছে স্বাধীন সরকার ও পতাকা। সুদূর কাবুলে গোপনে। কাবুল থেকে পুরো ভারতবর্ষ হয়ে সিঙ্গাপুর পর্যন্ত তৈরি হয়ে আছে ল¶ ল¶ রাসবিহারী, হাফিজ আব্দুল্লা, মদনলাল ধিংড়া, মঙ্গল পাণ্ডে, অরবিন্দু বসু (ঋষি অরবিন্দ পরবর্তীকালে), ডাণ্ডি খান, কর্তার সিং। রুদ্ধশ্বাসে প্রহর গুনছে মহাকাল। অস্থির ঢেউ খেলে যাচ্ছে বঙ্গোপসাগরের বুকে। তীক্ষè চোখে তাকিয়ে আছেন বাঘা যতীন, চিত্তপ্রিয় – বার্লিন থেকে মানবেন্দ্র রায়ের (এম. এন রায়) পাঠানো অস্ত্র ভর্তি জাহাজটা কখন এসে পৌঁছবে! আর যে দেরি নেই। দিন আগত ঐ! ১৯১৫ সালের ২১শে ফেব্রæয়ারী (একুশে ফেব্রæয়ারী!) – এক লহমায় জেগে উঠবে লক্ষ লক্ষ মুক্তিসেনা। কাবুল থেকে সিঙ্গাপুর। স্বাধীনতা চাই। জন্মগত অধিকার চাই। টিকটিক চলছে ঘড়ি। সুদূর লণ্ডনে পরাক্রমশালী বৃটিশ জাতির ম¶িরাণী কুইন তখন পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ পালঙ্কে নিদ্রিতা।
ধীরে, খুব ধীরে মাথা তুলে উঁকি দিল গোলাম আজম, আবদুল আলীমের পূর্বপুরুষ, কৃপাল সিং, নবাব খান। খবর চলে গেল রাজশক্তির সামরিক কেন্দ্রে। একুশের আগেই একাত্তরের পঁচিশে মার্চ ঝাঁপিয়ে পড়ল ১৯১৫ সালে। মারণাস্ত্রে সজ্জিত বিশাল বাহিনী। গণহত্যা, ধর্ষণ। দাউদাউ জ্বলে গেল ‘পথের পাঁচালী’র নিশ্চিন্দিপুর। লক্ষ লক্ষ বর্গমাইল জুড়ে লক্ষ লক্ষ বিকৃত বীভৎস মৃতদেহে “কাঁপিল গগন শত আঁখি মুদি, নিভায়ে সূর্যতারা”। জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে গেল মুক্তিপাগল মানুষগুলো। অমৃতের শিশুরা ধরণীর খেলা শেষ করে ধূলোমাখা দেহে ঘরে ফিরে গেল। বাসাংসী জীর্ণানী যথা বিহায়, নবানি গৃহ্নাতি নরোহপরানি…..!!!!!
ইতিহাসের জঠরে গড়ে উঠছে একাত্তরের ভ্রণ, নড়ে উঠছে যন্ত্রণায়।
গল্প নয়, কল্পনা নয়, সেই দুর্গম পথযাত্রীদল। পরাধীন দেশের রাজবিদ্রোহী, মুক্তিপথের অগ্রদূত। অগ্নিগিরির শতধা বিস্ফোরণে ল¶ ল¶ মাতৃভক্তের সুকঠিন আত্মোৎসর্গ।
“চারিদিকে মিলি যতেক ভক্ত, স্বর্ণবরণ মরণাসক্ত,
দিতেছে অস্থি দিতেছে রক্ত, সকল শক্তি সাধনা,
জ্বলি উঠে শিখা ভীষণ মন্দ্রে, ধূমায়ে শূন্যে রন্ধ্রে রন্ধ্রে,
লুপ্ত করিছে সূর্য্যচন্দ্রে, বিশ্বব্যাপিনী দাহনা”।
শরীর চলে যায় জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যায়, স্বপ্ন বেঁচে থাকে। এবার সে স্বপ্ন গিয়ে উঠল পাহাড়-অরণ্যানীর আসামে। আবার ঝলসে উঠল স্বাধীন সরকার। মুকুন্দ কাওতি, কনকলতার হাতে স্বাধীন পতাকা। আবার সেই গোলাম আজম, মওলানা মান্নান টিক্কা-নিয়াজীর পূর্বপুরুষ। আবার সেই সশস্ত্র বাহিনীর নারকীয় তাণ্ডব। রক্তাক্ত হয়ে মাটির সাথে মিশে গেল, পিষে গেল হাজার হাজার যতীন মাঝি, হাজার মুক্তিযোদ্ধার লাশ। স্বপ্ন ততদিনে পৌঁছে গেছে বোম্বের সিতারা প্রদেশে, বিহারের ভাগলপুরে, যুক্তপ্রদেশের বালিয়ায়। টগবগ করে ফুটছে সারা ভারত, বিশেষ করে বাংলা।
“এ যেন বিপুল যজ্ঞকুণ্ড, আকাশে আলোড়ি শিখার শুণ্ড,
হোমের অগ্নি মেলিছে তুণ্ড, ¶ুধার দহন জ্বালিয়া,
নরনারী সবে আনিয়া ত‚র্ণ, প্রাণের পাত্র করিয়া চ‚র্ণ,
বহ্নির মুখে দিতেছে পূর্ণ, জীবন আহুতি ঢালিয়া !!”
আবার সেই স্বাধীন সরকার, সেই প্রলয়ের তাণ্ডব। আবার সেই হাজার মৃতদেহ, ধর্ষিতা রমণী। স্বপ্ন গিয়ে উঠল সিঙ্গাপুরে। ক্যাপ্টেন ডাণ্ডি খাঁর হাতে উড়ছে স্বাধীনতার পতাকা। আবার স্বাধীন জাতীয় সরকার, থাইল্যাণ্ডে, ইন্দোনেশিয়ায়। আবার টিক্কা-নিয়াজী, আবার গোলাম আযম। মাটির সাথে মিশে গেল অগণিত স্বাধীনতা সৈনিক। স্বপ্ন ফিরে এল বাংলায়, মেদিনীপুরে। আবার উঠল ঝড়। “দংশন ¶ত শ্যেন বিহঙ্গ যুঝে ভুজঙ্গ সনে!।” স্বাধীন বেতারকেন্দ্রে তখন নেতৃত্ব দিচ্ছেন ড: লোহিয়া। গল্প নয়, নয় কল্পনা। হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যবদ্ধ সেই স্বাধীন সরকার, জীবন ও মৃত্যু শব্দ দু’টো যেন মিলেমিশে একাকার। সমস্ত মেদিনীপুরের জনতা তখন একাত্তরের বাংলাদেশের মতো মরিয়া। আগুন, আগুন চারিদিকে। স্বাধীনতা চাই, চাই জন্মগত অধিকার।
“বায়ুদলবল হইয়া ¶িপ্ত, ঘিরিঘিরি সেই অনল দীপ্ত,
কাঁদিয়া ফিরিছে অপরিতৃপ্ত, ফুঁসিয়ে উষ্ণ শ্বসনে।”
নরকের মতো সামরিক বাহিনী আর রাজাকার দলের সাথে হাত মিলিয়ে এবার পুরো মেদিনীপুর জুড়ে নেমে এল প্রাকৃতিক ঘূর্ণিঝড়। ঘরবাড়ি ¶েত ভেঙে একাকার। বিন্দুমাত্র খাবার বা সাহায্য আসতে দেয়া হল না বাইরে থেকে। রক্তাক্ত হয়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে ভেঙে চুরমার হয়ে গেল ¯^াধীন সরকার ও ¯^াধীনতা সৈনিক দল, মচকাল না একবিন্দু।
শির নেহারি তার সম্ভ্রমে নতশির ঐ শিখর হিমাদ্রির।
অল¶ে গড়ে উঠছে একাত্তরের বিশাল দেহ।
সামরিক বাহিনীর ওপর অস্ত্রহাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে মাটিতে পড়ে রইল তিয়াত্তর বছরের মাতঙ্গিনী হাজরা ও তাঁর দল। বুলেটে বুলেটে ধুলোর মতো উড়ে গেল বারো বছরের বিদ্রোহিনী ফুলেশ্বরী। এই কেয়ামতের মধ্যে চট্টগ্রামে কোন্ সে অঙ্কের মাষ্টার সূর্য সেন অন্ধকারের গহŸর থেকে উপড়ে নিয়ে এল ¯^াধীনতার সূর্য, ঝলমল করে উঠল তাঁর রিপাব্লিকান আর্মি! আবার, “জ্বলি উঠে শিখা ভীষণ মন্দ্রে।” বিশ্বাস হয় না, ১৪ বছরের ছেলে ট্যাগরা মাস্কেট্রি রাইফেল দিয়ে ঠেকিয়ে রাখছে গোঁটা একটা সৈন্যবাহিনী। তারও আগে কে ওই ফকির মজনু শাহ্, সন্ন্যাসী ভবানী পাঠক একল¶ সন্ন্যাসী ফকির নিয়ে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ছে কলকাতার ওপর! অমানিশার এই তাণ্ডবের মধ্যে কে ওই ছুটে বেরিয়ে গেল বাংলা থেকে, পার হয়ে গেল পাহাড় সমুদ্র আর ইতিহাসের সীমানা। খাইবার, কাবুল, রোম, বার্লিন হয়ে তিনমাসের সাবমেরিনে জাপান! সিনর অরল্যাণ্ডো ম্যাজোট্টা ওরফে সুভাষ বোস ওরফে নেতাজী! কিংবদন্তীর অগ্নিপুরুষ রাসবিহারী ওই কার হাতে তুলে দিচ্ছে ¯^াধীন সরকারের সশস্ত্র সামরিক বাহিনী, জেনারেল মোহন সিং, ব্রিগেডিয়ার শাহনেওয়াজ মেজর ধীলন! কার গর্বিত পদভরে টলমল করছে বার্মা থাইল্যাণ্ড, সিঙ্গাপুর, হংকং। সুভাষ চন্দ্র বোস ! হিজ এক্সেলেন্সি চন্দ্র বোস! গহীন অরণ্যে ধুঁকে ধুঁকে প্রাণ দিল ল¶াধিক মুক্তিবাহিনী। তবু ¯^াধীনতা চাই, জন্মগত অধিকার চাই।
কে এরা? এরাই কি সেই মহাবিদ্রোহী ভৃগু, রাগে দুঃখে বিরাট পিতার বুকে এঁকে দেবে পদচিহ্ন!
ইতিহাসের জঠরে যন্ত্রণায় জন্ম নিচ্ছে ভবিষ্যতের শেখ মুজিব। জন্ম নিচ্ছে মানচিত্র ভাঙাগড়ার সুদক্ষ কারিগর বাংলার তাজ, তাজউদ্দিন। জন্ম নিচ্ছে একাত্তরের লক্ষ কাদের সিদ্দিকী, জাহাজ-মারা হাবীব, আনোয়ারুল আলম শহীদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রির নূরন নবী, বাল্যবন্ধু শহীদ মাণিক (যার নামে ঢাকার মাণিকনগর) আর লক্ষ তারামন বিবি। ¯^প্ন নয়, গল্পও নয়। মানুষের হাড় দিয়ে তৈরি মানুষের ইতিহাস। চব্বিশ ঘণ্টায় নয় সে ইতিহাসের দিনরাত। কয়েক শতাব্দী লেগে যায় এক রাতের আঁধার কাটতে।
মানব ও দানব, দুই প্রবল প্রতিপক্ষ সৃষ্টির আদি থেকে লড়ে যাচ্ছে পরস্পরের সাথে। রক্তবীজের বংশ দু’জনেই। এক মরে তো একশ’ গজিয়ে ওঠে চোখের পলকে। স্বপ্ন শুধু স্বাধীনতার। স্বপ্ন নয় শত বছরের লক্ষ লক্ষ মৃতদেহের বিভীষিকা, জ্বলন্ত গ্রাম, ল¶ বিদ্রোহি-বিদ্রোহিনী। গল্প নয় বাহান্নর ভাষা আন্দোলনে গ্রেপ্তারকৃত সাত বছরের বালক মেজবাহউদ্দিন। গল্প নয় শূন্যে ছুড়ে দেয়া শিশুর নেমে আসা আদরের দেহ বেয়নেটের ওপরে। একজন নয়, সংখ্যাতীত। আর, একাত্তরে? …
“হাত পা চোখ কষে বাঁধা, হুমড়ি খেয়ে পড়লাম কিছু লোকের ওপরে, সবাই বন্দি। শুরু হলো প্রহার। সবাই চিৎকার করে কাঁদছে, রক্তে ভেসে যাচ্ছে ঘর। ওপর তলা থেকে ভেসে এল মেয়েকণ্ঠের আর্তনাদ। প্রহারের চোটে সবাই প্রায় অজ্ঞান। কে আমার বাঁধন খুলে দিল। কচি কণ্ঠ, আট-নয় বছরের একটি বাচ্চা ছেলে। দু’হাতের চামড়া কাটা, হাত ফোলা…।”
আর লিখতে ইচ্ছে করে না।
লেখা যায়ও না।।
লেখকের “বাংলার কথা কই” বইয়ের “একাত্তরের রক্তবীজ” অধ্যায়