-তাহমিনা শহীদ
দুটো চাকুরী ক’রে ঘরে ফিরতে ফিরতে ওর প্রায় প্রতি দিনই সন্ধ্যা -রাত্তির হয়ে যায় ।
প্রবাসী শীতের বেলাতেও পাঁচটা বাজতে না বাজতেই ভারি আঁধার ক’রে আসে চারদিকে ।
এমনি আজ অন্যান্য দিনের মত অতটা ক্লান্তি ঘিরে ধরেনি ব’লেঘরে ঢুকে পোষা বিড়ালটিকে এক মুঠো খাবার খেতে দিয়ে , বাইরের পোশাক না ছেড়েই রাঁধতে লেগে গেল সে ।
মনটাও বেশ হাল্কা লাগছে খুব । আগামী সপ্তাহে মোটমাট চার চারটি দিন একসঙ্গে থ্যাংকস গিভিং’এর ছুটি পাওয়া যাবে ,
এই ভেবে এখনই যেন মন হয়ে গেল উজান পবনের নাও !!!
এক চুলোয় ভাত , আরেক চুলোয় আলু সিদ্ধ করতে দিয়ে দ্রুত হাতে মৃগেল মাছের পেটির দিকের কয়েকটি বরফ হয়ে যাওয়া টুকরো হাতে ক’রে কলের তলে গরম জলে আশ ছাড়াতে লেগে গেল ।
আর মৃগেল মাছ ধুতে গিয়ে যথারীতি বাংলাদেশের অবিস্মরণীয় সেই অতি রোম্যান্টিক গানটি ওর মনে পরবেই ———–
” কথা বলিস না’রে তুই/
ধরবো মৃগেল, চিতল্ রুই /
জাল ফেলিতে জ্বালাতন আর করিস না , করিস না /———–“
সত্যি , বাংলাদেশে যুগল কণ্ঠে এর চেয়ে বেশী রোম্যান্টিক গান আর সৃষ্টি হয়েছে কিনা ওর জানা নেই !!
মাঝ পথে স্বামীকে একবার ফস করে ফোনও ক’রে বসলো । জানতে চাইলো ,তার ঘরে ফেরার পথের আর কদ্দুর ——?
স্বামীকে গুন গুন ক’রে কয়েক লাইন গান শুনিয়ে জানান দিল , আজ মৃগেল মাছের ঝোল তরকারী রাঁধা হচ্ছে । একটু তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরলে দু’জনে কূজনে ——————————-
স্বামী তখন বাড়ীর পথেই ছিলেন , একটু ক্ষণ পরেই ঘরে ঢুকলেন ।
ঘোর নিশুতি ছাড়া এই রকম সাঁঝবেলায় ক্বচিৎই ওদের দেখা হয়ে উঠে । তা না হলে আর পরবাসের জীবন কেন !
স্বামীকে আজ অবেলায় পেয়ে একটু যেন আহ্লাদী হয়ে উঠতে চাইলো মন , তাই তড়বড় ক’রে তরল গলায় বলে বসলো ——‘ বারো ঘণ্টা বাইরে কাজ ক’রে এসে গান গাইতে গাইতে এমনি রাঁধুনি বউ তুমি আর পাবে ?’
কী অকপটে আজকাল কথা বলতে শিখে গেছে ও’ , নিজের দিকে মাঝে মাঝে নিজেই অবাক হয়ে তাকায় ।
ভাবে, সারা জীবন নিশ্চুপ না থেকে এমনি মুখরা রমণী হয়ে থাকলে বেশ হোতো কিন্তু ।
অন্য অনেক বঁধুদের মত স্বামীকে নিজের কিছুটা বশে রাখতে পারতো হয়ত ।
হয়ত , স্বামী বশীকরণ মন্ত্রটা জানা ছিলোনা বলেই ,নিজের মূল্যটা আজো যাচাই করা হয়ে উঠলো না !
হয়তো , হয়তো ——————————
ওদিকে ঘরে ঢুকে কিছু পরেই স্বামী যথারীতি ওর সমগ্র আবেগে বেশ খানিকটা শীতল জল ঢেলে
গম্ভীর মুখে জানিয়ে দিলেন যে ,মাত্র কিছুক্ষণ আগেই বাইরে ডিনার সেরে ফেলবার কারণে এই মুহূর্তে তাঁর ক্ষুধা অথবা তৃষ্ণা কোনটিই আর অবশিষ্ট নেই । সত্যিতো , ক্ষুধার সময় নিয়ম মাফিক খেয়ে নেয়াটাইতো কাজের কথা ।
অগত্যা স্নান সেরে বঁধু একাই আসন পেতে বসলেন ।
গরম গরম ভাতের ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় হাতের চুড়ির শব্দ তুলে কোনমতে খাবার দলা দলা গলাধঃকরণ ক’রে , দ্রুত হাতে রান্নাঘর গোছাতে ব্যাস্ত হয়ে পড়লো সে ।
বাইরে ঝিম অন্ধকার। শত চেষ্টা করেও মেঘের আড়াল থেকে ওর চাঁদের দেখা না পেয়ে শয্যায় নিজেকে সঁপে দিয়ে ঘুমের পরীদের সন্ধানে হাতড়ে ফিরল ———–
এখন আর আনন্দের গান আসছেনা ,বদলে শুভমিতার ওই গানটি সুড়সুড়ি দিয়ে উঠলো গলায় ———–
“নিঝুম নিঝুম রাতে ,আয় ঘুম-পরীদের সাথে/
একটু আমাকে ছুঁয়ে যা , স্বপ্নের আবেশে ধুয়ে যা /
———–শুনে যাও বন্ধু , শুনে যাও স্বজন , এ জীবন কত কী দিলো /
দিলো হেরে যাওয়া , একা একা ভাসানের কান্না দিলো /
সেই কান্নাটাকে , যদি দিই তোমাকে , পারবেনা চিনতে তাকে ! /
তাই ঘুম, আমাকে নিয়ে যা , স্বপ্নের আবেশে ধুয়ে যা ——-/
নিঝুম নিঝুম রাতে , আয় ঘুম-পরীদের সাথে ——————“
ঘুম ,ঘুম ,ঘুম ——এই ঘুম ওর ভাঙ্গবে খুব ভোরে , তখনো অন্ধকার থেকে যাবে বাইরেটা । দম দেয়া ঘড়িটির বিচ্ছিরী , কর্কশ শব্দে প্রবাসী বঁধুকে যে জাগতেই হবে ————–!
আকাশে ওর অপেক্ষায় তখন ওর চাঁদটি থাকতেও পারে হয়ত ।
ওই চাঁদ ,ওর একান্ত বাধ্যগত চাঁদ, ওকে আঁধারে বেরোতে দেখে, তখন হয়তো সারারাত বিরহ যন্ত্রণায় কাটানোর আকুলতায় গেয়ে উঠবে —-
“———–ভবনের বঁধুরে ডাকে দূরের বিরহী , পূবালী পবনে বাঁশী বাজে রহি রহি ———-“
দম দেয়া ঘড়িটির বিচ্ছিরী , কর্কশ শব্দে প্রবাসী বঁধুকে যে জাগতেই হবে ——