হিমেল মাহমুদ, ঢাকা
১। আমার বাবা একজন কট্টর আলেম। বয়স হয়ে যাওয়ায় মাদ্রাসার শিক্ষকতা ছেড়ে দিয়ে এখন সারাক্ষণ ঘরেই বসে থাকেন। ঘরের সকলের প্রতি পদে পদে ধর্মীয় নানা বিধিনিষেধ আরোপ করাই ওনার একমাত্র কাজ। সবসময় এটা করা যাবে না, ওটা করা যাবে না-এই নিয়েই থাকেন। আমি আর মা একটু জোরে হেসে উঠলেও ওনার কড়া গলার ধমকানি শুনতে হয়!
—আমার বাবার মত এমন একনায়ক পৃথিবীর আর কোথাও আছে কি-না আমি জানি না। ওনার কথার উপর আর কারো কথা চলে না-ওনারটাই সর্বশেষ কথা। এসব কারণেই মায়ের সাথে বাবার চব্বিশ ঘণ্টা খিটিরমিটির লেগেই থাকে! বাবাকে জীবনে কোনদিনও দেখলাম না মা’র সাথে একটু মিষ্টি করে হেসে কথা বলতে।
—আমার এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট বের হলে দেখা গেল আমি সর্বোচ্চ ভাল রেজাল্ট করে এসএসসি পাস করেছি।
—এই খবর শুনে খুশি হয়ে বাবা কোথায় মেয়ের জন্য এক প্যাকেট মিষ্টি কিনে নিয়ে আসবে তা না, আমাকে ওনার রুমে ডেকে নিয়ে বললেন-রুনু শোন, তুই মেট্রিক পাস করেছিস শুকর আলহামদুল্লিাহ। এরপর আর কলেজে যাওয়ার নাম নিবি না। আমি এতবড় একটি মেয়েছেলেকে কলেজে পাঠিয়ে জাহান্নামে নিজের ঠিকানা বানাতে চাই না। তোর এখন বিয়ের উপযুক্ত বয়স হয়েছে, প্রস্তুত হয়ে যা। আমার কাছে তোর বিয়ের কিছু ভাল ভাল পয়গাম আছে।
—বাবাকে মুখের উপর কিছু বলার সাহস আমার কোনদিনও ছিল না, আমি চোখ মুছতে মুছতে মা’র কাছে গিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলি। আনন্দের দিন কান্না!
—পরের দিন থেকে বাবা আমাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লাগলেন। দিন কয়েক পর বাবা তার পূর্ব পরিচিত মাঝবয়সী এক ভদ্রলোককে নিয়ে ঘরে হাজির। ক্যান্সার আক্রান্ত ভদ্রলোকের বউ মারা গেছে ছয়মাস আগে, ঘরে আছে ছয় ও তিন বছরের দুটি বাচ্চা শিশু। এখন ওনি দ্বিতীয় বিবাহের জন্য পাত্রীর সন্ধানে আছেন। কুমারি মেয়েই ওনার প্রথম পছন্দ !
—আমি আর মায়ের অনেক আহাজারিতে বাবার পাথুরে হৃদয় কিছুটা হলেও দ্রবীভূত হয়।
—বিয়ে আপাতত বন্ধ-মেয়েকে কলেজে পাঠাবে।
আমি সত্যিই খুব দুখিনী একটা মেয়ে। এই যে ঢাকার একটি নামকরা কলেজে পড়ছি এর পেছনে কত অশ্রু বিসর্জন দিতে হয়েছে তা কেবল আমিই জানি!
—কলেজের বান্ধবীরা সবাই মিলে কত মজা করে, বন্ধুদের সাথে হই-হুল্লা, আড্ডায় মেতে উঠে; আমি দু’একজন বান্ধবী ছাড়া কারো সাথে মিশতেই পারি না। নিজেকে সবসময় গুটিয়ে রাখি। বন্ধুদের সাথে মেলা-মেশা করা সে তো অনেক দূরের কথা, তাদের সামনে কোনদিন নিজের চেহারাটা পর্যন্ত খুলি না, সবসময় নেকাব দিয়ে চেহারা ঢেকে রাখি!
—আশেপাশের যারাই আমাকে দেখেছে সবাই বলে আমি নাকি দেখতে ভীষণ সুন্দরী। অন্তত আমারও তাই ধারণা! মাঝে মাঝে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চেহারা দেখে নিজেই মুগ্ধ হয়ে যাই- ‘আমি এত্তো সুন্দর!’
—কলেজ থেকে বন্ধু-বান্ধবরা সবাই মিলে কক্সবাজার শিক্ষা সফরে গেল। ওরা সবাই আমাকে কত চাপাচাপি করল-আমার নিজেরও জীবনে একবার কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত দেখার কত শখ ছিল কিন্তু আমার কোন শখই যেন পূর্ণ হবার নয়!
—লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে বাবার হাতে-পায়ে পড়লাম। কত অনুনয়-বিনয় করলাম। অনুমতি মেলেনি। সোজা বলে দিলেন- ‘বিয়ের পর জামাইয়ের সাথে যেখানে ইচ্ছে যাবে, এখন লাফাঙ্গামী করার দরকার নেই!’
—সবাই চলে গেল, এক আমি পারলাম না।
ওরা সবাই ভেবে বসেছে আমি অসামাজিক আর অহংকারী! কিন্তু আমি ওদের কিভাবে বুঝায় আমার অসহায়ত্বের কথা, নিজের অপারগতার কথা!
—আমার জীবনে বিনোদন বলতে কিছু নেই। আমাদের বাসায় কম্পিউটার নেই, কোন টেলিভিশন নেই। এমনকি আমার মোবাইল ফোন ব্যবহার করার অনুমতি পর্যন্ত নেই! আমার জীবনের একমাত্র বিনোদন বলতে তিন বছর বয়সী ছোঁ ভাইটির ফোঁকলা দাঁতের অপূর্ব সুন্দর হাসি, আর তার ভাঙা ভাঙা শব্দে পাকা পাকা কথাগুলি!
—কলেজের কম্পিউটার ক্লাসে সবাই যখন জটিল জটিল সব প্রোগ্রামিং অনায়াসে ফট ফট করে ফেলে তখন কম্পিউটারের মাউস ধরতেই আমার হাত কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে যায়। আমার দিকে সবাই করুণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে!
২।
আমার কলেজ যাওয়ার পথে একটি ছোঁ কালভার্ট পড়ে। কালভার্টটির ঠিক ওপারেই একটা বড় বটগাছ আছে। প্রতিদিনই দেখি বটগাছ তলায় হালকা দাঁড়িগোঁফ ওয়ালা বেশ সৌম্য চেহারার একটি ছেলেকে দাঁড়িয়ে থাকতে। রোজ সেই একই পোশাকে-পায়ে হলদে রঙের একজোড়া চপ্পল, পরনে নীল রঙের জিন্সের প্যান্টের সাথে ফিনফিনে পাতলা একটি সাদা সুতি কাপড়ের পাঞ্জাবি।
—দূর থেকে দেখা যায় ছেলেটি কাঁচুমাচু চেহারায় করুণ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি যতই কাছে আসতে থাকি ছেলেটি ততই একটু একটু করে নিজের চেহারা অন্যদিক আড়াল করতে থাকে। আমি যখনই একদম কাছে গিয়ে তার দিকে একটুখানি দুষ্টামির ছলে তাকাই সে সাথে সাথে তড়াক করে মুখ অন্য দিকে ঘুরিয়ে ফেলে! ওর এক কা-কারখানা দেখে আমার বেশ হাসি পায়।
—একরকম নিয়ম করেই একই জায়গায় রোজ দাঁড়িয়ে থাকে ছেলেটি।
প্রতিদিনই হয়ত আমাকে কিছু একটা বলার কঠিন পণ প্রতিজ্ঞা নিয়েই ঘর থেকে বের হয় সে কিন্তু সাহসে যে কুলায় না। ভীতু স্বভাবের ছেলেটির জন্য আমার ভীষণ মায়া হয়।
—আমি একটু আগ্রহ দেখিয়ে সামনে গেলেই হয়ত সে তার মনের কথাটি বলে দিত। বেচারার সে সৌভাগ্য কোনদিনই হয়ত হবে না!
—একদিন ঝুমঝুম বৃষ্টির দিনে কলেজ থেকে ফেরার পথে তাকে একই ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমি পুরো স্তব্ধ হয়ে যাই! সেই ফিনফিনে পাতলা পাঞ্জাবি ভিজে গিয়ে পুরোপুরি শরীরের সাথে লেপ্টে গিয়ে তার সুঠাম দেহখানা সম্পূর্ণ ভাবে প্রকাশ হয়ে পড়েছে। শীতে একটু একটু কাঁপছে তার শরীর। দেখে আমার কি যে কষ্ট লাগছিল। ইচ্ছে করছিল তার হাত দুটি মুঠোয় পুরে নিয়ে বলি-
তুমি যেমন আমাকে পছন্দ কর, ঠিক তেমনি আমিও তোমাকে পছন্দ করি। চল না, একই সাথে দু’জন বৃষ্টিতে ভিজি!
—এর চার-পাঁচ দিন পর বৃষ্টিস্নাত এক বিকেলে পড়তে পড়তে হঠাৎ কখন যে ড্রইংরুমের সোফায় ঘুমিয়ে পড়ি ঠিক জানি না।
—দেখতেছি আমি আর বটগাছ তলার ঐ নাম না জানা ছেলেটি হাত ধরাধরি করে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে নির্জন এক পাহাড়ি পথে হেটে যাচ্ছি। তার পরনে সেই একই পাঞ্জাবি, সেই হলুদ রঙা চপ্পল জোড়া। আমি তাকে জিগ্যেস করে বলছি- তোমার কি এই একটি পাঞ্জাবি ছাড়া আর কোন পাঞ্জাবি নেই? সে শরম পেয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল এমন সময় বিকট শব্দ করে সামনে এসে দাঁড়ালেন বাবা! ভয়ে আমি চিৎকার দিয়ে উঠি। আমার ঘুম ভেঙে যায়। দেখি বাবা সত্যি সত্যি সামনে দাঁড়িয়ে আমাকে জোরে জোরে ধমকাচ্ছেন “রুনু, তোর কি আক্কেল-জ্ঞান বলতে কিছু নেই? এতবড় ধামড়া একটা মেয়ে এভাবে সোফায় শুয়ে থাকে? বেআক্কেল
কোথাকার ! এক্ষুণি যা এখান থেকে!”