সাঈদ তারেক
৩৫ কোটীর দেশ আমেরিকায় এ পর্যন্ত মোট আক্রান্ত প্রায় ১৩ লাখ, মৃত্যু ৭৭ হাজারের কিছু বেশী। আক্রান্ত মোট জনসংখ্যার অর্দ্ধ শতাংশেরও কম এবং মৃত্যু আক্রান্তের পাঁচ পার্সেন্টের কিছু বেশী। আমাদের ১৮ কোটীর দেশে আজ পর্যন্ত আক্রান্ত বা সনাক্ত ১৪ হাজারের কাছাকাছি। এটা অফিশিয়াল হিসাব। ধরে নিলাম এর বাইরে আরও আছে। দ্রুত পরীক্ষা করানোর ব্যবস্থা নাই, সনাক্ত হচ্ছে না। অনেকে আবার সনাক্তকরনের লাইনে থাকতে থাকতেই ভাল হয়ে যাচ্ছে, মারাও যাচ্ছে। যদি মন্ত্রীর কথাই ধরে নেই তাহলে শেষ পর্যন্ত সংখ্যা ৫০ হাজারে গিয়ে ঠেকলেও পার্সেন্ট হিসাবে তা হবে মোট জনসংখ্যার পয়েন্ট ০৩!
এ পর্যন্ত সারা বিশ্বে মোট আক্রান্ত ৪০ লাখ এবং মৃত্যু পৌনে ৩ লাখ। ৭ পার্সেন্ট। ইওরোপ আমেরিকার কথা বাদ দিলাম পার্শ্ববর্তী ভারতে আক্রান্ত ৬০ হাজার এবং মৃত্যু গতকাল পর্যন্ত ২ হাজার। হার ৩ শতাংশের কিছু বেশী। আমাদের দেশে সরকারি হিসাবে মৃত্যু ২১৪। ধরে নিলাম উপসর্গ নিয়ে মারা গেছে আরও সমান সংখ্যক। সব মিলিয়ে যদি ৪ শ’ও হয় তাহলেও তা এখন পর্যন্ত মোট আক্রান্ত অর্থাৎ ১৪ হাজারের ৩ শতাংশের কিছু বেশী। ভারতের মতই। আর যদি মৃত্যুর অফিশিয়াল সংখ্যা ২১৪ ধরি তাহলে মাত্র দেড় শতাংশ। সে হিসেবে দেশে আক্রান্ত এবং মৃত্যুর যে হার তাতে ভয়ে একেবারে কুকরে যাওয়ার মত সময় এসে গেছে বলে আমি মনে করি না।
পশ্চিম মুলত: ঠান্ডা অঞ্চল। তাছাড়া জনগোষ্ঠী সাধারনভাবে অষুধ এবং হাসপাতাল নির্ভর। আমেরিকায় মৃত্যুবরনকারিদের ৭০ শতাংশ আফ্রিকান-আমেরিকান, স্থানীয় বাংলাদেশীদের ভাষায় ‘কাউলা’। এরাই বেশী আক্রান্ত। এর পরের সংখ্যাটা ‘আমিগো’ অর্থাৎ হিসপ্যানিকদের। এই দুই শ্রেণীর মানুষের স্বাস্থ্য সচেতনতা একেবারেই কম। ‘কাউলা’রা শুধু খায়, যা পায় তাই খায়, যতক্ষণ মুখে মজা লাগে ততক্ষণ খায়। প্রিয় খাবার হচ্ছে চিকেন চিজ বাটার বার্গার বা যত রকমের জাঙ্কফুড। খেতে খেতে সবাই অল্প বয়সেই স্থুলদেহী হয়ে যায়। ফ্রি মেডিকেল, কিছু হলেই ডাক্তার হাসপাতাল। এভাবে অষুধের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতার কারনে এদের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নাই বললেই চলে। ফলে করোনায় ধরলে সর্বোত্তম চিকিৎসাসেবাও তাদেরকে বাঁচাতে পারছে না। নিউ ইয়র্কে ভেন্টিলেশনে নেওয়া ৮৮ পার্সেন্ট রোগী মারা গেছে। এবং এরা ছিল সবাই স্থুলদেহী।ইওরোপে মৃত্যুবরনকারিদের অর্দ্ধেকই বয়ষ্ক এবং জটীল রোগী। ইটালিতে রোগীর চাপ একপর্যায়ে বেশী হলে বৃদ্ধদেরকে চিকিৎসাসেবাই দেওয়া হয় নাই। ওরা এমনিই দাপাতে দাপাতে মারা গেছে। তাছাড়া ইওরোপে ইদানীংকালে ওল্ডহোম বা বৃদ্ধাশ্রমগুলোর ব্যপারে সরকারগুলো নতুন করে চিন্তাভাবনা করছিল। কোন কোন দেশ ব্যয় কমানোর উদ্যোগ নিয়েছিল। এর প্রতিবাদও হচ্ছিল। যাই হোক করোনার ধাক্কায় বিভিন্ন দেশের ওল্ডহোমগুলো অনেকটাই খালি হয়ে গেছে। ফ্রান্সে মৃত্যুবরনকারিদের প্রায় অর্দ্ধেকই ওল্ডহোমের বুড়ো-বুড়ি।
আমাদের দেশে সে অবস্থা নাই। দক্ষিণ পুর্ব এশিয়ার এই অঞ্চলে করোনার আক্রমন তুলনামুলকভাবে কম হওয়ায় বোঝা যাচ্ছে প্রকৃতিগতভাবে এ এলাকার মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশী। তাছাড়া ধর্মীয় জীবনাচার খাদ্যোপকরন কায়িক শ্রম- এসবও শক্তিশালী ইমিউনের জন্য সহায়ক হয়ে থাকতে পারে। আশংকাটা হচ্ছে আরাম আয়েশে থাকা গুটিকয় ‘ভদ্রলোকের’ জন্য- যারা সামান্য সর্দিকাশিতে ডাক্তারের কাছে ছোটেন, ডাক্তারের পরামর্শে অতিরিক্ত অষুধ সেবন করে শরীরের ইমিউন সিস্টেমের বারটা বাজিয়েছেন, ঘনঘন ডাক্তারের কাছে দৌড়াদৌড়ি করতে করতে নানা জটীল রোগ বাঁধিয়ে বসে আছেন।
কারও কারও মতে আমাদের এখানে সেকেন্ড স্টেজ চলছে। আমার হিসাবমতে থার্ড স্টেজের মাঝামাঝিকাল পার করছি। এ সময়টায় সনাক্তের হার বাড়াটাই স্বাভাবিক। টানা কয়েকদিন ১৩ ১৪ ১৫ করে দশের নীচে নেমে এসেছিল। আবার বেড়ে কাল পর্যন্ত ছিল ১৩ শতাংশের বেশী। আজ ১২রও কম। এ সময় দরকার ছিল পরীক্ষার হার বাড়ানো, সেটা করা হয় নাই, বা যায় নাই। সক্ষমতা যে নাই গোড়া থেকেই বোঝা গেছে। ফলে সব তালগোল পাকিয়ে গেছে। কাল বলা হলো আইইডিসিআর আর নমুনা সংগ্রহ করবে না, বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে নেওয়া হবে। টেলিভিশনের পর্দায় দেখি একএকটা কেন্দ্রে লম্বা লাইন। সারাদিন অপেক্ষা করেও আগ্রহীরা ফিরে আসছেন। বরঞ্চ ওখানে গা ঘেষাঘেষি করে লাইনে দাঁড়িয়ে হয় কাউকে করোনা দিয়ে আসছেন অথবা নিয়ে ফিরছেন। কোথায় সংগ্রহ হবে কোথায় পরীক্ষা হবে, কে কমপাইল করবে- অব্যবস্থার চরম! দরকার ছিল টেস্টিং ওপেন করে দেওয়া, গনহারে টেস্ট। যার ইচ্ছা নিজ খরচে টেস্ট করিয়ে নিতো। অথচ গনস্বাস্থ্যের কিটটাকেই এখনও আসতে দেওয়া হলো না। পিসিআর টেস্ট ছাড়া নাকি সঠিক রেজাল্ট আসে না। কাল দেখলাম খোদ আমেরিকাতেই ১৫ পার্সেন্ট টেস্টের রিপোর্ট ভুল প্রমান হচ্ছে। আমাদের এখানেও এমনটা যে হচ্ছেনা তা কেউ হলফ করে বলতে পারবে!
এই স্টেজে র্যাপিড টেস্টের বিকল্প নাই। এখনই যদি আক্রান্তদেরকে আলাদা করে ফেলা না যায় সংক্রমনের হার অনেক বেড়ে যাবে। অর্থনীতি সচল রাখতে আমাদেরকে অনেক কিছু কমপ্রোমাইজ করতে হচ্ছে, কিন্তু যদি একবার গনসংক্রমন শুরু হয়ে যায় চোখেমুখে কেউ পথ দেখবো না। আবারও বলছি ১৮কোটী মানুষকে ঘরে আটকে রাখা নয়, দরকার দ্রুত আক্রান্তদেরকে সনাক্ত করে আলাদা করে ফেলা। দেশকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে এর বিকল্প নাই। যুক্তরাষ্ট্র ইংল্যান্ড এখন সে ব্যবস্থাই নিচ্ছে।