সাঈদ তারেক
এক বছর। বোঝাই গেল না কোথা দিয়ে কেটে গেল সময়কাল। উনিশের চৌদ্দই জুলাই, মনে হয় এইতো সেদিন। সাবেক রাস্ট্রপতি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুর আজ এক বছর হয়ে গেল। গত বছর এই ফেসবুকেই তাকে নিয়ে একটি ধারাবাহিক কলাম লিখেছিলাম। পরবর্তীতে বাঙালা গবেষণা নামে একটি প্রকাশনা সংস্থা সেটি বই আকারে প্রকাশ করে। গত বই মেলায় তা বেশ ভাল বিক্রিও হয়। এই বইয়ের শেষ অংশে এরশাদকে নিয়ে একটি ছোট্ট মূল্যায়ন-নোট লিখেছিলাম। আজ তার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে নোটটি পুন:পোস্ট করছি।
‘আমি তাকে দেখেছি ১৯৮৩ সাল থেকে। তখন তিনি সিএমএলএ বা প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক। এর আগেও রয়েছে তার ব্যক্তি এবং কর্মজীবনের বিরাট এক পরিধি। তখন থেকেই তিনি আলোচিত প্রশংসিত নিন্দিত নন্দিত। আমার দেখার কাল থেকে তিনি সরকারপ্রধান সামরিক বাহিনী প্রধান রাষ্ট্রপধান দলীয় প্রধান। আবার ভাগ্য বিড়ম্বনায় ছয় বছর জেলবন্দী। বের হয়ে এসে রাজনীতিতে আলোচনায়। এমপি হবেন না- সিএমএইচে শুয়ে থেকে এমপি হয়ে গেলেন। সরকারের সাথে থাকবেন না প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দুত হয়ে গেলেন। ভোটারবিহীন নির্বাচনে বৈধতা থাকেনা, অনুগত বিরোধী দল হয়ে সরকারের লেজিটেমিসি দিলেন। জীবনের শেষ দিনগুলোতেও তিনি সরকারের জন্য একজন গুরুত্বপূর্ণ লোক হয়েই রইলেন। বিরোধীদলীয় নেতা হলেন। যাকে বলা হতো স্বৈরাচার, যারা বলতো মৃত্যুর পর তাদের গালে চপেটাঘাত করে পূর্ণ সামরিক এবং রাষ্ট্রিয় মর্যাদায় সমাহিত হলেন।
অনেকেই অনেক কথা বলেন তার সম্পর্কে, কিন্তু শেষ বিচারে আমি তো দেখি তার দিক থেকে তিনি সর্বাংশে একজন সফল মানুষ। পুরোটা ক্যারিয়ার জুড়ে নিজের মত করে চলেছেন বলেছেন করেছেন। এই পরিসরে আমি তার ব্যক্তি বা কর্মজীবনের মূল্যায়ন পর্যালোচনা বা বিশ্লেশনে যাবো না। কারন এটা আমার পক্ষে সম্ভব না। আমি দেখেছি এরশাদ জীবনের একটি নির্দিস্ট অধ্যায়কে। এর বাইরেও তার ছিল ব্যক্তি, পারিবারিক, একান্ত এবং সামাজিক জীবন। সব কিছু আমার দেখা বা জানার কথা না। যেহেতু সব কিছু মিলিয়েই একজন মানুষ, কাজেই খন্ডিত দেখায় কাউকে পূর্ণ মূল্যায়ন করা যায় না। সে কারনে ব্যক্তি হিসেবে তিনি কতটা ভাল-খারাপ ছিলেন, রাজনীতিক হিসেবে কতটা সফল ব্যর্থ সবটার চুলচেড়া বিস্লেশনের জন্য আমি কোন উপযুক্ত লোক নই। তারপরও কয়েক অধ্যায়ে তাকে যতটুকু দেখেছি তাতে আমার মনে হয়েছে, মানুষটি ছিলেন খানিকটা আবেগপ্রবণ, অস্থিরচিত্তের, সংবেদনশীল এবং একজন ট্যাক্টলেস রোমান্টিক পুরুষ। কানকথা শুনতেন, সহজেই প্রভাবাম্বিত হয়ে যেতেন, ব্যবহৃত হতেন। নিজের সিদ্ধান্তে স্থির থাকতে পারতেন না।
দোষে গুনে মানুষ। কিন্তু কাউকে মূল্যায়ন করতে গেলে দেখতে হয় কোন পাল্লা ভারী। এরশাদের নামে নানা অপবাদ যেমন আছে, তেমনি তিনি দেশের জন্য অনেকগুলো যুগান্তকারী কাজও করে গেছেন। ক্ষমতায় থাকাকালে অন্তর্কাঠামো এবং অবকাঠামোগত সংষ্কারগুলোর কারনে তার চিরস্মরনীয় হয়ে থাকা উচিত। কারন এমন কিছু কাজ তিনি করেছেন যা ছিল খুবই দু:সাধ্য। বৃটিশ বিদায়ের পর থেকে কেউ করতে পারে নাই। ক্ষমতায় থাকাকালে হুকুম দিয়ে কাউকে খুন করিয়েছেন এমন আমার জানা নাই। বিপদে মানুষের পাশে দাঁড়াতে দেখেছি। নীরবে অনেককে উপকার করে গেছেন। তার সাহায্যপ্রার্থীর সংখ্যা অজস্র। অনেক এতিমের দায়িত্ব গ্রহন করেছেন, অসহায়ের ভরনপোষনের ব্যবস্থা করেছেন। তার এই দিকগুলো কখনও প্রচারিত হতে দিতেন না। রাজনীতির ক্ষেত্রে আমার মনে হয়েছে ক্ষমতাচ্যুতির পর শত সীমাবদ্ধতার মধ্যেও তিনি প্রভাবমুক্ত স্বাধীন রাজনীতি করতে চেয়েছেন। কিন্তু জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত তাকে মামলার বেড়ি পড়িয়ে রাখা হয়েছিল। নানা স্বার্থ তাকে নিয়ে খেলেছে। শেষের দিকে মনে হয়েছে তিনি যেন মতলববাজী রাজনীতির এক অসহায় শিকার।এরশাদ সম্পর্কে একটি সাধারন প্রচারণা- তিনি স্বৈরাচার। ’৯০ পরবর্তী সরকারগুলো দেখার পর এই খেতাব তিনি কতটা প্রাপ্য, ভেবে দেখা যেতে পারে।”