‘কাজপাগল’ মানুষটির জীবন সংকটে। অথচ মনজুড়ে তার নিত্য পরিকল্পনা। এখনো যে কত কাজ বাকি!
না, মনোবল হারাননি তিনি। শরীরে বাসা বেঁধেছে দুরারোগ্য বেকার মাসকুলার ডিস্ট্রফি রোগ। মনের ঘরে তবুও জীবন জয়ের স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন প্রতিষ্ঠায় সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে, শারীরিক প্রতিবন্ধকতা ছাপিয়ে, সম্পূর্ণ নিজ উদ্যোগে তিনি গড়ে তুলেছেন পরিবেশ ও জলবায়ু জাদুঘর।
জাদুঘরটি সুধীমহলে সাড়া ফেলেছে। প্রায় প্রতিদিনই দূর থেকে অনেকে আসেন, বিশেষ করে স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা আগ্রহ নিয়ে পরিদর্শন করেন শাহীন রেজা রাসেলের জাদুঘর।
রাসেল মাগুরার শ্রীপুর উপজেলা সদরের বাসিন্দা। মদনপুরে তিনি জাদুঘরটি গড়ে তুলেছেন। প্রকৃতি ও পরিবেশের উপর ছোটবেলা থেকেই ভালো লাগা বা ভালোবাসা তার। কথাপ্রসঙ্গে জানালেন, যখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন, তখন সেখানে পরিবেশ সংগঠন ছিল না। ২০০৫ সালের কথা। তার নেতৃত্বে প্রিয় ক্যাম্পাসে তিনি প্রথম পরিবেশ সংসদ গড়ে তোলেন। এরপর ২০০৮ সালে প্রথম মাথায় আসে পরিবেশ জাদুঘর করবেন। করোনার সময় রাসেল বাড়ি ফিরে আসেন। তখনই মূলত তিনি তার ভাবনা বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য কাজ শুরু করেন।
শাহীন রেজা রাসেল বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। তাই এর ক্ষতিকর দিকগুলো মানুষকে ভালোভাবে জানানোর জন্যই আমি জাদুঘরটি করেছি। জাদুঘর পরিদর্শনে এসে নতুন প্রজন্ম বুঝতে পারবে কেন পরিবেশে দূষণ করতে হয় না, দূষণের ক্ষতিকর দিকগুলো কী, প্রাকৃতিক পরিবেশের উপর এর কী ধরনের ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে ইত্যাদি।’
‘এখন আকাশের দিকে তাকালে বর্ষার মেঘের পরিবর্তে শরতের মেঘের দেখা মেলে। সাম্প্রতিক সময়ে আইলা সিডর আম্পান এবং বিভিন্ন ধরনের ঘূর্ণিঝড় ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে আমাদের পরিবেশের উপরে ক্ষতিকর প্রভাব পড়েছে। আজকের যুব সমাজ যদি এই পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন হয়, তাহলে একদিন হয়তো পরিবেশ এবং জলবায়ু রক্ষার মধ্য দিয়ে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা সহজ হবে।’ বলেন রাসেল।
জাদুঘরটি ছোট কিন্তু তথ্যের ভাণ্ডার। সেখানে বিভিন্ন সাগর এবং নদ-নদীর পানি সংগ্রহ করে রাখা হয়েছে। রয়েছে বিভিন্ন ধরনের গাছের পাতা, বিভিন্ন ধরনের বীজ, কাঠ, বিলুপ্তপ্রায় বাবুই পাখির বাসা এবং আলোকচিত্র সংবলিত বিলবোর্ড। বিলবোর্ডে রয়েছে পরিবেশ এবং জলবায়ু সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের তথ্য।
রাসেল আরো বলেন, ‘আমার আশা ভবিষ্যতে দেশের যত প্রাণী আছে তার স্যাম্পল, যত নদ-নদী আছে সেই নদ-নদীর পানি, দেশের প্রত্যেকটি জেলার মাটি এখানে সংগ্রহ করে রাখবো। শুধু তাই নয়, সব ধরনের গাছের স্যাম্পল, বিভিন্ন ধরনের খনিজ পদার্থ, সকল প্রকার প্রাণীর মমি রাখবো। অর্থাৎ পরিবেশের সব উপাদানই এখানে থাকবে। আরো থাকবে বিভিন্ন ধরনের জার্নাল। যা থেকে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন ধরনের তথ্য পাবে। মূলত এসব কিছু নিয়ে এখানে ভবিষ্যতে গবেষণা হবে।’
রাসেল ২০১১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করার পর বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে চাকরিজীবন শুরু করেন। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও তিনি বর্তমানে এই দায়িত্ব পালন করছেন।
বেকার মাসকুলার ডিস্ট্রফি একাধিক রোগের সমন্বয়ে শরীরে বাসা বাঁধে। এই রোগে ক্রমাগত মাংসপেশীর ক্ষয় হয়। ফলে পেশী দুর্বল হয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে রোগীর প্রাণ সংশয় দেখা যায়। শহীন রেজার এ কথাগুলো অজানা নয়। তারপরও তার কাছে সুস্থ পৃথিবীর প্রত্যাশাটিই বড়ো। এ জন্য আমৃত্যু কাজ করে যেতে চান তিনি।