শাহানা আকতার মহুয়া, ভ্যাঙ্কুভার
‘There is no greater agony than bearing an untold story inside you.’
—Maya Angelou
কোনো লেখা পড়ে ভীষণভাবে ভাবার মতো বয়স নয়- এমন একটা বয়সে রিজিয়া রহমানের শিলায় শিলায় আগুন উপন্যাসটা পড়েছিলাম। প্রকাশের ক্ষমতা ছিল না কিন্তু আমার সত্ত্বাকে তীব্রভাবে জাগিয়ে দিয়েছিল শিলায় শিলায় আগুন। ভারত উপমহাদেশের প্রান্তসীমায় অবস্থিত বেলুচিস্তানের স্বাধীনচেতা মানুষ, যারা শতাব্দীর পর শতাব্দী সামাজিক, অর্থনৈতিক আর রাজনৈতিকভাবে বৈষম্যের শিকার, তাদের দেশপ্রেম, স্বজাত্যবোধের গৌরব আর সাহসের অনুপম শিল্পরূপ রিজিয়া রহমানের উপন্যাস শিলায় শিলায় আগুন। ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বেলুচিস্তানের বিদ্রোহ ও কালাতের যুদ্ধের পটভূমিতে রচিত হয়েছে এ উপন্যাস।
তারপর পড়লাম ‘রক্তের অক্ষর’। পড়ার পরে আবার স্তব্ধ হয়ে গেছি!
ভাষার গাঁথুনিতে, ছিলার মতো শব্দে, টানটান বর্ণনায় চোখের সামনে অদেখা বেশ্যাপল্লী, তাদের বেঁচে থাকা, প্রতিদিনের যুদ্ধ নিষ্ঠুরভাবে ফুটে উঠছে। উপন্যাসটি ঠিকমতো হল কিনা এটি জানার জন্যে লোক মারফত বইয়ের এক কপি যৌনপল্লীতে পাঠিয়ে ছিলেন লেখক। সেখানে পড়াশোনা জানা এক মেয়ে পড়ে বলেছিলেন, ‘যে লিখেছে, সে কোন বেশ্যাপাড়ায় থাকে?’
রিজিয়া রহমানের ‘রক্তের অক্ষর’ উপন্যাসটি প্রকাশিত হবার পরে সারাদেশে তুমুল আলোড়ন উঠেছিল। ‘রক্তের অক্ষর’-এ তীব্রভাবে উঠে এসেছিল ১৯৭১ সালে পাকদস্যু কর্তৃক ধর্ষিতা নারীদের স্বাধীন বাংলাদেশের সমাজে উপেক্ষা, করুণা আর অবজ্ঞার নিষ্করুণ চিত্র।
‘রক্তের অক্ষর’এর কেন্দ্রীয় ইয়াসমীনকে লেখক পুরোপুরি কল্পনা থেকে তুলে আনেননি। তিনি ইয়াসমীনকে দেখেননি কিন্তু জেনেছিলেন গোলাপী পট্টিতে এমন একজন মেয়ে আছে যে শিক্ষিত এবং তার চিন্তাভাবনাগুলো অন্যরকম। তথ্যদাতার বর্ণনার ওপর ভিত্তি করেই লেখক চরিত্রটা সৃষ্টি করেছিলেন। গোলাপী পট্টির বর্ণনা এতো জীবন্তভাবে তুলে ধরেছেন যে সেখানে না গিয়েও পাঠক স্পষ্ট দেখতে পান মানুষের আনাগোনা, দরাদরি, হাসাহাসি, ডাকাডাকিতে মুখর সরু গলি। সেখানে পিরু আর পারুলেরা একঘেয়ে নাকিসুরে নিজেদের শরীর আর পারদর্শিতার বর্ণনা করে লোক আকর্ষণের চেষ্টা করছে। বারো বছরের পিরু রোগা কাঠির মতো সরু হাত দিয়ে একজন মাঝবয়সী লোকের শার্ট টেনে ধরে অনুনয়-বিনয় করছে তার দেহটা কিনবার জন্য। খরিদ্দার তো জোটাতেই হবে, খরিদ্দার না পাওয়া মানেই মালিকের হাতে নির্মম নির্যাতন, “তার ওপর আছে ভয়, ক্ষুধা। যে ক্ষুধার শিকার হয়েই বেশিরভাগ মেয়ে ইচ্ছা-অনিচ্ছায় এই পট্টির আলো-বাতাস রুদ্ধ গলিতে ভাঙাচোরা ঘরে শুধু শরীর সর্বস্ব হয়ে উঠে এসেছে। প্রতিদিনের নির্মমতা, নিষ্ঠুরতা আর অমানবিকতায় হাজার হাজার বছর আগের দাসদাসী বিক্রির হাটের মতো কেনা-বেচায় ক্ষয়ে যেতে যেতে অন্ধকারের প্রাণী হয়ে বেঁচে আছে।”
হায় ক্ষুধা! হায় প্রপঞ্চ! যতদিন শরীরে শ্রী থাকে, লালস্য থাকে ততদিন এই অন্ধগলিতে আলো ছড়ানোর চেষ্টা নিয়ে এই পাঁকের মধ্যেই জীবনের মানে খুঁজে ফেরে জাহানআরা, শান্তি, জরিনা, রূপা আর আমিনারা। তারপর সময় বয়ে গেলে বুড়ি গোলাপজানের মতো বুকের ক’খানা পাঁজর সর্বস্ব অথর্ব শরীর নিয়ে এর ওর ঘরের সামনে দলা পাকিয়ে পড়ে থাকে।
রিজিয়া রহমানের উপন্যাসের ভাষা বড় তীব্র। প্রবল মুন্সিয়ানায় তিনি চরিত্রগুলো পর্যবেক্ষণ করেছেনÑ এমনকি রক্তের অক্ষরের ছোট এক চরিত্র কাজী সাহেবকে পড়তে গেলেও প্রচ- ধাক্কা খেতে হয়। নুরানী চেহারার কাজী সাহেবের কয়েকটি ঘর আছে বেশ্যাপল্লীতে, যেগুলো তিনি ভাড়া দিয়েছেন। ফেরেশতার মতো কাজী সাহেবের বড় দরদ পট্টির মেয়েগুলোর জন্য। সপ্তাহে সপ্তাহে আসেন ভাড়া তুলতে। ফুলমতি তার অসুস্থ বাচ্চার জন্য ঘরে লোক বসাতে পারে না, তাই তার ঠিক মতো খাবার জোটে না, বাচ্চার ওষুধ কিনতে পারে না, কাজী সাহেবের ঘরের ভাড়াও বাকী পড়েছে এক মাসের। কাজী সাহেব যখন মুখ ভেংচে বলেন “বেশ্যার আবার বাচ্চা কী-রে?” তখন মানব সন্তানের অপমান, ফুলমতির মাতৃত্বের অবমাননা আমাদের বুকে এসে তীরের ফলার মতো আঘাত করে। আবার এই কাজী সাহেব-ই বেশ্যার শরীর বেচা টাকা নিয়ে বাসার যাওয়ার সময় তার বড় মেয়েটাকে দেখে যাবার কথা বলতে গিয়ে স্নেহে আপ্লুত হয়ে ওঠেনÑ “বাৎসল্যের হাসি ছড়িয়ে পড়ল তার ঠোঁটের কোণে। নাতি-পুতি আইতাছে। মাইয়া কিছু খাইবার পারে না। যাওনের সময় দই কিনা লইয়া যামু এই ট্যাকা দিয়া।”
রক্তের অক্ষর’এর প্রধান চরিত্র ইয়াসমীন। বীরাঙ্গনা ইয়াসমীন। ইয়াসমীন ফিরতেই চেয়েছিল সমাজে-সংসারে। কিন্তু স্বামী, স্বজন সবার কাছে সে নষ্ট চরিত্রের মেয়ে। এমনকি ইন্টারভিউ বোর্ডের কর্মকর্তারাও চোখে মুখে নগ্ন ঔৎসুক্য ফুটিয়ে তোলে। ‘তুমি বীরাঙ্গনা, দখলদার সৈন্য তোমার ইজ্জত লুটেছে’। এক ইন্টারভিউতে একজন কুৎসিত কৌতুহলে প্রশ্ন করে বসে। ‘আপনি বীরাঙ্গনা! কেমন করে, কোথা থেকে ধরেছিল আপনাকে?” যেন বীরাঙ্গনারা ভিন্ন গ্রহ থেকে আসা প্রাণী, যেন তারা খোলা মাঠে সার্কাস দেখতে এসেছে! যেন তারা বারোয়ারী সম্পত্তি, চাইলেই যে কেউ চোখ দিয়ে, লালসা দিয়ে, লিপ্সা দিয়ে ভোগ করতে পারে।
ইয়াসমীনের চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হয়েছে, কে সেই সমাজ! যে সমাজ একটি নিঃসহায় মেয়েকে সাহায্যের হাত বাড়ায়নি, সে সমাজকে পারলে ইয়াসমীন খুন করত। একটি মেয়ের জীবনের বিনিময়ে যে সমাজ স্বাধীনতা কেনে, যে সমাজ প্রতিপত্তি কেনে, তাকে ইয়াসমীন ঘৃণা করে। সমাজের চারদিক থেকে প্রত্যাখ্যানের হুল যখন ইয়াসমীনকে একজন বীরাঙ্গনায় পরিণত করে তখন সভ্য সমাজের দাবীদার আমরা কি একটি বারের জন্যও লজ্জায় অপমানে জর্জরিত হই না? আমাদের স্বাধীনতার গর্ব কি ভূলুণ্ঠিত হয় না?
না, ইয়াসমীনের জয় হয়নি, ইয়াসমীনদের জয় হয়না। এটাই সত্য। এসব দলিত মানুষের জয় আমরাও বাস্তবে দেখি না তাই লেখক উপন্যাসের শেষে কোনও স্বপ্নবিলাস তৈরি করেননি।
রিজিয়া রহমান একই ছাঁচের লেখার মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। বিক্ষত সময় থেকে যেমন তুলে এনেছেন জীবন, যেমনি এঁকেছেন প্রেম, স্বপ্ন আর জীবনের জলছবি। তাঁর ‘ঘর ভাঙা ঘর’-এ বস্তি জীবনের ক্লেদাক্ত যন্ত্রণা মূর্ত হয়ে উঠেছে তেমনি আবার চট্টগ্রামের হার্মাদ জলদস্যুদের অত্যাচার এবং পর্তুগিজ ব্যবসায়ীদের নিয়ে তিনি লিখেছেন ‘উত্তর পুরুষ’।
উত্তর বাংলার সাঁওতাল জীবন নিয়ে লেখা তাঁর ‘একাল চিরকাল’ এক মহাকাব্যিক উপন্যাস। এ উপন্যাসে তিনি সাঁওতালদের জীবনচিত্র এঁকেছেন। আমাদের চোখ এবং ভাবনা যে দৃশ্যগুলো অবলীলায় এড়িয়ে যায়, সেগুলো তীব্রভাবে রিজিয়া রহমানকে আন্দোলিত করেছে। ‘একাল চিরকাল’ উপন্যাসটি লেখা প্রসঙ্গে বলেছেনÑ “ওই সময় যখন খনি থেকে কয়লা ওঠানোর জন্য নানা রকম পরিকল্পনা হচ্ছে। সবকিছু একবারে চূড়ান্ত পর্যায়ে, মাইন তৈরি করা হয়েছে। তখন আমার হাজব্যান্ড খুব ব্যস্ত থাকত। রেস্টহাউজ থেকে আমি একা একাই ঘুরতে চলে যেতাম। সে রকম একদিনে এক সাঁওতাল মহিলা আমাকে প্রশ্ন করেছিলÑ “তোমাদের এই খনি থেকে কী উঠবে? তাতে কি ভাত উঠবে? এই একটা প্রশ্ন তীরের মতো আমাকে বিদ্ধ করেছিল।” সাঁওতালরা খুব সরল এবং বঞ্চিত ছিল। এই আদিবাসীদের জীবন তাদের বঞ্চনা এবং তাদের জীবনে ভাতই যে প্রধান বিষয় ও চাহিদা, এ ধারণা থেকেই তিনি উপন্যাসটি লেখার প্রেরণা পান।
‘বং থেকে বাংলা’ উপন্যাসটি লিখেছেন বাঙালীর ইতিহাসকে তুলে ধরার জন্য। বাংলাদেশের জাতিগঠন ও ভাষার বিবর্তন নিয়ে উপন্যাসটির ব্যাপ্তি। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে বং গোত্র থেকে শুরু হয়ে একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিজয় পর্যন্ত এই উপন্যাসের বিস্তৃতি।
এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, “যে জীবন দেখেছি সেটাই লিখেছি”(এহ্সান মাহ্মুদ/আনন্দ আলো, ঈদ সংখ্যা)। খানিকটা নিভৃতচারী এবং প্রচার বিমুখ কথাকার রিজিয়া রহমানের বক্তব্য খুব সুস্পষ্ট। কোনও এক দায়বদ্ধতা থেকে, চেতনা খুঁড়ে খুঁড়ে একটার পর একটা অভূতপূর্ব লেখা লিখে যাচ্ছেন। তিনি বলেছেনÑ ‘আমরা আসলে আমাদের অভিজ্ঞতার বাইরে গিয়ে লিখি না। অভিজ্ঞতা বিভিন্ন রকমের হতে পারে। ‘ঘর ভাঙা ঘর’ লিখেছি বস্তির মানুষের গল্প নিয়ে। এক সময় আমার বাসার কাছেই বস্তি ছিল। সেখানকার ছেলেমেয়েরা আমার বাসায় আসতো। ওদের গল্প আমি শুনতাম। সেই ক্লেদাক্ত যন্ত্রণার কথা নিয়েই আমি লিখেছি ‘ঘর ভাঙা ঘর’।”
রিজিয়া রহমান লেখার প্রধান উপজীব্য অন্ত্যজ মানুষের জীবন, তাদের দুঃখ-বেদনা, জীবনসংগ্রাম এবং আশ্চর্যভাবে বেঁচে থাকা। তার অনুসন্ধানী এবং অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে উঠে এসেছে মানুষের জীবন, বেঁচে থাকার নিগূঢ়তম সত্য-সৌন্দর্য এবং বিচিত্রতা। বিষয়ের সাথে, চরিত্রের সাথে মিলেমিশে তাঁর উপন্যাস এবং ছোটগল্প হয়ে ওঠে একেকটা শিল্প। টানটান ভাষার প্রক্ষেপণ, বিষয়ের গভীরতা সর্বোপরি অন্তর্ভেদী উপলব্ধি লেখক রিজিয়া রহমানকে নারী লেখক-পুরুষ লেখকের বিতর্ক থেকে সরিয়ে নিয়েছে বহুদূরে। রক্তের অক্ষরপ্রকাশিত হওয়ার পর একজন নামি লেখক বলেছিলেন, “অশ্লীলতা ছাড়া এমন একটি লেখা লিখলেন কি করে? একজন পুরুষ যদি এটি লিখতো, তবে কালির দোয়াত উল্টে দিতো।”
অপ্রাসঙ্গিক হলেও উল্লেখ করা যায়Ñ মেয়েরা গল্প লিখছেন শুনে উনিশ শতকের অধিকাংশ পুরুষ নাক সিঁটকে ভেবেছিল ‘আরশোলার পাখি হওয়ার ইচ্ছে হয়েছে।’ বাংলার প্রথম আত্মকথার লেখিকা রাসসুন্দরী দেবী স্বামীর ঘোড়াকে দেখে ঘোমটা দিতেন। সেই সময় থেকে আমাদের নারী লেখকÑ পুরুষ লেখকের বিভেদটা তো ঘুঁচে গেছে।
যে সাহিত্য মানুষের জীবন ও জীবনসংগ্রামকে ধারণ করে, তা টিকে থাকে বহুকাল। শেকড় সন্ধানী রিজিয়া রহমানের সাহিত্যের অনন্য দিক হলো ইতিহাসে মানুষের প্রভাব ও অংশগ্রহণ। আর তাই তাঁর লেখায় মুক্তিযুদ্ধ, সামাজিক ও রাজনৈতিক দ্বন্দ, মানবিক বিষয়গুলো নানাভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। তাঁর অভিজ্ঞতার ভান্ডার যেমন বিশাল ও ব্যাপক তেমনি বৈচিত্র্যময়। বাঙালীর ইতিহাস, জাতিসত্তা, যুদ্ধ, ভাষা, চেতনা তার লেখায় এনে দিয়েছে বিশাল এক ব্যপ্তি। এই ব্যপ্তিটা আকাশের মতো বিশাল হলেও দুর্বোধ্য এবং দূরতর নয় বরং
খুব কাছের।