সেজান মাহমুদ
লেখক পরিচিতি:সেজান মাহমুদ একজন স্বনামধন্য কথাসাহিত্যিক, গীতিকার, ছড়াকার। পেশাগতভাবে চিকিৎসা বিজ্ঞানী এবং শিক্ষক। আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অব সেন্ট্রাল ফ্লোরিডা কলেজ অব মেডিসিনের সহকারী ডিন এবং প্রফেসর হিসাবে কর্মরত।
কোভিড-১৯ রোগ দিয়ে বিশ্বমহামারী হওয়ার কারণে সারা পৃথিবীর মানুষ অনেক বৈজ্ঞানিক তথ্য ও পদ্ধতি সম্পর্কে জেনে গেছেন যা আমরা ক্লাসরুমে পড়িয়ে আসছি দীর্ঘদিন ধরে। যেমন এখন একজন সাধারণ মানুষও জানে ‘হার্ড ইমিউনিটি’ কী। অথচ কিছুদিন আগেও শুধু মাত্র এপিডেমিওলজি (মহামারীবিদ্যা) ক্লাসের ছাত্রছাত্রদের পরীক্ষায় এইসব টার্ম শেখানো হতো। প্রয়োজন আমাদের আবিষ্কার করতে শেখায়। মহামারীর একটি ভাল দিক হলো বিজ্ঞান ও স্বাস্থ্য নিয়ে জনসচেতনতা বেড়ে যাওয়া। হার্ড ইমিউনিটির মতো এখন আরেকটি কথা প্রায় সবাই জানেন- প্লাজমা থেরাপি কিম্বা সাধারণভাবে কোভিডের রোগীদের রক্ত দিয়ে কোভিডের চিকিৎসা। যাকে মেডিক্যালের ভাষায় বলা হয়- কনভালেসেন্ট প্লাজমা থেরাপি।
আজকে এমন একজন বিজ্ঞানীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব যিনি এই প্লাজমা থেরাপির একজন বিশ্ব-নন্দিত গবেষক, পথিকৃৎ। বাঁ পাশের ছবিতে সিএনএন নিউজএ যাঁর সাক্ষাতকার দেখছেন তিনি আমেরিকার জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন ও পাবলিক হেলথ বিভাগের প্রফেসর, বিজ্ঞানী ডক্টর আরতুরো ক্যাসাডেভাল (Arturo Casadevall, MD, PhD)। তিনি চিকিৎসক, ইমিউনোলজিস্ট, মাইক্রোবায়োলজিস্ট। পৃথিবীব্যাপী যাঁরা কোভিড-১৯ চিকিৎসায় কনভালেসেন্ট প্লাজমা থেরাপি ব্যবহার করছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম বিজ্ঞানী। তাঁর কাজের জন্যে নিকট ভবিষ্যতে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার সমস্ত কৃতিত্ব তাঁর ঝুলিতে।
এই যে রোগীর রক্ত দিয়ে রোগীকে চিকিৎসা দিয়ে সংক্রামক রোগের চিকিৎসা তার কিন্তু সূত্রপাত হয়েছিল একশ বছরেরও আগে। ১৮৯০ সালে একজন জার্মান বিজ্ঞানী এমিল ভন বেহরিন ঘোড়াকে বিষযুক্ত ব্যাকটেরিয়া (ডিপথেরিয়া) দিয়ে সংক্রমিত ক’রে সেই ঘোড়ার রক্ত দিয়ে ডিপথেরিয়া রোগীদের চিকিৎসা করিয়েছিলেন। ১৯০১ সালে তিনি নোবেল পুরস্কার পান এই কাজটির জন্যে। একই বছর ইতালির একজন চিকিৎসক ফ্রান্সেস্কো সেন্সি হামের রোগীদের চিকিৎসা করে সফল হন। এরপর স্প্যানিশ ফ্লু বিশ্বমহামারীতেও এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে। আর এবার কোভিড-১৯ চিকিৎসা সফলভাবে তা আবার প্রয়োগ করা হলো।
বিজ্ঞানী ডক্টর আরতুরো ক্যাসাডেভাল আমাদের মেডিক্যাল কলেজে যে মডিউলটি আমি পড়াই সেটির ফাইনাল কনফারেন্সে (এমডি ছাত্রছাত্রীদের দুই বছরের গবেষণার ফলাফল নিয়ে কনফারেন্স) কী-নোট স্পিকার ছিলেন এবং এই কনভালেসেন্ট প্লাজমা থেরাপি নিয়ে বললেন।
তাঁর বলার বিষয় নিয়ে বড় কোন আর্টিকেল লেখা যাবে। শুধু সকলের জন্যে কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ কথা শেয়ার করি- এই কনভালেসেন্ট প্লাজমা থেরাপি পৃথিবীর সব প্রান্তেই দেয়া সম্ভব। ভাইরাস যেহেতু বুদ্ধিমানের মতো রূপ বদলায়, আর আমাদের শরীরও আরও বুদ্ধিমানের মতো প্রতিরোধ গড়ে তোলে, তাই এই কনভালেসেন্ট প্লাজমা থেরাপিকে ভাইরাস সহজে পরাজিত করতে পারে না। অন্যদিকে ভাইরাসের বিরুদ্ধে কাজ করে এমন প্রোটিন ক্লোন করে তৈরি ‘মনোক্লোনাল এন্টিবডি’ সবখানে পাওয়া যাবে না, এবং ভাইরাস একে দ্রুত পরাজিত করতে পারে- তাই সুফল ও সুবিধা বিবেচনা করলে কনভালেসেন্ট প্লাজমা থেরাপিই হয়তো ভবিষ্যৎ নতুন নতুন ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের জন্যে ব্যবহৃত হবে চিকিৎসার জন্যে। সেইসঙ্গে প্রতিরোধমূলক সতর্কতা। এই বিষয়টির ইমিউনোলজিক্যাল ও মেডিক্যাল ব্যাখ্যা নিয়ে হয়তো সায়েন্টিফিক কোন আর্টিকল লিখবো অন্যখানে।
বাংলাদেশসহ বেশ কয়েকটি দেশে কোভিড-১৯ নতুন রোগির সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। যে কথাটি বার বার বলেছি- ভ্যাক্সিন নিন, মাস্ক ব্যবহার করুন, শারীরিক দূরত্ব মেনে চলুন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা মেনে চলুন। এখনও গা এলিয়ে দেয়ার সময় হয়নি। বিশ্বমহামারিতে দ্বিতীয় ঢেউ সবসময় মারাত্মক হয়ে ধরা দিয়েছে। সকলেই নিরাপদে থাকুন।