জাহানারা বুলা
কবি রেজাউদ্দিন স্টালিনের সাথে একদিনই দেখা হয়েছিলো সামনাসামনি। তারপর সেই স্মৃতিটি ধূসর। অনেকটা কখনোই দেখা হয়নি’র মত। আমারও লেখক সত্তার জন্ম খুব বেশী দিনের নয়। ২০১২ থেকে পিলপিল করে হাঁটতে শিখেছি সাহিত্যের এই মোহন পৃথিবীতে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিলাম। মাস্টার্স ডিগ্রীর শেষ পরীক্ষাটি দিয়ে সেই যে আমি কলম ছেড়েছি, এর পর বাজারের ফর্দ লিখা ছাড়া কাগজ-কলম স্পর্শ করিনি কখনোই আর।
লেখালেখির জগতে আমার অনুপ্রবেশের ঘটানটি যেন একটি আকস্মিক দুর্ঘটনা। সাহিত্যের সেবক হিসেবে নয়। সখের বশবর্তি হয়েই শুরু করি লেখা। বলা যায় কিছু সুন্দর মুহূর্ত কাটাবো বলেই লিখতে আসা। এখন অবশ্য সখটা দায়িত্ব স্পর্শ করেছে। ফেসবুকই ছিলো একমাত্র বন্ধু আমার। লেখাগুলো আমার তাই সেখানেই জমা করে রাখতাম। কবি বা ঔপন্যাসিক কাউকেই চিনি না তখন। ধীরে ধীরে এক-দুজন ফেইসবুক বন্ধুই এগিয়ে এলো আমার এই দৈন্য দশা থেকে আমকে টেনে তুলতে। তাঁরা আমার কৃতজ্ঞতার আবর্তে আজীবনই থাকবেন।
“ম্যাজিক লন্ঠনে”র কবিতা পাড়ায় নিয়ে গেলো এক দিন এক বন্ধু। বেশ ক’জন কবির সমাগম সেখানে। পুরুষ এবং নারী। তাঁদের মধ্যেই একজন ছিলেন কবি রেজাউদ্দিন স্টালিন। দু’এক জনের কথা এখনো স্মৃততে আছে। কিন্তু, স্টালিনের কথা একদমই মনে নেই আমার। সেদিন তিনি আমার কবিতা শুনে কি মন্তব্য করেছিলেন, এমনকি তিনি সেখানে ছিলেন বলেই স্মৃতিতে কিছু ভাসছে না আজ। ২০১৫ তে আমার দ্বিতিয় কাব্য গ্রন্থ “পারিজাতের কেশর” প্রকাশ করি। তখন আমি কানাডায়। এর আগে এবং পরেও আমি কানাডায়ই। কিন্তু, ২০১৬ তে যখন আমি একবার ঢাকায় আসি তখনকার ঘটনা এটি।
ম্যাজিক লন্ঠনে যাওয়ার বন্দোবস্তটা করে দেয় কবি সাদাফ হাস্নাইন মঞ্জুর। চা জল খাবারের ব্যবস্থাটাও ওঁরই ছিলো। আমার কবিতার ব্যাবচ্ছেদ করেন বেশ ক’জন কবি ম্যাজিক লন্ঠনের ঘরটাতে বোসে। কেউ ভ্রু কুঞ্চিত করেন, কেউ কবিতা শুনে খুশি হন। কবি স্টালিন কি বলেছিলেন তার কিছুই আমার মনে নেই। তবে, বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে মাস খানেক আগে আমার বুক শেল্ফে তাঁর “ দ্রোহের কবিতা” কাব্য গ্রন্থটির আবিষ্কার হয়। বইটিতে তাঁর অটোগ্রাফ সহ লিখা আছে “ কবি জাহানারা বুলা সুজেনেষু”। আমি অবাক হই। বইটি নিশ্চিত সেদিনেরই উপহার! অথচ, স্মৃতি আমাকে ধোঁকা দিয়ে দিলো!
ইতিমধ্যে করোনাকালীন বন্দি দশায় আমি একটি লাইভ প্রোগ্রামের সমন্বয়কারী হিসেবে দায়িত্ব প্রাপ্ত হই। সেই সুবাদে কবি স্টালিনকে আমাদের অনুষ্ঠানে সংযুক্ত করার জন্য তাঁর ম্যাসেঞ্জারে ম্যাসেজ রাখি। অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে তাঁর হাঁ সূচক উত্তরটি পাই। এর পর লাইভে দেখা হয় কবির সাথে। আমাদের দুটি লাইভের আমন্ত্রিত অতিথি ছিলেন তিনি। তাঁর পর মাঝে মধ্যেই কথা, অবশেষে বন্ধুত্ব।
কবিতা আমরা অনেকেই লেখি। অসাধারণ সুন্দর সেই সব কবিতা। সুন্দরেরও তো রকমফের থাকে, যেমন- অন্তসারশূন্য সুন্দর আর বুদ্ধি দীপ্ত সুন্দর। অন্তসারশূন্য সুন্দরের কোনো আলোচনা বা মন্তব্য করার মত কিছু থাকে না ভালোলাগার অনুভব ছাড়া। কিন্তু, বুদ্ধিদীপ্ত সুন্দরের বর্ণানা করা যায় বহু দূর অব্দি। কবি রেজাউদ্দিন স্টালিনের কবিতাকে আমার কাছে বুদ্ধিদীপ্ত সুন্দর বোলেই মনে হয়েছে। তাই তাঁর কবিতা নিয়ে আমার কিছু মতামত এবং অনুভূতি আজ আমি ব্যক্ত করতে চলেছি। আমি জানি, কবি স্টালিনের কবিতার ব্যবচ্ছেদ করা আমার জন্য ধৃষ্টতা। তবে, চেষ্টায় ক্ষতির কিছু নেই।
যেহেতু সাহিত্যের ছাত্রী ছিলাম, কবিতা বা গল্প যাই পড়ি, মনের মধ্যে একটি বিচার বুদ্ধির তোলপাড় হয়। ব্যবচ্ছেদের বিষয়টি তাই যেন মজ্জাগত স্বভাব হয়েই দাঁড়িয়েছে আমার। যার জন্য বাদ দিচ্ছি না বন্ধু কবির কবিতাও।
সর্ব প্রথম তাঁর ওয়ালে যে কবিতাটি আমি পড়ি তা হচ্ছে কবির একটি প্রেমের কবিতা – “অভয়”। কবিতাটি নিচে রাখলাম-
অভয়
রেজাউদ্দিন স্টালিন।
ভেবো না প্রিয়তমা;
তোমাকে কেউ আকাশ দিলে
সুর্য দেবো আমি বৃষ্টি দিলে বৃক্ষ দেবো
হিরের চেও দামী
নদী দিলে নৌকো দেবো সবচে’ দ্রুতগামী।
ভেবোনা প্রিয়তমা;
ঝাড়বাতি কেউ জ্বালিয়ে দিলে
তারার আলোয় ভরিয়ে দেবো পথ
নোলক দিলে বানিয়ে দেবো
রঙধনুর ওই নথ।
কেউ যদি দেয় মল
আমি দেবো স্রোতের ছলাতছল
সোনায় বাঁধা গ্রন্থ দিলে প্রতিশ্রুতি ঠাসা
আমি দেবো বর্ণমালা আমার মাতৃ ভাষা
কেউ যদি দেয় বিশ্ব জোড়া বাড়ি
আমি তো দেবো মাত্র দশ হাত লজ্জা ঢাকা শাড়ি।
“অভয়” কবিতাটি আমাকে ভীষণ ভাবে ভাবিত করে। প্রেমের কবিতা হয়েও কবিতাটিতে নিছক তুমি আমির বাহুল্যতা দেখতে পাইনি আমি। মনে হোলো এর অভ্যন্তরে কথা বোলছে অন্য একটি ভাবনা।
স্বাধীনতার ইতিহাস যা বলে বা বাল্য স্মৃতিতে যা উজ্বল হয়ে আছে, তাঁর কোনো কিছুই কিন্তু স্বাধীনতা উত্তর বাংলা দেশে তেমন ভাবে প্রতিফলিত হয়নি। আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার যে বীজ বপন করে দিয়ে গেছেন তাঁর অঙ্কুরোদগম আজও অদৃশ্য।
ভঙ্গুর আর্থসামাজিক কাঠামো, লুটপাট, ভ্রষ্টাচার নাগালের বাইরে। তাই, সুবিধা বঞ্চিত বহু মানুষ। কিন্তু, এরাও তো সুবিধা চায়! এদেরও আকাঙ্ক্ষার ডানা আছে। সেই ডানায় ভর করে তারাও আকাশ দেখার স্বপ্ন দেখে। অথচ, তাদের পালে হাওয়া লাগে না। মনের যত আকাঙ্ক্ষা মনে তৈরী হয়ে সেখানেই ফুরিয়ে যায়। যার কারণে প্রতিনিয়ত নীতি বিবর্জিত হয় সহস্র মানুষ!
আকাশের মেঘ ঘনিভূত হয়ে তো মাটিতেই পড়বে, মাটির আর কি দোষ? তেমনিই একখন্ড মেঘ যেন গলে পড়েছে অভয় কবিতার অন্তরাত্মায়।
স্বচ্ছল জীবনের বাসনা দাপিয়ে আসছে বহুবিধ সম্পর্ককে বিকল করে দিতে। আর, তখনই সম্পর্কের আঁটসাট বাঁধনগুলো ঢিলেঢালা হতে শুরু করেছে প্রতিনিয়ত। প্রেম-ভালোবাসা, স্নেহ-মমতা হারাতে থাকে তাদের ঘনত্ব। অনাস্থার অভিসম্পাত অস্থির করে তুলতে থাকে এই বলয়ের প্রতিটি চরিত্রকে। যার ফলে সম্পর্ক গুলো আবেগ ছেড়ে, বিশ্বাস ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয় সম্ভাব্য অধিক ভালো থাকার হাতে হাত রেখে। আর যে হাতটি ছেড়ে চলে যায় বা যেতে চায় তার কাছে তখন বাকি থাকে অনুনয় এবং নড়বড়ে ভরসা। অভয় কবিতায় চিহ্নিত যেন এমনই তিনটি চরিত্র – কবি, কবির প্রেয়সী এবং তার প্রেয়সীর গমন উন্মুখ অন্য আর একটি পথ।
কবির নান্দনিক অনুনয়ে রয়েছে মাত্র দশহাত শাড়ি, ঢেউয়ের ছলাতছল, দ্রুতগামী নৌকো, তারার আলো, রংধনু, আর নিজের মাতৃভাষা।
বিপক্ষে তার জন্য হাত বাড়িয়ে আছে সোনায় মোড়ানো প্রতিশ্রুতি, বিশ্বজোড়া বাড়ি, নোলক ইত্যাদি।
মূলত প্রেমের প্রতীকী ব্যবহারের মধ্য দিয়ে কবি চিত্রিত করতে চেয়েছেন বর্তমান বাংলাদেশের অন্তর্নিহিত চিত্রকে। এবং কবি তাতে সফলও হোয়েছেন।
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের একটি গান এই কবিতার পাশাপাশি ভীষণ প্রাসঙ্গিক –
“ মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী দেবো খোঁপায় তারার ফুল।
কর্ণে দোলাবো তৃতীয়া তিথির চৈতি চাঁদের দুল”।
দুই কবিই বিনা মূল্যে সমগ্র প্রকৃতি কিনে নিয়ে তাঁদের প্রিয়তমাদের সমর্পণ কোরতে চেয়েছেন। তবে, গান এবং কবি স্টালিনের কবিতায় প্রকৃতির যে সরঞ্জামাদি যুক্ত করেছেন তা কিন্তু অপূর্ব, অসাধারণ!
কবি স্টালিনের কবিতার শরীর জুড়ে প্রেম থাক বা দ্রোহ, কবির অন্তর জুড়ে যে কেবল আর কেবল দেশ প্রেম তা এই কবিতায় স্পষ্ট।
স্টালিনের কোনো কবিতাই শুধুমাত্র কল্পনা প্রসূত নয়। তাঁর প্রতিটি কবিতাই দেশ, সমাজ ও ব্যক্তি জীবনের চিত্র চিহ্নিত সবাক ছবি। এবং সেই ছবি বৃষ্টি চিহ্নিত বা বিমূর্ত নয়, ক্যানভাসে তৈল চিত্রের অভাবনীয় স্পষ্টতায় প্রস্ফুটিত। যার কারণে তিনি বারবার হয়ে উঠেছেন সমকালীন, সর্বকালীন বা আধুনিক।
মেঘনাদ বধ কাব্যের সর্বাধিক আলোচিত চরিত্রের নাম রাবণ। তাকে নিয়ে এতো আলোচনা সমালোচনার কারণ চরিত্রটিকে মধুসূদন দেখেছেন বাল্মীকির কৃত্তিবাসের তুলনায় সম্পূর্ণ নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে। যুগের দ্রোহ বুদ্ধি এ ক্ষেত্রে ক্রিয়াশীল তাঁর ভেতরে। বন্ধু রাজ নারায়ণকে একটি চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন- As a jolly christian youth, I don’care a pin’s head for Hinduism, জলি ক্রিষ্টান কথাটি তিনি লিখেছিলেন সম্ভবত চিঠিটি রাজ নারায়ণকে লিখা বলে। কারণ, তিনিও ক্রিষ্টানই ছিলেন। মূলত ক্রিষ্টান না হলেও মধুসূধনের হাতে রাবণ বাল্মীকি বা কৃত্তিবাসের অনুরূপ হতে পারতো না। কারণ তাঁর বিদ্রোহ আদৌ কোন ধর্মীয় সংস্কারের নয়। মন এবং মেধার যুগতাড়িত যুক্তির। কবি স্টালিনের “ভেঙে আনো ভেতরে বাহিরে” কবিতাটিতেও কবি রাবণকে ঠিক সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করেছেন বলে কবিতাটি পড়ে মনে হয়। তাই, সমস্ত কল্যাণকর ভাঙনের হোতা হিসেবে কবি রাবণকেই আহবান করেছেন।
স্টালিনের এই কবিতায় তাঁর আর একটি বিশেষ মুন্সিয়ানা আমি লক্ষ্য করি হিন্দু পুরাণ ব্যাবহারের ক্ষেত্রে। এই সব পুরাণের ব্যবহারে তিনি যেন সিদ্ধ হস্ত। ভীষণ ভাবে সাবলীলতা এবং সতস্ফুর্ততা দেখিয়েছেন বিন্দু থেকে বৃত্ত অবধি পুরাণ ব্যাবহারে তিনি। তবে, অপরিহার্যতাকে ছাপিয়ে যাননি কবি। পুরাণ ব্যাবহারে সংযমের বিষয়টি তাঁর কবিতা উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। কবির স্বপ্রতিভা স্বাক্ষরিত হয়েছে এই কবিতায়। তাই, ভেঙে আনো ভেতরে বাহিরে কবি স্টালিনের একটি স্বাক্ষরিত কবিতা-
ভেঙে আনো ভেতরে বাহিরে
রেজাউদ্দিন স্টালিন।
এইভাবে ভেঙে আনো ভেতরে বাহিরে
যুধিষ্ঠির দৃষ্টি থেকে অনন্ত অন্যায়
ইন্দ্রপ্রস্থের আগে জতুগৃহ, তার আগে লক্ষ অর্জুন
ভেঙে আনো লখিন্দর লোহার বাসর
ভেঙে আনো সাপের শৃঙ্খল
লঙ্কার লৌহ সিংহাসন থেকে ভেঙে আনো বেপথু বিভীষণ
রাবণ হে রাবণ রাবণ হে রাবণ রাবণ হে
এই ভাবে অন্তস্থল অন্তরে ভেতরে ভাঙো
শাক্যরাজেন্যকূল কপিলাবস্তুর
ভেঙে আনো চতুর্থর্দিকে অরণ্য আকাশ
ভেঙে আনো সীমাবদ্ধ সংসারের সীমা
ভেঙে আনো পথের পৃষ্ঠদেশ অন্ধ আয়োতন
রাবণ হে রাবণ রাবণ হে রাবণ রাবণ হে
এইভাবে ভেঙে আনো নক্ষত্র নিয়ম
মাটির মমতা থেকে পাথরের মুখ
ভেঙে আনো বেদনার অঙ্কুরোদগম
বাতাসের বৃন্ত থেকে ইথারের আয়ু
চাঁদের গর্ত থেকে ঈর্ষাতুর ইঁদুরের দাঁত
ভেঙে আনো জন্মান্তর মাধ্যাকর্ষণ
রাবণ হে রাবণ রাবণ হে রাবণ রাবণ হে
ভ্রুণ ভেঙে আনো ত্বরণ মন্দন
কোলাহল ভেঙে আনো অজস্র মরণ
বেগ ভেঙে আনো গতির গর্জন
গতি থেকে বেগ থেকে ভ্রুণ থেকে তীব্র ভেঙে আনো
অন্তরে বাহিরে ভাঙো ভেতরে অন্তরে অন্তরে।
কবির লেখা “এক মৃত ব্যাক্তির সাক্ষাৎকার” কবিতাটি কবির অনুপম সৃষ্টি –
এক মৃত ব্যক্তির সাক্ষাৎকার
রেজাউদ্দিন স্টালিন।
ফুটপাতের সমকোণে এক মৃত মানুষ।
কিন্তু তাজ্জব সে নড়ে ওঠে-
মাছি বসা মহিসের কাঁধ।
আনুভূমিক কৌতূহলে নুয়ে আসে পথচারী –
: আপনি কি মৃত মৃত?
হাঁপছাড়ার সুযোগ না দিয়ে
ধমকে উঠে,
: না এখনো নয় – তাতে আপনার কি?
: তাহলে এই মৃতের ভান করা কেন?
অদরকারী কথা রেখে মৃত ব্যক্তি
পাশ ফিরে শোয়;
গনগনে গলায় তার পাল্টা প্রশ্ন-
: জীবিতের ভান করে কি লাভ বলুন?
এই কবিতায় বাংলাদেশের একটি সর্বজন বিদিত এবং বহুল পরিচিত জীবন চিত্র কবি তুলে ধরেছেন। এই চিত্রকল্পটিকে স্বাধীন বাংলাদেশের দর্পণ বললেও ভুল হবে না। যে চরিত্রটি এই কবিতায় বিধৃত তা অতীতে ছিলো, বর্তমানেও আছে। তবে, এর ভবিষ্যৎও যে খুব মনোগ্রাহী হবে না তা এদেশের অবকাঠামো দেখেই বিচার করা যায়। স্বাধীনতার পর এই দৃশ্যটি পালটে যেতে পারতো যদি না দেশটি ঘুণপোকাদের বাসস্থান হোতো।
পথে যেতে যেতে ফুটপাতে এমন দৃশ্য দেখে না তার সংখ্যা কম। কেউ দয়ার্ত হন, ছুড়ে দেন কিছু খুচরো টাকা, কেউ পাশ কেটে হেঁটে চলে যান। কিন্তু, বিষয়টি নিয়ে ভাবেন ক’জন? সোচ্চার হয়ে এদের জন্য ফরিয়াদ করেন ক’জন? আত্ম চক্ষু উন্মীলিত এই সংখ্যা লঘু জনতার একজন কবি স্টালিন। তাঁর ভাবনার আয়নায় আমরা যেন তাকেই দেখতে পাই ব্যথিত হোতে, ভেঙেচুরে গুড়িয়ে যেতে। কবিতার উপসংহারে- “ জীবিতের ভান করেই বা কি লাভ বলুন”?- এই প্রশ্ন যেন স্বয়ং কবিরই।
কবি স্টালিন কবিতা লিখেন মানবতার, মানব অধিকারের, মানুষের বঞ্চনা, দুঃখ- কষ্ট-দুর্দশার। পীড়িত এই মানুষগুলোর পোস্টার ছেপে দেয়ালে দেয়ালে সেঁটে দিতে চান যেন তিনি তাঁর কবিতার ভাষায়। অপ্রাপ্তি গুলো দেশময় ছড়িয়ে দিয়ে প্রত্যেককে সচেতন করে তুলতে চান কবিতার মাধ্যম। এই খানে কবিকে সচেতনতার কবি বললে ভুল হবে না। হায় স্বাধীনতা! – এই দীর্ঘশ্বাসটিকে তিনি মূর্ত করে তুলতে চেয়েছেন, বাংময় করে তুলতে চেয়েছেন তাঁর প্রতিটি কবিতায় এবং এই কবিতায়ও।
“সময়ের গল্প” কবিতায় কবি স্টালিনকে দেখি আরো নতুন করে। এই কবিতায় তিনি তাঁর যে ক্ষোভের প্রকাশ করেছেন তা অত্যন্ত ধীর লয়ে এবং সিক্ত কন্ঠে। তাই তার বক্তব্য স্পষ্ট এবং শানিত। অভিজ্ঞতা বলে- চিৎকারের কথা অস্পষ্ট। তাই হয়তো কবি কন্ঠ উদ্যত না করে বক্তব্যের ধারা বিবরনি দিয়ে গেছেন একের পর এক।
“সময়ের গল্প” কবিতাটি দীর্ঘ হলেও সুখপাঠ্য। বর্তমান বাংলা দেশের এক্স-রে, এদেশের আভন্তরিন রেকর্ড এই কবিতা। বাংলাদেশের অন্দর মহলকে জানতে আর কোনো দূত বা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের মঞ্চবক্তৃতা শোনার প্রয়োজন নেই। কারণ, এই কবিতায় কবি রেজাউদ্দিন স্টালিন বুঝিয়ে দিয়েছেন কবিরা সর্বদ্রষ্টা, কবিরা সর্বজ্ঞ, কবিরা সমাজ সচেতন, কবিরা যোদ্ধা, কবিরা আশাবাদী, কবিরা প্রতিবাদী।
“কবিতা বা কথা মানে ইশারা”। সেই দিক বিবেচনা করে দেখলে স্টালিনের এই কবিতাটি একটি শক্তিশালী ইশারা সময়কে হাতে তুলে নেয়ার।
এক সম্পূর্ণ সত্যকে সহজ শব্দাবলী এবং বাক্য সৃষ্টির নিপুণতায় , ঐতিহাসিক ও গ্রীক ট্র্যাজিক চরিত্র এবং হিন্দু মিথের প্রতীকী ব্যবহারে কবিতাটিকে কবি পৌঁছে দিয়েছেন অনন্ত অসীম উচ্চমার্গে। সেখানে যেতে যেতে কবিতাটির শিল্প গুণ বিন্দু মাত্র ধ্বসে পড়েনি। অথবা, মিথ ব্যবহারের সাবলীলতা এবং স্বতঃস্ফূর্ততায় কোথাও কবি সংযম চ্যুত হননি।
এই কবিতার প্রতিটি পংক্তি বলে দেয় ক্ষমতার অপব্যবহার আর মনুষ্যত্বের অবক্ষয়ের কথা। কবি কিছুটা হতাশায় নিমজ্জিত হন এক পর্যায়ে। তাই তিনি বলেন – “এই মাৎস্যান্যায় মেনে নিচ্ছে কাপুরুষ কবি”। কিন্তু, পরক্ষণেই তার উত্তরণ ঘটে আশার আলোয়। যার জন্য তিনি কবিতার শেষ পংক্তি মালায় ঘোষণা দেন –
“তবু দূরে আকাঙ্খার ডালে দু’একটি পাতার বিনয়
পথে পথে বৈশাখের পায়ের আশ্রয়”।
ঠিক এইখানে দাঁড়িয়ে আমি কবি স্টালিনকে দেখি আশাবাদি কবি হিসেবে।
সময়ের গল্প
রেজাউদ্দিন স্টালিন।
বিখ্যাত হতে সময় লাগে না
সিঁড়ি ছাড়া আকাশের তারা ছোঁয়া যায়
যোগ্যতা মেরুদণ্ডহীনতা সেই সাথে তোষামোদী
পদলেহনের গুন প্রসংসার্হ
পর্দায় মূর্ত হতে সময় লাগে না
অশুদ্ধ উচ্চারণ ডিজুসভঙ্গি
ক্লিওপেট্রার প্রতিদ্বন্দ্বী হতে প্রেরণা যোগায়
শয্যা সফেদ নরম কি কালো হোক
গ্রহণে বিলম্ব হলে অযোগ্য
কৌমর্য বিসর্জন দিতে পূঁজার লগ্ন লাগে না
তারকা তৃষ্ণায় জনলোকে
সভ্যতার সিল্কবস্ত্র স্বেচ্ছায় খুলে ফেলছে দ্রৌপদীগণ
আর গোলাম ও খোঁজাদের খোঁজ করছে মিডিয়াবিদরা
আত্ম সম্মানের বুনিময়ে কেউ কেউ ক্রোড়পতি
মর্যাদার মায়া পরিত্যাগ করে মল থেকে
তুলে নিচ্ছে কড়ি
পিতা চন্দ্রধর দেখছেন দেখছেন তারই চোখের সামনে
সন্তানের পেয়ালায় কারা ঢেলে দিচ্ছে রক্তমন্ত্রমদ
আর বিদেশী বণিকের বাহবামুগ্ধ বেহুলা সুন্দরী
নাচছে ইন্দ্রের আসরে
ক্রীতদাসতুল্য মনোবৃত্তি না হলে সর্বত্র যাতায়াত বিধান বিরোধী
এখন সম্রাটের পাশে পদলেহীদের আসন গ্রহণ প্রথার পর্যায়
মুখোশের পেছনে মুখোশ
ছদ্মবেশের নিচে আরো ছদ্মবেশ
চাঁদসদাগর চাঁদাবাজ সন্ত্রাসী ক্যাডারের পৃষ্ঠপোষক
প্রখর দুপরে চম্পক বাংলায় গভীর রাত্রি
বিশল্যকরণীর খোঁজে হনুপতি আকাশের গলা থেকে
খুঁজে নিচ্ছে সূর্যহার
দারিদ্র দংশিত লখিন্দর গাঙুরের জলে ভাসে কলার মান্দাসে
লক্ষ লক্ষ শীর্ষনাগ তাড়া করছে নগরবাসীকে
তোষামোদকারীদের ভিড়ে প্রকৃত দেশপ্রেমীগণ বিরল প্রজাতি
বাজিগর প্রকাশ্যে জিতে নিচ্ছে তীতুমীরের অস্থি পূর্বপুরুষের স্মৃতির সম্ভ্রম
গরিবের পোষা তেল পাঠাতে হচ্ছে প্রভুর চরণ সমীপে
যজ্ঞের অগ্নিচক্রে বাঁধা শরতের শীর্ণ মহেষ
কালি দেহে জলের গভীরে ধুম্রমেঘ রহস্যজনিত
বন্দরের বুকে সত সদাগর নোঙরের জায়গা পায় না
সব পথ মেনে নিচ্ছে নির্বাসন
সব ঘর খা খা বিরাণ বসতি
কলিঙ্গের করিডোরে পুশব্যাক পুশইন খেলা
লঙ্কার দুর্ভাগ্য দুর্ভাগ্য এসেছে ঘনিয়ে চম্পক শহরে
মাইক্রোক্রেডিটমুগ্ধ মেঘনাদ শান্তি পদকে ভূষিত
আর সুশীল সমাজ পুতুল নাচের পৃষ্ঠপোষক
বিশ্বব্যাংক বিভিষণদের হাতে তুলে দিচ্ছে বীরের তকমা
পৌরুষের পরিচয় বিপজ্জনক
জগতশেঠজাতিসংঘ চুনকালি লেপনের দায়িত্বপ্রাপ্ত
কাপুরুষ ছাড়া কর্ণের সন্ধান দুরূহ এদেশে
সূর্যাস্ত ছাড়া প্রার্থিত লগ্ন নেই কোনো
আর কান্না ছাড়া কলরোল
শবযাত্রী ব্যথিত পথিক
এবং অন্ধ ছাড়া পথ প্রদর্শক
এদেশে খনিজকন্যার জন্যে হিতৈষী হতে সময় লাগে না
সম্রাট কোষাগার সঁপে দিচ্ছে তঞ্চকের হাতে
রাম রাহণের সখ্যে মধুকবি লাজ্জাপ্লাবিত
একিলিস হেক্টর একই মঞ্চে নৃত্যরত দেখে
হোমার পুনরায় অন্ধ অবনত
মহাকাব্যের সব বীর মহিমা হারিয়ে কীব বিদূষক
আত্মদানের যোগ্য যুবা নেই তবু মুক্তিযোদ্ধা হতে সময় লাগে না
এই মাতস্যান্যায় মেনে নিচ্ছে কাপুরুষ কবি
পদপূরণের যোগ্য শব্দ নেই তবু লিখছে মাতৃভাষা
ক্যানভাস শুধুই ধূসর রং লেপনের প্রকৃত বর্ণ নেই
আর হেমলক ছাড়া পাত্র
কিংবা শঙ্কা ছাড়া নাদ
এই মৃত্যুদেশে নেতা হতে সময় লাগে না
মুক ও বধির সব জনতা সত্যমিথ্যা করতালি দেয়
পৃথিবীর ধবংসের কথা সূর্যের মৃত্যুর
নক্ষত্রের নিয়তি কিংবা ধৈর্যধারণের
দেবদূতদের মর্তে আগমন
বা ছায়াবৃত ঘুমের
খাদ্য না পেলে নরমাংস ভক্ষণের
নিজে বাঁচলে পিতৃনাম
তবু শুরু করো ঈশ্বরের নামে
কিন্তু সব আরম্ভ অন্ধ
দান করো মুক্ত হস্তে
সব হাত খঞ্জ
কথা বলো নম্রভাবে
সব কন্ঠ নির্বাক
স্বপ্ন দ্যাখো নির্ভয়ে
কিন্তু সব দৃষ্টি মতচ্ছন্ন
এখন নিয়ম অনিয়ম হতে সময় লাগে না
আগুনের মধ্যে অনর্গল ধোঁয়া
বৃক্ষের বাকলে কেবলই জন্মাচ্ছে কাঁটা
ফলের কোষে কোষে বিষের বৈকুন্ঠ
তবু দূরে আকাঙ্খার ডালে দু’একটি পাতার বিনয়
পথে পথে বৈশাখের পায়ের আশ্রয়।
“তদন্ত রিপোর্ট” কবিতাটি আধুনিক বাংলা কাব্য সাহিত্যের ধাপে এক অভূতপূর্ব সৃষ্টি। ধর্মের কুহক থেকে মুক্তি পাওয়ার অনাবিল এক মৌন প্রতিবাদ যেন এই কবিতাটি।
যতটা বুঝেছি, কবি স্টালিন ব্যক্তিগত পার্থিব জগতে ধীর স্থির, স্বল্পভাষী, অনুচ্চ স্বর একজন ব্যক্তিত্ব। তাই, তাঁর কবিতাও কলহ বিবাদের ভাষা থেকে বেরিয়ে এসে ধ্যানমগ্নতায় আবিষ্ট সত্য বচন।
এই কবিতায় কবি “মুহাম্মদ ডেভিড কৃষ্ণ বড়ুয়া” নামটি ব্যবহার করেছে অসাম্প্রদায়িকতার প্রতীক হিসেবে।
“সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই” – এই বাণী উচ্চারণ করেন বাংলার মধ্য যুগের কবি চণ্ডিদাস। ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ মানবীক বাণী এটি।
সমগ্র বিশ্ব যখন হিংসায় উন্মত্ত। রক্তারক্তির চিত্রকল্প যখন বিশ্ববাসিকে করে তুলেছে অস্থির। তখন, এই বাংলার একজন কবি বিশ্বকে শুনিয়েছিলেন মানবতার অমর কবিতা।
যুগে যুগে মানুষের কল্যান কামনায় গাওয়া হয় সাম্যের গান। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সংস্কৃতি হয়ে ওঠে মানুষের জীবন এবং জাতিসত্তা নির্মানের প্রধানতম নিয়ম কর্তা।
সম্প্রদায় ও সাম্প্রদায়িক চিন্তা চেতনা বিনষ্ট হয় মানবিক জীবন থেকে উৎসারিত ভাষা ও সংস্কৃতি ভিত্তিক জাতীয়তাবাদের কাছে। ভাষাভিত্তিক জাতিয়তাবাদ, ধর্মীয় বিভেদকে অনুমোদন করে না। কারণ, সাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদ মানবিক ও শান্তি মুখাপেক্ষী নয়। দেশজ সংস্কৃতি, ভাষা ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা শক্তিই জাতীসত্তার বিকাশ ঘটায়।
কবি স্টালিনের “তদন্ত রিপোর্ট” কবিতাটি ঠিক এই সংজ্ঞা বা সূত্রধর।
সুস্পষ্ট বক্তব্য তাঁর কবিতার সুখপাঠ্যের সূচক। স্টালিনের কবিতায় আছে গল্প, আছে গদ্য এবং নাটকীয়তা। “তদন্ত রিপোর্ট” কবিতাটি স্টালিনের এসব বৈশিষ্টের বলয়গত।
কবিতাটিতে গল্পের মত টেনশন আছে, আছে একটি পরিনতিও। এবং সেই পরিনতিতে কবি অত্যন্ত সাবলীল এবং সাহসী। তাই তো কবি সমস্ত ধর্মকে একটি মাত্র নামে ( মুহাম্মদ ডেভিড কৃষ্ণ বড়ুয়া) ডাকতে সক্ষম হয়েছেন। ধর্ম নিয়ে, ধর্মের গোঁড়ামি নিয়ে কথা বলাটা তাঁর নতুনত্ব নয়, নতুনত্ব তাঁর স্টাইলে।
সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই- এই ম্যাসেজটি অনেকেই দিয়েছেন চণ্ডীদাসের পরে। তবে, স্টালিনের স্টাইল সকলের চেয়ে ভিন্ন। “মুহাম্মদ ডেভিড কৃষ্ণ বড়ুয়া” এই কোলাজটি স্টালিনের ধর্ম নিয়ে হীনমন্যতায় নিমজ্জিত না থাকার ম্যাসেজ তো বটেই, প্রকাশের একটি ব্যাতিক্রম এবং অভিনবত্বও বটে।
ঈশ্বর তাঁর সৃষ্ট আশরাফুল মখলুকাতকে একই প্রকৃতিতে প্রেরণ করেছেন, একই আলো, জল, হাওয়া আস্বাদন করতে। অথচ, মানুষ তার যুক্তি-বুদ্ধি-পেশীশক্তির অপব্যবহার করে নিজেদের মধ্যেই টেনে দিয়েছে লক্ষ্মণ রেখা। এই বিপরীত স্রোত ঠেলে কবি সোচ্চার হয়েছেন মানব ধর্মকে শ্রেষ্ঠত্ব দিতে তার কবিতায়। কবি তাই মানবিক এবং একেশ্বরবাদী হওয়ার প্রমাণ রেখেছেন এই কবিতায়।
ধর্ম একটি সংবিধান মাত্র। সেই সংবিধানের নিয়ম নীতি সবার ক্ষেত্রেই এক। অথচ, কিছু ধর্মান্ধ মানুষ সেই ধর্মকে করেছে বিভেদ সৃষ্টির হাতিয়ার। ধর্মের লেবাসে অধর্মীয় কাজ করে চলেছে নিত্য। সৃষ্টি কর্তার নির্দেশ এমন নয়। তিনি বলেছেন পরস্পরের ধর্মের প্রতি সমান শ্রদ্ধাশীল হতে।
কবি স্টালিন সৃষ্টি কর্তার বিধান মতো সকল ধর্মের প্রতি সমান শ্রদ্ধা রেখে কবিতায় একটি অসাম্প্রদায়িক চিত্রকে কবিতার নির্জাস হিসেবে ফুটিয়ে তুলেছেন। প্রথম থেকে শেষ অব্দি বিচার বিশ্লেষণে ” তদন্ত রিপোর্ট ” কবিতাটি একটি কালজয়ী কবিতা হিসেবে বিবেচ্য আমার দৃষ্টিতে।
তদন্ত রিপোর্ট
রেজাউদ্দিন স্টালিন।
তদন্ত শুরু হোলো
নদীতে ভেসে আসা বেওয়ারিশ যুবকের লাশ
সংবাদ পত্র- অনলাইন আর টিভিতে শেকড় ছড়াচ্ছিলো
যুবকের বৃক্ষ শরীর। মোবাইল মেমোরিতে
পাওয়া চমৎকার সেল্ফি পোস্ট করেছিলো অজানা কেউ
নায়ক তুল্য দেব কান্তি এই যুবকের ধর্ম পরিচয় কি?
সনাক্তযোগ্য ধর্মাঙ্গটি জলজ প্রাণীদের প্রাতরাশ।
নগরের অধিকাংশ তরুণী রূপবান যুবককে
কল্পনা করলো প্রেমিক হিসেবে।
কেউবা স্বামী তার বৃদ্ধরা তাদের হারিয়ে যাওয়া
সন্তানদের শোকে ডুকরে উঠলো।
বিধবারা অন্তেষ্টিক্রিয়ার জন্য বুনতে শুরু কোরলো সুদৃশ্য মসলিন।
অনেকে গোপনে কিনতে গেলো টি শার্ট আর জিন্স
খাটি সুতি কাপড়ের ধুতি কেউ কেউ
গেরুয়া চীবর পছন্দ হোলো কারো কারো
ফেসবুক টুইটারের দেয়াল ভরে উঠলো নানা
সন্দেহ মন্তব্য আর গুজবে।
তদন্ত কর্তাকে সারাক্ষণ ঘিরে থাকলো উদ্বিগ্ন ক্যামেরা কলম আর ল্যাপটপ।
ভীড় ভেদ করে এগিয়ে এলো এগিয়ে এলো এক নারী-
ওই লাশ বেওয়ারিশ নয় – ও আমার স্বামী।
এক তরুণী চিতকার করে উঠলো – আমার প্রেমিক
নুব্জ বৃদ্ধার আহাজারি ওই তার হারানো মানিক।
ও আমার এক মাত্র ভাই- কেঁদে উঠলো এক মেয়ে।
এক বিব্রত বৃদ্ধ বললো – সাদা পোশাধারীদের হাতে
হারিয়ে যাওয়া আমার সন্তান।
বৃক্ষহীন নগরেও অদৃশ্য পাতার ফিসফাস,
যুবকের লাশটি বেওয়ারিশ নয়।
প্রয়োজন নেই ময়নাতদন্তের দাবি জমলো জমলো দিগ্বিদিক
ওর অতৃপ্ত আদলে আর হিংস্র ছুরির দাগ দরকার নেই।
জনতার দাবীর ভারে নুয়ে এলো ক্ষমতাধরগণ;
তাহলে কি ভাবে লাশটি সমাহিত হবে?
কেউ বললো – সুগন্ধি সহযোগে চন্দনের চিতায় দেহ ভস্ম হোক,
অনেকের মত – শুভ্র কাফনে সমাহিত হোক ওর পবিত্র শরীর,
বুকে ক্রুশ চিহ্ন এঁকে বললো আর এক জন- মাতা মেরীর মমতায়
ওকে শোয়ানো হোক কাঠের কফিনে।
ভীড়ের ভেতর থেকে প্রায় ঝড়ের বেগে এক মাতৃতুল্য নারী এসে সমাধান দিলো- ও অমৃত পুত্র ও নিস্পাপ আদম
ওকে ফুল শয্যা পেতে নদীতে ভাসাতে হবে –
যে ভাবে শিশু মাসাকে তার মা ভাসিয়েছিলো নীল নদে,
আর লখিন্দরের বেহুলা গাঙুরের জলে;
এবং প্রত্যেক ঘাটে সে বরিত হবে বীরের সম্মানে,
এক সর্বেশ্বরবাদী সবিনয়ে প্রস্তাব দিলো এখন ওর একটি নাম প্রয়োজন,
সর্বসম্মত গ্রহণ যোগ্য – অভূতপূর্ব।
সমর্থনের হাওয়া বয়ে গেলো প্রত্যেকের নীরব নৌকায়,
তাহলে নিস্পাপ ওর নাম হোক – মুহাম্মদ
অদ্ভুত সারল্য মুখে ও হোক -ডেভিড
নির্যাতনে নীল ওর নাম হোক – কৃষ্ণ
গৌতম তুল্য নিঃস্বার্থ – আজ থেকে ওর পরিচয় হোক- বড়ুয়া
এই নামে প্রত্যেকে নিজ নিজ ধর্মমতে প্রার্থনা জানালো,
স্বর্গের সব শান্তি হুরি ও পস্পসরি বর্ষিত হোক তার আত্মার উপর,
এবার তদন্তকর্তা তার রিপোর্ট লিখলেন –
যুবকের লাশটি বেওয়ারিশ নয়,
ওর নাম- মুহাম্মদ ডেভিড কৃষ্ণ বড়ুয়া।
প্রতিটি কবিতা পড়ার সময় পাঠকের মধ্যে সেই কবিতা নিয়ে একটি বোধের সৃষ্টি হয়। অনেক সময় সেই কবিতার অর্থও পাল্টে ফেলেন পাঠক।
কবি হয়তো সেই নিগূঢ় ভাবনাটি ভাবেনও না কবিতা লিখতে বসে, যা পাঠক নিজের মন এবং মনন দিয়ে অন্য একটি মাত্রায় পৌঁছে দেন কবিতাকে।
আমার সব সময়ই মনে হয় কবিতা ভাবনা প্রসূত নয়। আকাশের দিকে চেয়ে থাকলে, জানালায় আনমনা হলে বা চিত হয়ে শুয়ে সিলিং দেখলেই কবিতা লিখা যায় না। মূলত কবিতায় ভাবনা নয় একটি প্লট দরকার এবং সেই প্লটটিকে নারসিং করা দরকার। এই নার্সিং দিয়ে প্লটটিকে যুক্তিযুক্ত ও কাব্যময় করে তুলতে পারাই কবির দায়িত্ব। সেই দায়িত্বে পূর্ণতা আনতে পারলেই প্লটটি কবিতা হোয়ে ওঠে। ঘটনা ছাড়া কবিতা হয় না। হোক সে ঘটনা চাক্ষুষ অথবা মন গড়া। কবিতায় ঘটনা থাকতেই হবে।
পাঠক কিন্তু আকস্মিকতায় পা পিছলে পড়েন না। বরং, তার যে সময়টুকু একটি কবিতার জন্য ব্যয় করেন ঠিক তখন তিনি একটি আবিষ্কারে মেতে ওঠেন। তৃতীয় নয়নের মত এও এক তৃতীয় ভাবনা যা কি না কখনো কখনো কবির ভাবনার পাশ ঘেঁষে যায়, কখনো কবির ভাবনার উপর ওভারল্যাপিং হয় অথবা কনফ্লিক্ট করে। তবে, কবি ও পাঠকের এই খেলায়ই কবিতাটি প্রাণ পায়।
কবি স্টালিনের সাবানের পাঁচশো বছর কবিতাটিও কোনো ভাবনার মেঘভেলা নয়। এটি একটি প্লট ভিত্তিক মেধাবী কবিতা। কবিতাটিতে একটি সত্য ঘটনা আছে। কবিতাটিতে একটি ম্যাসেজ আছে, আছে একাধিক প্রাসঙ্গিক বক্তব্য। এবং সেই বক্তব্যের ধারাবাহিকতা এগিয়ে গেছে অনেকটাই প্রহসন রচনার শর্ত মেনে।
প্রহসন হাস্যরস প্রধান, স্বল্প দৈর্ঘের রচনা। ব্যঙ্গ বিদ্রুপ, শ্লেষের আবরণে সমাজের অনৈতিক, অনাচার, ধর্মীয় গোঁড়ামী ও রক্ষনশীলতা এবং প্রাত্যহিক জীবনের ত্রুটি বিচ্যুতি সমুহ তুলে ধরা হয় পূর্নাঙ্গ নাটকের মত।
কবি রেজাউদ্দিন স্টালিন এই শতাব্দিতে দঁড়িয়েও প্রহসনের অন্তর চরিত্রটি ব্যবহার করে রচনা করেন তার “সাবানের পাঁচশো বছর কবিতাটি – আত্মা পরিষ্কার করা যার স্লোগান। অথচ, যা করে যেতে পারেননি পূর্বসূরির কেউই। সেই ব্যর্থতা ঘুচাতে চান কবি স্বয়ং। যার জন্য শ্লেষাত্মক এই কবিতাটি তিনি রচনা করেছেন সমাজের সমস্ত ব্যাভিচারের দলিল পেশ করার লক্ষ্যে। সম্পূর্ণ কবিতা জুড়েই কবি শ্লেষের অভূতপূর্ব ব্যবহার করেছেন অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তা দিয়ে।
বাংলাদেশের রজনীতি ক্যাডার সর্বস্ব। অজস্র রক্তপাতেই তাদের কৃতিত্ব এবং উপযুক্ততার মানদণ্ড। গুম করা, খুন করে নদীতে ফেলে দেয়া রাজনীতির এক নতুন সংস্কৃতি। ধর্ষণ, ইভটিজিং, মিছিল মিটিংয়ের শব্দকে স্থবির করে দেয়া, লাশ গোপন করা যেন রাজনীতির পূর্ব শর্ত। এসববের দিকেই আঙুল উঁচিয়েছেন কবি রেজাউদ্দিন স্টালিন এই কবিতায়। স্টালিনের প্রতীকী ব্যবহারের শব্দাবলি, বক্তব্যের দৃঢ়তা একটি নতুন ডাইমেনশন এনে দিয়েছে কবিতাটিকে। এবং, এখানে সাবানকে এতটাই প্রভুভক্ত করে চিত্রিত করেছেন কবি যে, প্রভুর নির্দেশে খুনের দাগও মুছে ফেলতে সক্ষম সে। এই সাবান কবির এক অনবদ্য সৃষ্টি।
সাবানের পাঁচশো বছর
রেজাউদ্দিন স্টালিন
কোলাহলকে ফেনার বুদ্বুদে ডুবিয়ে দেয়া
স্তব্ধতাকে ধুয়ে সাফসুতরো করা
এবং বাতাসের মধ্যে লুকিয়ে থাকা জীবাণুকেও
বাসনকোসনের চেঁচামেচিতে ক্ষারের ফুঁ
শার্ট -প্যান্টের হাত -পায়ের মনোমালিন্যে চর্বির চুমু
মেয়েদের গোপন আলতো করে ছোঁয়া
এসব কাজে পারঙ্গমতা ইতিহাসবিদিত
অভিজ্ঞতার পাঁচশো বছর পূর্তি
নিমন্ত্রিত বিখ্যাত জীবাণুবিদ
ও ভাইরাস গবেষকগণ
কৃতিত্বের বর্ণনা:
দূষিত দানব নির্মূলের কাহিনী
অনুজ্জ্বলকে উজ্জ্বল করার গল্প
এবং অনিচ্ছাসত্ত্বেও প্রভুর আদেশে
রক্তের দাগ ম্লান করে দেয়া
মুহুর্মুহু করতালি-কেঁপে ওঠে সভাকক্ষ
নতুন এক প্রতিজ্ঞাবদ্ধ অধ্যবসায়
আত্মা পরিস্কার প্রকল্প
যা করতে গিয়ে বারবার ব্যর্থ
পিতা-প্রপিতাগণ।
“কবিতা তো শুধু কাব্য নয় সে সত্য কথা বলে, আমি সত্য লিখি সত্য বলি কবিতার ছলে” – এই পংক্তিটি কার লিখা তা আজ বিস্মৃত। তবে, কবি এবং কবিতার অধিকাংশই যে সত্য তা আমি নিজেও অনুধাবন করতে পারি। সেই বোধ থেকে বলতে পারি- কবি স্টালিন যা কিছু লিখেন তা কেবল লিখার জন্যই লিখেন না বা প্লট বিবেচনায়ও লিখেন না। তিনি যা অন্তরে ধারণ করেন, লালন করেন ব্যথিত বা আনন্দচিত্তে তাই তাঁর কাব্যে স্ফুলিঙ্গ হয়ে প্রকাশ পায়। অন্তরে বিষ না থাকলে এমন গরল মুখ দিয়ে উগরানো যায় না- এমন একটি কথা কথাসাহিত্যের সম্রাট শরৎ চন্দ্র চট্টপাধ্যায় বলে গেছেন। এই উক্তি প্রয়োগে আমি বলতে পারি কবি, কথা সাহিত্যিক, মোটের উপর লেখকগণ নিজেদের কথায়ই গল্প, উপন্যাস, কবিতায় প্রকাশ করেন। মানুষের হৃদয়ের অনুভূতিগুলো কমবেশী সকলেরই এক। যার জন্য কবি-সাহিত্যিকদের সমস্ত অনুভূতিগুলোই পাঠকের হয়ে যায়, যাকে আমরা সার্বজনীন বলে চিহ্নিত করি। কবি স্টালিনের কবিতাও সেই সুত্র ধরে সার্বজনীন হয়ে উঠেছে বর্তমান বাংলা সাহিত্যের বিচরণ ক্ষেত্রে।
“স্পর্ধা” কবিতাটি তার অতিসম্প্রতি লেখা একটি কবিতা। বহু বছর ধরেই তিনি কাব্য চর্চায় লিপ্ত আছেন। বহু ঘটনার স্টেইমেইন্ট তার কবিতায় আমরা দেখে আসছি। তাঁর কাব্য জীবনের অনেকটা পথ পেরিয়ে আজ যে তিনি একটি পারদ পৃথিবীর উপর দাঁড়িয়ে জীবন দেখছেন তা’ই এই কবিতায় তিনি ব্যক্ত করেছেন।
স্পর্ধা
রেজাউদ্দিন স্টালিন
আরেকবার আমাকে দাঁড়াতে হয়েছিলো
সেই সত্যের মুখোমুখি
যেখান থেকে শুরু পারদের পৃথিবী
মানুষের হাড়গোড় আর মজ্জা দিয়ে তৈরি
চোখের নুন আর জিহ্বার কান্না দিয়ে
কর্কট আর মকর ক্রান্তির অন্তিমে
দু:খের অনি:শেষ দরোজায়
না মাড়ানো সেই সব গহীন পথ
হৃদয়ের ফাঁক ফোকর
বাতি না জ্বালানো সন্ধ্যার তলদেশ
দেখা যায় না জীবন তার সন্ধিক্ষণে
আরেকবার আমাকে দাঁড়াতে হয়েছিলো
নজিরবিহীন দু:খস্তূপের উপর
ভেঙে খান খান হয়ে যাওয়া আকাঙ্ক্ষা
আর যেখান থেকে ফেরা যায় না
অরব রাত্রির উপর
হতাশার হিংস্রতায় আটকে যাওয়া পদক্ষেপ
শিকার লোলুপ নারকীয়তার মাঝখানে
রক্তচিহ্ন রেখে না যাওয়া তরবারির সামনে
নিকষ কালো বর্ণমালার মুখোমুখি
পাঠ করা যায় না যে সূর্যাস্ত
চিৎকারের প্রতিবিম্ব ঠাসা স্বপ্ন
জানালার দাঁত ভাঙা দৃষ্টির হাতুড়ি
কোনো দেয়াল আঁকড়ে থাকা লতাগুল্ম নয়
হাতের মধ্যে সহজ হয়ে যাওয়া
স্তনের অবাধ্যতা নয়
আকাশের উগরে দেয়া বজ্রের সামনে
আমাকে আরেকবার দাঁড়াতে হয়েছিলো
তুচ্ছ সব সাবধানবাণীর অট্টালিকা
রুটিমোড়া চুল্লির গনগনে শাসনের সামনে
সবুজ আর লালে তৈরি কালোর সংকেত
আর খড়গের এক কোপে বলি দেয়া প্রতিজ্ঞা
ডানা পালক নখ চিবুক আঙুলের
খণ্ড খণ্ড আর্তনাদের সামনে
আরেকবার আমাকে দাঁড়াতে হয়েছিলো
ভেঙে ফেলা সব উল্লম্ফন
ছুঁড়ে ফেলা কণ্ঠস্বর
টুকরো করা অনুভব
আত্মাসন্ধানী কণ্ঠনালীর পরিণাম
যুক্তির শিরোচ্ছদ খ্যাত বধ্যভূমি
আগ্নেয়াস্ত্র আড্ডা দেয়া সড়ক
অন্তহীন অভিযোগের শ্রোতা-সদা প্রভুর সামনে আরেকবার দাঁড়াতে হয়েছিলো আমাকে
আমার অহংকার হাঁটু মুড়ে বসতে চেয়েছিলো
এবং মনুষ্যত্ব ক্ষমা প্রার্থনায় নত হতে
কোটি কোটি বছরের শ্রমে তৈরি পা
কি করে উবু হবে
হাজার বছরের ভালোবাসায় তৈরি
মনুষ্যত্ব কি করে নত হবে।
তাঁর কবিতায় বানানো কথা নেই। কল্পনার অবতারণা কম। ইট-পাথর, জল- হাওয়া, চাঁদ- সূর্য সমাজ-মানুষ সব কিছু যে যার মত ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া করছে, কবি নিরলস ভাবে তাই লিখে আসছেন। তাইতো কবি তাঁর “ব্যবচ্ছেদ” কবিতায় আবেগ বদল করে বেঁচে থাকার কথা বলতে সক্ষম হয়েছেন-
“এই নগরে আবেগ বদল করে বাঁচতে হয়
উপবাস আর ভোজন ভরা চোখ
শুনতে হয় শয়তানের আশীর্বাদ
স্মৃতি এক নিরব ঘাতক
তবু নরক থেকে বাঁচতে
তার হাতে ধরা দিই বার বার” — (কবিতা-ব্যবচ্ছেদ)।
তবে, কল্পনা যে একেবারেই নেই তাও নয়। কল্পনাশূন্য, আবেগশূন্য মানুষ তো আর হতে পারে না। স্টালিনেরও কল্পনা আছে তাঁর উপমা আবিষ্কারে, প্রতীকী সংযোজনে। যার জন্য পারদের পৃথিবীর মত একটি পৃথিবী তিনি দেখতে পান। কবিতায় এতটা সূক্ষ্ম অথচ ব্যহারিক উপমা বা রূপক স্টালিনই আনতে পারেন সাবলীল ভাবে তা এই কবিতায় প্রামাণ্য।
পারদের উপর কে কবে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে পেরেছে বা পারবে? কবিও শঙ্কিত। তবুও, তিনি সত্যের মুখোমুখি সেই পৃথিবীতেই দাঁড়িয়ে আছেন, যে পৃথিবী বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে প্রতিক্ষণে।
সত্যকে তিনি দেখতে চান। মুঠোয় ভরে সত্য আহরণ করতে চান। তাঁর চতুর্দিকে সত্য ছড়িয়ে দিয়ে মিথ্যেকে সত্যের নিচে সমাহিত করতে চান।
কবি যেন একান্ত দায়বদ্ধ তাঁর দেশের কাছে, সমাজের কাছে। তাই, বারবার তাঁকে সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়েছে ব্যক্তিগত প্রেম, নারী মোহ, হাতের মুঠোয় সহজলভ্য হয়ে ওঠা যৌনপ্রেম, সুখ, আহলাদ সবকিছু জলাঞ্জলি দিয়ে সেইখানে, যেখান থেকে শুরু এক পারদের পৃথিবীর এবং যে পৃথিবী তৈরী হয়েছে মানুষের হাড়গোড় আর মজ্জা দিয়ে, চোখের নুন আর জিহ্বার কান্না দিয়ে। কর্কট আর মকর ক্রান্তির অন্তিমে, দু:খের অনি:শেষ দরোজায় না মাড়ানো সেই সব গহীন পথ যেখানে সেখানেও দাঁড়াতে হয়েছে কবিকে। দাঁড়াতে হয়েছে হৃদয়ের ফাঁক ফোকর আর বাতি না জ্বালানো সন্ধ্যার তলদেশে, যেখান থেকে দেখা যায় না জীবন তার সন্ধিক্ষণে। তাঁকে দাঁড়াতে হয়েছে নজিরবিহীন দু:খস্তূপের উপর, ভেঙে খান খান হয়ে যাওয়া আকাঙ্ক্ষা, আর যেখান থেকে ফেরা যায় না সেই অরব রাত্রির উপর। দাঁড়াতে হয়েছে যেখানে শুধুই নারকীয়তা সেইখানেও।
কখনো কখনো তাঁর অহঙ্কার হাটু মুড়ে বসতে চাইলেও স্টালিন টার্ন ব্যাক করেছেন। হাজার বছরের তৈরী তাঁর মনুষ্যত্ব ধরে রেখেছেন সকল ভালোর, কষ্টের স্বপক্ষে।
কবি রেজাউদ্দিন স্টালিনের প্রতিটি কবিতার জমিনই ভীষণ স্নিগ্ধ। তাঁর কবিতায় এক ধরনের মায়া আছে। কোথায় যেয়ে যেন নিজেকেই পাওয়া যায় সেই মায়াময় কবিতার জমিনে বিশ্রাম নিতে। তাঁর কবিতা স্বমহিমায় উজ্বল। অর্থাৎ, মৌলিকতায় ভাস্বর যা শুরু থেকে আজ অবধি মালিন্যতায় থুবড়ে পড়েনি। তাঁর কবিতায় প্রতিটি অনুভূতিই বক্তব্য হোয়ে ওঠে, যা কিনা কবির হৃদয় ছুঁয়ে আসতে পাঠককে একটি সহজ পথ নির্মানে সহয়তা করে।
রেজাউদ্দিন স্টালিনের কবিতায় বক্তব্যের প্রয়োজন ব্যতিত কোনো শব্দ, উপমা, উৎপ্রেক্ষা, রূপকল্পের বাড়াবাড়ি নেই। দৃষ্টি ভঙ্গী এবং অনুভবের সূক্ষ্মতায় তাঁর কবিতা দেশেতো বটেই বিদেশেও সমাদ্রিত। তাই, বিভিন্ন ভাষায় বিরামহীন অনুবাদের কাজ চলছে স্টালিনের কবিতার।
কবিতার আকাশে কবি রেজাউদ্দিন স্টালিন এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হ’য়ে চিরকাল জ্বলতে থাকুক – পাঠক এবং শুভার্থী হিসেবে এই আমার কাম্য।