শাকুর মজিদ
কবি শামসুর রাহমানের সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ ১৯৮৮ সালে। তার শুক্রাবাদ (তল্লা বাগ) এর বাসায় আমি প্রথম যাই তার কাছ থেকে একটা কবিতা আনতে । নগদ ২০০ টাকা দিয়ে কবিতা এনেছিলাম একটা পাক্ষিকের জন্য। সেই পাক্ষিকের ‘উপদেষ্ঠা’তে আমি নাম লিখিয়েছিলাম হুমায়ূন আহমেদের। আমি তার নির্বাহী সম্পাদক। ঈদসংখ্যা প্রকাশের জন্য উপদেশ নিতে গেলাম হুমায়ূন আহমেদের । তিনি বললেন, সূচনা পাতার পর শামসুর রাহমানের কবিতা দিয়ে মলাট খুললে দেখতে ভালো লাগবে। আমি চলে গেলাম কবির বাসায়। সামান্য আলাপ পরে ২০০ টাকা হাতে গুঁজে দিয়ে বললাম আমি পরশু এসে নিয়ে যাব। তিনি কিন্তু আমাকে কবিতা দিয়েছিলেন।
এরপর আমার এক বিলেত প্রবাসী কবিবন্ধু দিনার হোসেন এর কবিতার বইয়ের ভূমিকা লিখিয়েছিলাম তাকে দিয়ে ১৯৯০ সালে। আমি তখন খেপে ছাপাছাপির কাজও করি। পড়ি বুয়েটের থার্ড ইয়ারে। ৩০০ কপি কবিতার বই ছাপিয়ে দেয়ার কাজ পেলাম। দিনারের সঙ্গে আমাকে যুক্ত করিয়ে দিয়েছিলো আমার বিলেত প্রবাসী আরেক কবি বন্ধু আতাউর রহমান মিলাদ। এক সময় লন্ডন থেকে কবি আসে ঢাকায়। আমার কাছাকাছি বয়সের তরুন কবি। বুয়েটের আমার হলে এসে ছাপার খরচ আমার হাতে দিয়ে বলে – শামসুর রাহমানকে দিয়ে পেছনের ফ্ল্যাপে লেখাতে পারলে তার বড় ভালো লাগবে।
তাকে সিলেট পাঠিয়ে আমি বইয়ের ফাইনাল প্রুফ নিয়ে হাজির হলাম কবির বাসায়। তখন তিনি চলে গেছেন শ্যামলী। আমার পরিচয়- তখন আমি ‘আজকের কাগজ’ এর বুয়েট প্রতিনিধি। কবির কাছে সব খুলে বললাম। তিনি বললেন, প্রুফ কপিটা রেখে যেতে, পরশু এসে নিয়ে যেতে বলেন। আমার অনুরোধ রেখেছিলেন তিনি। লিখে দিয়েছিলেন তার আশির্বাদ বানী, নতুন কবির জন্য কিছু পরামর্শও ছিলো তার লেখায়।
এর পরে ১৯৯২ সালে আবার তার শ্যামলির বাসায় যাই। আমি তখন বাংলাবাজার পত্রিকার ‘স্টাফ রাইটার’, কিন্তু মাঝে মাঝে আমাকে ছবি তোলার জন্যও পাঠানো হতো । কবি শামসুর রাহমানের জন্মদিনে তার ওপর একটা লেখার সঙ্গে নতুন ছবির প্রয়োজন হল রিটন ভাইর। সে সময় ছোটদের পাতা ‘হৈচৈ’ ছাড়াও সাহিত্য পাতা দেখা শুরু করেছেন তিনি । বার্তা সম্পাদক হিফজুর ভাই আমাকে পাঠালেন অফিসের ফ্রী ফিল্ম দিয়ে। আমি অনেকক্ষন থেকে অনেক ভাবে তার অনেকগুলো ছবি তুললাম । তার মায়ের সঙ্গেও ছবি তুললাম । কাজ শেষে ব্যাগ গুছিয়ে আমি যখন নেমে আসছি, পেছনে চেয়ে দেখি আমাকে বিদায় দিতে কবি দোতালা থেকে নামছেন ।
বিকেলের হেলানো আলো দরোজা ফুড়ে তার মুখের ওপর পড়েছে আর তার ছায়া গিয়ে পড়লো সিঁড়ির ল্যান্ডিং-এর দেয়ালে । আমি কবিকে আটকাই। ব্যাগ খুলে ক্যামেরা বের করি এবং আবার ছবি তুলি । একটাই ফ্রেম, একটাই শট। তখন মনে হলো, এ আলোয় একটা পোর্টেটও তোলা যায় । শামসুর রাহমান খুবই ক্যামেরা ফ্রেন্ডলি । তাকে দিয়ে পোজ দেয়ানোও যেতো । আমি তার আরেকটা শট নেই ।
অফিসে ফিরে এসে ফটোগ্রাফার শাহীন ভাইকে ফিল্ম বুঝিয়ে দিলাম। তিনি প্রিন্ট করে বের করলেন ২টা ছবি । তার একটি সর্বশেষ তোলা পর্ট্রেট। আমার ইচ্ছা ছিলো ছায়া পড়া ছবিটা যেনো ছাপা হয়, কিন্তু ওটা প্রিন্টই করা হলো না। আমাকে যুক্তি দেখানো হলো, নিউজ প্রিন্টের কাগজে ওটা কিছুই আসবে না । আমি বুঝ মেনে নিলাম । আসলে ছবি ছাপা হয়েছিলো মায়ের সঙ্গে কবির ছবি। জন্মদিন বলেই মার সঙ্গে তোলা ছবিটা গুরুত্ব পেলো।
কবির আরেকটি মজার ছবি তুলি ১৯৯৩ সালে, সে বছর বাংলা ১৪০০ সাল মহা ধুমধামে পালিত হচ্ছে। দুই বাংলায় দুই দিন অবশ্য। আগেরদিন কলকাতায় করে পরের দিন ঢাকায় এসে সামিল হয়েছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। তাকে নিয়ে বাংলা একাডেমির মঞ্চে বসেছেন এই বাংলার দুই সূর্য, দুই শামস। একজন শামস-উল-হক (সৈয়দ শামসুল হক) আরেক জন শামস-উর-রহমান (শামসুর রাহমান) একজন সত্যের সূর্য আরেকজন দয়ার সূর্য আর পাশে সুনীল আকাশ।
অবশ্য এই দুই শামস-কে আমি আরো আগেই আমার অটোফোকাস ক্যামেরায় বন্দি করি ১৯৮৭ সালে বাংলা একাডেমিতে সব্যসাচী নামক এক বইয়ের স্টলে যখন দুই কবি বসেছিলেন।
এরপর অনেকদিন কবির সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ নাই। আমি ফার্ম আর কাজ নিয়ে ব্যস্ত। ১৯৯৭ সালে এক সপ্তাহের নোটিসে আমারই লেখা এক নাটকের (শেষ দৃশ্য) শুটিং এর জন্য ফটো এক্সিবিশনের সেট বানাতে গিয়ে নিজের তোলা ছবির প্রদর্শনীর আয়োজন করি। এখন উদ্বোধন করাই কারে দিয়া ?
আমি থাকি তখন শ্যামলীতে, অফিস লালমাটিয়া। সকাল বেলা অফিসে আসার পথে শ্যামলী ২ নং রোডে ঢুকে গেলাম।। কবি শামসুর রাহমানের বাড়ি এখানে। বাংলাবাজারে থাকার সময় তার জন্মদিনের বিশেষ প্রতিবেদনে পোর্টেট তুলেছিলাম, তার মার সঙ্গে তার ছবি ছাপা হয়েছিল। সেটা দেখে পত্রিকায় ফোন করে ধন্যবাদ দিয়েছিলে্ন ১৯৯২ সালে। সেই ফটোগ্রাফার এখন তরুন আর্কিটেক্ট আর অতি নবীন নাট্যকার। তার নাটকের শুটিং এর জন্য একজিবিশন হবে, শুনলে তিনি রাজী হয়েও যেতে পারেন।
গিয়ে দেখি বিষয়টা আরো সহজ। তিনি আমাকে চিনেই ফেললেন। নাটকের বিষয়টা চেপে গেলাম, শুধু ফটো একজিবিশন। তিনি প্রধান অতিথি হতে রাজি হয়ে গেলেন।
সেই প্রদর্শণী তিনি উদ্বোধন করেন, ঘুরে ঘুরে দেখেন এবং তার মায়ের ছবিটার সামনে এসে তিনি অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে একবার চশমা মুছলেন।
যাবার আগে কমেন্টসের খাতায় আমাকে আশির্বাদ করে লিখলেনও কিছু।
১৯৯৭-এর পর আরো প্রায় এক দশক বেঁচেছিলেন কবি। মারা গেলেন ২০০৬ সালের ১৭ আগস্ট। কিন্তু এর মধ্যে তার সঙ্গে আমার আর কখনোই উল্লেখযোগ্য সাক্ষাৎ হয়েছে বলে মনে করতে পারছি না। এই সময়টা আমি টেলিভিশন ফিকশন নির্মানে যুক্ত ছিলাম, আমার বই প্রকাশনা শুরু হয় ২০০৮ সাল থেকে। সে কারণে কবিকেও আমি আর পাই নি। আমার সঙ্গে বসে গল্প করারও কোন স্মৃতি নাই, যেমনটি তার সময়কার লেখক সৈয়দ হক বা সুনীল-সমরেশকে নিয়ে সামান্য হলেও আছে।