মার্চের শেষ সপ্তাহান্ত ২০২০, করাচী।
ভয়াবহ দুর্বিপাকে পড়েছে বিশ্ববাসী। করোনা-আক্রান্তের সংখ্যা বিশ লক্ষের দিকে ধাবমান, আক্রান্তের সংখ্যা বিশ লক্ষের দিকে ধাবমান, মৃত সাড়ে চার লক্ষ ছুঁই ছুঁই, আতংকে গৃহবন্দী বিশ্ববাসী। ছাত্রজীবনে পড়েছিলাম – “A virus can hang for decades like inert chemical without losing any of its virulence. But whenever subjected to a living cell it jumps to life with all its cruel efficiency”. সবচেয়ে বেশী আতংকিত কোটি কোটি গৃহবন্দী গরীব মুটে মজুর। ক্ষুধার তীব্র দহনে জ্বলে যাচ্ছে শরীর, চোখের সামনে ক্ষুধায় তড়পাচ্ছে বাচ্চাগুলো। কিন্তু অসহায় চেয়ে দেখা ছাড়া কিচ্ছু করার নেই।
কিন্তু এখন সেখানে উৎসবের চিৎকার। বৌ বাচ্চ্চার হাত ধরে করাচীর রেহরি গোঠের দিকে ছুটছে হাজারো ক্ষুধার্ত মানুষ, চোখে মুখে তাদের খুশীর আভা। ঘোষণা দেয়া হয়েছে তাদের মধ্যে চাল ডাল ত্রাণসামগ্রী বিলানো হবে। লাইন ধরে দাঁড়িয়েছে হাজারো পরিবার, আইডেন্টিটি কার্ড দেখে দেখে ত্রাণসামগ্রী দেয়া হচ্ছে তাদের। এক জায়গায় এসে থমকে গেলেন ত্রাণদাতা।
“আপনি তো হিন্দু।”
“জ্বী হ্যাঁ”।
“সরে দাঁড়ান লাইন থেকে। এই ত্রাণসামগ্রী শুধুমাত্র মুসলিমদের জন্য।”
কি??
ক্ষোভে অপমানে স্তম্ভিত চেয়ে রইল নিরন্ন ক্ষুধার্ত মানুষগুলো, বাচ্চাগুলো। কার্ড দেখে দেখে সরিয়ে দেয়া হল সব অমুসলিম পরিবারকে। তারা চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগল কি আনন্দে ত্রাণসামগ্রী নিয়ে যাচ্ছে মুসলিম পরিবারগুলো। দিন না যেতেই ফুটন্ত ভাতের হাঁড়ির মতো টগবগ করে উঠল ইন্টারনেট। সেই অজস্র সংবাদ লিংক পড়ে বিশ্ববাসী ইসলাম/মুসলিম সম্পর্কে কি ধারণা করল তা সহজেই অনুমেয়। কিছু লিংকের হেডলাইন:-
• পাকিস্তানের বর্বর চেহারা ফের প্রকাশ্যে এল। করাচিতে লকডাউন চলাকালীন হিন্দুদের রেশন দেওয়া হবে না বলে সাফ জানাল পাক প্রশাসন।
• করোনার জেরে লক ডাউন: হিন্দুদের রেশন আটকে অভুক্ত মারার চক্রান্ত পাকিস্তানে।
• করোনা লকডাউনে ইমরান প্রশাসনের অমানবিক চেহারা! ত্রাণ থেকে ব্রাত্য হিন্দুরা।
কিন্তু হিসেবটা তো মিলছেনা। একটা দেশের সরকার তা সে যতই সাম্প্রদায়িক হোক, প্রকাশ্যে এমন করলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মুখে চুনকালি পড়ে হুঁকো নাপিতে টান পড়বে, চিরকাল তিরস্কার শুনতে হবে। এমন তো হবার কথা নয়! ইন্টারনেটের লিঙ্কগুলো খুঁটিয়ে দেখতেই ফাঁকি ধরা পড়ল। লিঙ্কগুলো সবই ভারতের। এই দু’দেশের সংবাদমাধ্যমগুলো পরস্পরের ব্যাপারে নির্লজ্জ্ মিথ্যাবাদী। তাই খুঁজে খুঁজে ইটালীর “এশিয়া নিউজ”-এ পেলাম আসল ঘটনাটা। গরীবদেরকে ত্রাণসামগ্রী দিয়েছে সরকার নয়, দিয়েছে ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এনজিও সায়লানী ওয়েলফেয়ার ট্ৰাষ্ট এবং সেটা দিয়েছে যাকাতের টাকা থেকে। এখানে এসেই স্পর্শকাতর প্রশ্নটা দাঁড়িয়ে গেল – অমুসলিমদেরকে যাকাত দেয়া যাবে কি?কোরানে সুরা তওবা আয়াত ৬০ সহ কয়েকটি আয়াতে ‘সাদাকাতুন’ বলে যাকাত বোঝানো হয়েছে, যে ৮ ধরণের লোককে যাকাত দিতে হবে তাতে ধর্মের ভিত্তিতে কাউকে বাদ দেয়ার হুকুম নেই:- “নিশ্চয়ই সদকাহ্ (যাকাত) হলো আসলে ফকীর মিসকীনদের জন্য। আর যারা সাদকা সংক্রান্ত কাজে নিযুক্ত এবং যাদের জন্য মন জয় করা প্রয়োজন তাদের জন্য। তাছাড়া দাস মুক্ত করার, ঋণগ্রস্তদের সাহায্য করার, আল্লাহর পথে এবং মুসাফিরদের উপকারে ব্যয় করার জন্য”।
•কিন্তু যাকাতের অর্থ অমুসলিমদেরকে দেয়ার বিপক্ষে শারিয়া আইন বানানো হয়েছে (আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় দ্বারা স্বাক্ষর ও স্ট্যাম্প দ্বারা সত্যায়িত শাফি আইন কেতাব “উমদাত আল সালিক” আইন নং h8.24 এবং হানাফী আইন হেদায়া পৃষ্ঠা ১৯ ও ২০)। একটু গভীরে গেলে দেখা যাবে ইমামেরা মুসলিম-অমুসলিমদের মধ্যে তৎকালীন বিদ্যমান জীবন-মরণ যুদ্ধের প্রেক্ষিতে ইজতিহাদ করে ওই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন কারণ যুদ্ধের সময় শত্রুকে সাহায্য করার অর্থ আত্মহত্যা করা। তাহলে সায়লানী ওয়েলফেয়ার ট্ৰাষ্ট কাজটা কিভাবে ইসলাম মেনেই করতে পারত? দেখা যাক ইসলামী দলিল, মুসলিম ইতিহাস ও বিশেষজ্ঞরা এ ব্যাপারে কি বলেন।
• শারিয়া আইন লেখা হয়েছে নবীজীর (স) বহু বছর পরে। তাঁর এবং খুলাফায়ে রাশেদীনের সময়ে (এবং পরবর্তী কালেও) যাকাত জমা হত বায়তুল মাল-এ যেটার প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল গরীবদের সাহায্য করা। সেখানে কোনো গরীবকে ধর্মের ভিত্তিতে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে এমন কোন দলিল আমরা পাইনি।
•কোরান রসূলের (স) বিভিন্ন হুকুমগুলোর তালিকা করলে দেখা যাবে সেগুলোর কিছু ১. পুরো মানবজাতির জন্য, ২. শুধুমাত্র মুসলিমদের জন্য, ৩. শুধুমাত্র মুসলিম পুরুষদের জন্য, ৪. শুধুমাত্র মুসলিম নারীদের জন্য, ৫. শুধুমাত্র সেই সমাজের জন্য, ৬. কিছু হুকুম চিরকালের জন্য, ইত্যাদি। স্বভাবত:ই, একের ওপরে বা এক পরিস্থিতির বিধান অন্যের ওপরে বা অন্য পরিস্থতিতে প্রয়োগ করলে বিপর্যয় ঘটবে। সেজন্যই বাইরের কোনও চাপ ছাড়াই মুসলিমেরা নিজেরাই চিরকাল সমাজ বদলের সাথে সাথে বিধানের ক্রমাগত পরিবর্তন করেছেন এবং এখনও করছেন।
•মনে আছে ছোটবেলায় মা আপনাকে বলেছিলেন “যাও গোসল কর” আরেকদিন বলেছিলেন “গোসল করো না”? তাহলে আমরা কি বলতে পারি আপনার মা থুক্কু করে আগের ভুলটা শুধরেছেন? মোটেই তা নয়। “যাও গোসল কর” তিনি বলেছিলেন যেদিন আপনি খেলা শেষে ধুলোমাখা দেহে ঘরে ফিরেছিলেন, এবং “গোসল করো না” বলেছিলেন যেদিন আপনার জ্বর হয়েছিল। আপনার কল্যাণ হল তাঁর মূল্যবোধ, ওটা ঠিক রাখার জন্যই নির্দেশ বদল। চিন্তা করুন, যদি তিনি জ্বরের দিনেও বলতেন “যাও গোসল কর” তবে আপনার কি অবস্থা দাঁড়াত?
•দেখুন মওলানা মুহিউদ্দিনের কোরানের অনুবাদ পৃষ্ঠা ৩৩৪ ও ৫৩:- ‘‘নাসিখ ও মনসুখের অবস্থা একজন বিজ্ঞ হাকিম ও ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্রের মতো। ডাক্তার যখন পূর্ববর্তী ব্যবস্থাপত্র রহিত করে নূতন ব্যবস্থাপত্র দেন তখন এরূপ বলা ঠিক নয় যে পূর্বের ব্যবস্থাপত্রটি ভুল ছিল। বরং আসল সত্য হচ্ছে এই যে, বিগত দিনগুলোতে সে ব্যবস্থাপত্রই নির্ভুল ও জরুরি ছিল এবং পরবর্তী পরিবর্তিত অবস্থায় পরবর্তী পরিবর্তিত এ ব্যবস্থাপত্রই নির্ভুল ও জরুরি’’। এটা সুন্নাহের ক্ষেত্রেও সত্য, উদ্ধৃতি:- “নবী (দঃ)-এর সময়েই কোরান ও সুন্নাহ-তে কিছু সম্পূর্ণ ও কিছু আংশিক পরিবর্তন করা হয়। পরিস্থিতির পরিবর্তনই ইহার মূল কারণ” – বিশ্ববরেণ্য ইসলামী বিশেষজ্ঞ ডঃ হাশিম কামালি- ‘প্রিন্সিপলস অব্ ইসলামিক জুরিসপ্রুডেন্স’। বিধান বদলের এমন অজস্র উদাহরণের অগ্রপথিক হযরত ওমর (রা:)। এ বিষয়ে আগ্রহীরা অনেক উদাহরণ পাবেন “মতামত” বিভাগে আমার লেখা প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ ও হজরত ওমরের (রা:) শাসন: সমান উত্তরাধিকার নিবন্ধে।
•তাহলে “কোরান ও সুন্নাহ-তে কিছু সম্পূর্ণ ও কিছু আংশিক পরিবর্তন” করে অতীতের আলেমরা কি ইসলাম লঙ্গন করলেন? না, করেন নি। জীবনের প্রয়োজনে মূল্যবোধ বজায় রেখে কোরান-সুন্নাহের কোন বিধানকে সাময়িকভাবে স্থগিত করার বিধান ওই কোরানই দিয়ে রেখেছে। ইজতিহাদ করে অতীতের আলেমরা সেই পদ্ধতিটাই মেনেছেন ও তাতে সমাজের প্রভূত কল্যাণ হয়েছে। এখনো এই করোনা-সংকটেও আলেমরা ইজতিহাদ করে জীবনের নিরাপত্তার কারণে সাময়িকভাবে হজ্ব, ওমরা ও মসজিদে জুমার নামাজ স্থগিত বা সীমাবদ্ধ করেছেন। কোরানের দেয়া সেই পদ্ধতিটা কি তাহলে? এ পদ্ধতির সমর্থন হাদিসেও আছে কিন্তু নিবন্ধ লম্বা হবে বলে সেদিকে যাচ্ছিনা।
• কোরান শুকুরের মাংস খাওয়া হারাম করেছে চারটি আয়াতে – বাকারা ১৭৩, মায়েদা ৩, আনাম ১৪৫ ও নাহল ১১৫। এখন, যে মুসলিমের সামনে শুকরের মাংস ছাড়া আর কিছু নেই সে কি করবে? না খেয়ে মরবে? না, সেটা জীবনবিরোধী, তাই পথ দেখিয়েছে ওই কোরানই। শূকরের মাংস অবৈধ করার পরপরই ওই প্রত্যেকটি আয়াতে অবধারিত দেয়া আছে বেহেশতী বরাভয় – “অতঃপর কেউ পাপের দিকে না ঝুঁকে ক্ষুধার তাড়নায় বাধ্য হলে তবে নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।”
•সায়লানী ট্রাস্ট তাহলে কি করতে পারত? এক – কোরান যাকাতের সাহায্য অমুসলিমদেরকে দেয়াটা বৈধ রাখলেও অতীতের আলেমরা মুসলিম-অমুসলিমদের সশস্ত্র ধর্মযুদ্ধের ভিত্তিতে ইজতিহাদ করে তা স্থগিত করেছিলেন। এখন যেহেতু অমন ধর্মযুদ্ধ নেই তাই সায়লানী ট্রাস্ট আলেমদেরকে অনুরোধ করতে পারত ইজতিহাদ করে যাকাতের সাহায্য কোরান মোতাবেক অমুসলিমদেরকে দেয়াটা বৈধ করতে। দুই – সেটা করতে না পারলে সায়লানী ট্রাস্ট অমুসলিমদের জন্য আলাদা টাকা তুলে তাদের ত্রাণসামগ্রী দিতে পারত।
প্রতিটি বিষয়ে বিশ্বমানসে “রিসেট বাটন”-এ চাপ পড়েছে, দুনিয়া বদলে গেছে চিরকালের জন্য। এই দুঃসময়ে সমূহ দরকার ধর্মের ব্যাখ্যা দিয়ে পরস্পরকে কাছে টেনে নেবার, দূরে ঠেলে দেবার নয়। সবাই ভালো থাকুন, নিরাপদে থাকুন।
করুণাময়ের বিশ্ব এখন বিকট করোনাময়,
পৃথিবী ঘিরেছে মহা আশংকা, আতংক আর ভয়।
বিপরীত স্রোতে সময়ের ঝড় মাঠঘাট প্রান্তরে,
পশুপাখী ঘোরে মহা আনন্দে, মানুষ বন্দী ঘরে।
প্রকৃতির প্রতিশোধের হাতুড়ী পড়েছে বজ্রাঘাতে,
পরাক্রান্ত “শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি” আজ ভূমিশয্যাতে….