এই মাত্র ক’দিন আগেও আমি নিজেকে যথেষ্ট শক্ত মনের মানুষ হিসেবে জানতাম। সেদিন মায়ের সাথে দুই মিনিট কথা বলেই আমার মানসিক শক্তির ভিত ধসে গিয়েছে। মা বেশ ক’বছর হলো বিভিন্ন রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত। আমাদের পরিবারে করোনাতে তার ঝুঁকিই সব চেয়ে বেশি। সে মোতাবেক মাকে সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং ইত্যাদি নির্দেশনা দিলাম। আমার মা সব শুনে বললেন, “মণি, তুই এতো চিন্তা করিস নে। আমাদের কপালে যা আছে, তাই হবে। এখানে তো আমরা বিনা চিকিৎসায় মারা যাব। কেউ তো ভয়ে কোন রোগীর কাছে আসছেনা। কপালে থাকলে দেখা হবে।“
এরপর থেকে আমার মনের শান্তি উধাও। বুঝতে পারছি, বিষণ্ণতা আমাকে গ্রাস করছে। তাই ডব্লিউএইচও’র পরামর্শ মেনে করোনা সংক্রান্ত সব খবরা-খবর থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করেছি। কিন্তু চাইলেই কি তা সম্ভব? আজ প্রথম আলো পত্রিকায় দেখলাম, ঢাকায় ১৬ ঘন্টায় ৬ টা হাসপাতালে ঘুরে বিনা চিকিৎসায় প্রচন্ড কষ্ট পেয়ে একজন মুক্তিযোদ্ধা মারা গিয়েছেন। ডাক্তাররা আর নার্সরা যখনই শুনেছে তার শ্বাসকষ্ট আছে তখনই পিছিয়ে গিয়েছেন। করোনা সংক্রমণ হয়েছে সন্দেহে ভর্তি করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। ৬ টা হাসপাতালে সন্তানেরা ঘুরে বেড়িয়েছেন তাদের বাবাকে বাঁচানোর জন্য। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। ঠিক যেমনটা আমার মাকে আমাকে ক’দিন আগে বলেছেন।
ক্ষোভে দুঃখে চাইলে আমি, আপনি ডাক্তারদের গালি দিতে পারি। কিন্তু তাদের কথাও তো ভাবতে হবে। আমার দুই নিকটাত্মীয় ডাক্তার। এইমাত্র কথা বললাম, তারা এখনো পিপিই পায়নি। এই পিপিই নিয়ে বিরাট কাণ্ড কারখানা চলছে। হাজার হাজার স্বাস্থ্যকর্মী যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও সরঞ্জাম ছাড়াই চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন এবং অনেকে ইতোমধ্যে আক্রান্তও হয়েছেন। এ তো এক ধরনের সুইসাইড মিশন। স্থায়ীভাবে ক্যানাডায় বসবাস করছি সাত বছর হলো। একবারের জন্যেও বাংলাদেশকে ক্যানাডার সাথে তুলনা করিনি, না বন্ধুদের সামনে, না সোশ্যাল মিডিয়ায়। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাষ্ট্র ক্যানাডার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, রাজনৈতিক ও সামাজিক সংস্কৃতি, জনগোষ্ঠীর সার্বিক নাগরিক শিষ্টাচার ইত্যাদির ইতিহাস শত বছরের পুরনো। তাই কোন প্রকার তুলনা নিতান্তই বালখিল্যতা।
মাঝেমধ্যে হতাশ হয়ে দুই একবার পাশের দেশ বা একই পর্যায়ের উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের সাথে তুলনা করেছি। আজকেও তাই করছি। ভারত, নেপাল কিংবা আমরা যে উগান্ডাকে নিয়ে সস্তা হাসি তামাশা করি, করোনা মোকাবিলায় তাদের প্রস্তুতি বাংলাদেশের চেয়ে বহুগুণে ভালো। গত সপ্তাহে ‘করোনা মোকাবেলায় প্রস্তুতিতেই ঘাটতি ছিল অনেক’ শিরোনামে প্রথম আলোয় প্রকাশিত হয়েছে বন্ধু শেখ সাবিহা আলমের একটি প্রতিবেদন। সেখানে তিনি তথ্য উপাত্ত দিয়ে দেখিয়েছেন করোনা প্রস্তুতিতে বাংলাদেশের ঘাটতির কথা। তিন মাসের মত সময় পাবার পরও কিভাবে বাংলাদেশ প্রস্তুতির সকল সুযোগ হেলায় নষ্ট করেছে তা ভেবে হতাশ হয়েছি। পত্রিকাটির বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকতে পারে কিন্তু প্রতিবেদনের একটি শব্দের সাথেও দ্বিমত পোষণ করার সুযোগ নেই।
আক্রান্ত দেশগুলো থেকে যখন বিমানবন্দর হয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার বিদেশ ফেরত মানুষ দেশে আসলো, দেশের ১৮ কোটি মানুষের সাথে ধীরে ধীরে মিশে গেল, কর্তৃপক্ষ তখন এ ব্যাপারে ভ্রুক্ষেপ করলেন না। মন্ত্রীদের কেউ বললেন, ইতালি যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও ভালো প্রস্তুতি আছে, কেউ বললেন, করোনো কিছুই না, এটা সাধারণ ঠাণ্ডা-কাশির মতোই। এখন প্রবাসীদেরকে পুলিশ বাড়ি বাড়ি গিয়ে খোঁজে! শুনেছি, অবস্থা ভেদে হাজার থেকে লক্ষ টাকা ঘুষ চায়। সমালোচনার মুখে স্কুল কলেজ আর অফিস বন্ধ হলো। কিন্তু মানুষকে সময়মত সচেতন করা হলোনা।
মানুষ প্রমোদ ভ্রমণে গেল। আর এখন করোনা দমাতে রাস্তায় পেটানো হচ্ছে দিনমজুর আর রিকশাওয়ালাকে। দেশের জনগণের অজ্ঞতা, বিদেশ ফেরতদের দায়িত্বহীন আচরণ, বিরাট জনগোষ্ঠীর ধর্মান্ধতা ইত্যাদিকে দোষারোপ করাই যায়। কিন্তু দিন শেষে সরকারের উপরেই সব দায় বর্তায়। সম্পদের অপ্রতুলতার চেয়ে অব্যবস্থাপনার কারণেই যে প্রস্তুতির এই হাল তা কে কাকে বোঝাবে। বাংলাদেশের ব্যুরোক্রেসি কখনোই প্রো-এক্টিভ ছিলোনা, তাই বলে এমন লেজে-গোবরে অবস্থা দেখিনি। প্রশাসনের শীর্ষ থেকে মাঠ পর্যায়, সর্বত্র অব্যবস্থাপনা প্রকট হয়ে উঠেছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে এক দিনে দুটো প্রজ্ঞাপন দিয়ে আবার তা বাতিল করা হলো। তারপরেও তাদের গুয়ার্তুমি চলছে। মন্ত্রীদের অস্বীকার আর লাগামহীন কথাবার্তা তো আছেই। তবে সবচেয়ে বাজে ব্যাপার হলো তথ্য গোপন করা। জনগণকে মিথ্যা আশ্বাস দেওয়া যে সব কিছু ঠিক আছে।
একটি প্রতিষ্ঠান থেকে দিনে গুটিকতক টেস্ট করে বলা হচ্ছে একজন বা দুজন মাত্র আক্রান্ত। সেটি দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা হচ্ছে যে সব কিছু নিয়ন্ত্রণে আছে। এর পরিণতি যে ভয়ংকর তা ইটালি আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। ইটালিতে করোনা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটার এক সপ্তাহ আগেও সে দেশের সরকার সমস্যাটিকে আমলে নেয়নি। মন্ত্রীরা পাবে গিয়ে সবার সাথে করমর্দন করে বোঝাতে চেয়েছেন, ভয়ের কিছু নাই। আর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প করোনাকে চাইনিজ ভাইরাস বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। আজ দুটি দেশই চরম মূল্য দিচ্ছে। প্রযুক্তি ও অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা থাকার পরেও সেখানে আক্রান্ত আর মৃত্যুর সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। বাংলাদেশের জন্যও কি একই পরিণতি অপেক্ষা করছে?
বিদেশের মাটিতে আমরা নিজেরাই যথেষ্ট ঝুঁকির মধ্যে আছি। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেশী দেশ হওয়ায় ক্যানাডার করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে পারে যে কোন সময়। তবে সেসব ছাপিয়ে আমার মায়ের জন্য মন কাঁদে, দেশে থাকা আত্মীয়, অনাত্মীয়, বন্ধু, প্রতিবেশী, লাখো-কোটি অচেনা মানুষের জন্য প্রাণ কাঁদে। আবার অন্তরের গভীরে কে যেন ফিসফিস করে বলে, সব ঠিক হয়ে যাবে। মায়ের আশংকা, বিশেষজ্ঞদের হিসেব সব ভুল প্রমাণিত হবে। বাংলাদেশের মানুষ বেঁচে যাবে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে চলমান মৃত্যুর মিছিল বন্ধ হবে। করোনার দিন সহসাই শেষ হবে।