শাহাদাৎ হোসেন মুন্না
করোনায় বিশ্বজুড়ে মানুষের মধ্যে এক অজানা শঙ্কা ভর করেছে। কবে নাগাদ এ মহামারি বিদায় নেবে তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই। এখন পর্যন্ত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও দিতে পারছে না সঠিকে কোনো তথ্য। বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন সময় নানা সমীকরণ দিচ্ছেন। তাতে আরো বিভ্রান্ত হচ্ছে মানুষ। দেখে শুনে যা মনে হচ্ছে- সহজে যাবে না এ অদৃশ্য শত্রু।
করোনার থাবায় আমাদের দেশে সব চেয়ে বেশি বিপাকে আছেন নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষরা। এরই মধ্যে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন অনেকে। কারও কারও সঞ্চয় ফুরিয়ে যাচ্ছে। এতে অর্থনৈতিক প্রবাহ ব্যাহত হচ্ছে। তার ঢেউ আছড়ে পড়ছে সমাজের নানা স্তরে। এর প্রভাবে এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে মানুষের মনে।
শুরুতে নিম্ন আয়ের মানুষগুলো টুকটাক সহায়তা পেয়েছেন। সরকারও সহায়তা দিয়েছে। মধ্যবিত্তদেরও লিস্ট তৈরি করে সরকারি সহায়তা দেওয়া হয়েছে। তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ঠ নয়। অনেক স্থানে এসব খাদ্য সামগ্রী নিয়ে দুর্নীতিও হয়েছে। পেট তো প্রবাহমান নদীর মতো চলমান। এটা থামে না।
মধ্যবিত্ত শ্রেণির কাছে হাত পেতে নেয়ার চেয়ে নিজের উপর্জনে স্বাবলম্বী হয়ে চলার গ্রহণযোগ্যতা বেশি। এই শ্রেণির মানুষ সর্বদা অন্য সব কিছুর চেয়ে আত্মসম্মানকে প্রাধান্য দিয়ে আসছে। তাই করোনার কঠিন এই মুহূর্তে তারা না পারছেন হাত পাততে, না পারছেন ঠিক মতো সম্মান নিয়ে চলতে। এদের অবস্থা দেখে সত্যজিৎ রায়ের ‘অশনি সংকেত’ সিনেমার চরিত্র গঙ্গাচরণের কথা মনে পড়ে যায়।
১৯৪৩-৪৪ সালের দুর্ভিক্ষপীড়িত বৃহত্তর বাংলার প্রেক্ষিতে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা উপন্যাস অবলম্বনে সিনেমাটি নির্মিত হয়। আজ করোনার এই তীব্র সংক্রমণকালে এদেশের মধ্যবিত্ত সমাজের সেই দশা হয়েছে। এরা না পারছেন কূল লজ্জা ত্যাগ করতে, না পারছেন হাত পাততে। এ অভ্যাস এই শ্রেণির আদি স্বত্ত্বা। একে ত্যাগ করা এতো সহজ নয়।
করোনা দুর্যোগে অনেকে চাকরি হারিয়ে ইতোমধ্যে ঢাকা ছেড়ে গ্রামে চলে গেছেন। এ নিয়ে কোনো জরিপ হয়নি। তবে তাদের সংখ্যা নেহাত কম নয়। যাদের উপার্জন একেবারেই সীমিত, তারাও ঢাকা ছাড়ার পরিকল্পনা করছেন। অনেকেই অর্থ সংকটে ভাড়া বাসা ছেড়ে দিচ্ছেন। এতে যারা বাড়ি ভাড়া দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন- তারাও বিপাকে পড়ছেন।
নিম্নবিত্তদের বেশিরভাগ চাকরি করেন গার্মেন্টস সেক্টরে। সেখানে ছাঁটাই, বেতন অনিয়মিত, বেতন কাটা, বোনাস না দেওয়া প্রভৃতি অস্থিরতা লেগেই আছে। মুখে বললেও অনেক কারখানায় স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নেই। এতে জীবিকার পাশাপাশি জীবনেরও ঝুঁকিতে পড়ছেন তারা। এখানেও কোনো মনিটরিং নেই। তাই আপাতদৃষ্টিতে সমাধানও নেই।
পোশাক শ্রমিকদের মূল সংখ্যা কতো সে সম্পর্কে মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ এখন পর্যন্ত সরকারকে সঠিক তথ্যই দিতে পারেনি। ২০১৪ সালের ২৩ জুন প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক সংবাদে প্রকাশ হয়, “শ্রম মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সংস্থা কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর বলেছে, পোশাকশিল্পে ২১ লাখ ৩০ হাজার ১৫৪ শ্রমিক কাজ করেন। এর মধ্যে নারী ১২ লাখ ২০ হাজার ৪৭৯ এবং পুরুষ ৯ লাখ ১৬ হাজার ১৮২ জন। রানা প্লাজা ধসের পর এক বছর ধরে সারা দেশের পোশাক কারখানাগুলো পরিদর্শন করে সংস্থাটি এ তথ্য পেয়েছে।
‘অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার ১ হাজার ৫৫৫টি কারখানায় ৮ লাখ ৪৭ হাজার ২৮৩, গাজীপুরের ৮৯৪টি কারখানায় ৮ লাখ ৬ হাজার ৫৮৫, নারায়ণগঞ্জের ৫২৬টি কারখানায় ২ লাখ ১৫ হাজার ৭৩৪, চট্টগ্রামের ৪৭১টি কারখানায় ২ লাখ ৩১ হাজার ৫১১, ময়মনসিংহের ৩৪টি কারখানায় ১৬ হাজার ৭৭০, টাঙ্গাইলের ৬ কারখানায় ৩ হাজার ৬১৪, কুমিল্লার ৩ কারখানায় ৯৬০, মানিকগঞ্জের ৩ কারখানায় ৬ হাজার ৭৮৭ এবং নরসিংদীর ৩ কারখানায় ৯১০ জন শ্রমিক কাজ করেন। (প্রথম আলো-২৩ জুন ২০১৪)।”
এই বিশাল শ্রেণির একটি অংশও যদি চাকরি হারায় তা নিতান্ত কম হবে না। চাকরি হারিয়ে অভাব-অনটনে পড়লে অনেকেই হয়তো জীবিকার তাগিদে অসৎ পথ বেছে নেবে। সে দায় কার হবে? শুধু এই সেক্টরের কর্মীরাই নয়, অনেক বেসরকারি চাকরিজীবিও চাকরিচ্যুতির তালিকাভুক্ত হচ্ছেন।
গত ১৫ জুন ২০২০-এ একটি সংবাদে বলা হয়েছে, বেসরকারি ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) আগামী ছয় মাসের জন্য বেতন-ভাতা ১৫ শতাংশ কমানোসহ কর্মীদের পদোন্নতি, ইনক্রিমেন্ট, ইনসেন্টিভ, বোনাস বন্ধ করার চিন্তা করছে। সংগঠনটির সেক্রেটারি জেনারেল স্বাক্ষরিত চিঠিতে ব্যাংকগুলোতে চলমান নিয়োগসহ সব নিয়োগ বন্ধ রাখার সুপারিশ করা হয়েছে।
এ হিসাবের বাইরেও অনেকে কর্মহীন হয়ে পড়বে। তাদের কী হবে? পরিবার নিয়ে কীভাবে বাঁচবে তারা? বিকল্প কর্মসংস্থান না হলে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
রাজধানীসহ দেশের সকল বড় শহরগুলোতে ইদানিং বাড়ি বাড়ি টু-লেট লেখা সাইনবোর্ড বেশি বেশি চোখে পড়ছে। এর পিছনে রয়েছে বেতন বৃদ্ধি না হওয়া, চাকরি হারানো এবং দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধিসহ নানা কারণ। মানুষজন গ্রামে চলে যাচ্ছেন। এভাবে গ্রামে ফিরতে থাকলে সেসব অঞ্চলেও কাজের আকাল পড়তে বাধ্য। কারণ, একজন গার্মেন্টস কর্মী বা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী গ্রামে ফিরে কী করবেন। কৃষি কাজও তো তাদের জানা নেই।
এই দুর্যোগ মোকাবিলায় সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণের সময় এসেছে। নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের নিয়ে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা না নিলে দেশ শ্রেণি সংকটের মুখে পড়বে। তাই সমাজবিদ ও সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্তদের এ নিয়ে ব্যাপকভাবে ভাবতে হবে। পরিকল্পনা গ্রহণের পাশাপাশি সেগুলো বাস্তবায়নও করতে হবে। একটি দেশের জনগণই সে দেশের অস্তিত্ব। জনগণ না থাকলে রাষ্ট্র বাঁচে কী করে?
লেখক : (ভাইস চেয়ারম্যান) সৃষ্টি হিউম্যান রাইটস সোসাইটি ও (মহাসচিব) বাংলাদেশ ক্যাবল টিভি দর্শক ফোরাম কেন্দ্রীয় কমিটি।