অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সাইয়িদ থেকে কবি হাসান আবু শাহরিয়ার, সুপারকপ, হালের পুলিশ থ্রিলার ডিরেক্টর সানী সানোয়ার থেকে আদিবাসীদের ত্রাণকর্তা উকিল ইমতিয়াজ মাহমুদ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন থেকে পান দোকানী মজনু, যুগে যুগে সকলের সফট টার্গেট যেন প্রবাসীরা।
সস্তা মশকরা করা দরকার, প্রবাসীদের নিয়ে দুই কথা বলে দাও। কোন এক প্রবাসীর সাথে ব্যক্তিগত ঝামেলা দাও, সবাইকে গালি দাও। দাও জুতা পালিশওয়ালার তকমা লাগিয়ে। কথা শুনছে না, তুচ্ছ কর, উপাধি দাও নবাবজাদা। এই করোনা বিপর্যয়ে প্রবাসী হেনস্থা এক নতুন মাত্রা পেয়েছে। ফেইসবুক খুললে মনে হয়, দেশে ফেরত যাওয়া প্রবাসীরা যেন একেকটা জম্বি। দেশে গিয়েছে কেবল দেশে বসবাসকারীদের ধংস করতে।
ক্যানাডা প্রবাসী সাংবাদিক সওগাত আলী সাগরের ফেইসবুক স্ট্যাটাস থেকে জানতে পারলাম, কেরানীগঞ্জে প্রবাসীদের বাড়িতে লাল পতাকা টানিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সাগর আশংকা করেছেন, এই সুযোগে প্রবাসীদের জানমালের উপর হামলার মতো ঘটনা ঘটতে পারে। এমনিতেই, অনেকে প্রবাসীর অর্থ, সম্পদ এমনকি স্ত্রী সন্তানকে গনিমতের মাল মনে করেন। এখন অথর্ব প্রশাসনের এই উদ্ভট কাণ্ডকারখানায় ঘোলা জলে মাছ শিকারের আশংকা উড়িয়ে দেওয়া যায়না।
কোন সন্দেহ নেই, বহু প্রবাসী দেশে ফিরে ভয়াবহ রকমের দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ করেছে। তাদের অজ্ঞানতার কারণে দেশের মানুষ ভয়ানক বিপদের মুখে পড়েছে। এজন্য তাদের বিরুদ্ধে আইনানুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া উচিৎ। তবে কেউ যদি মনে করে থাকেন, বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণের একমাত্র কারণ প্রবাসীরা তাহলে তিনি বা তারা হয় নির্বোধ অথবা সত্য সন্ধানে অক্ষম।
একটু খোঁজ নিলেই জানা যাবে, গত তিন মাসে মোট কতজন বাংলাদেশী বিভিন্ন দেশে প্রমোদ ভ্রমণে গিয়েছেন, কতজন ব্যবসায়ী বিজনেস ট্রিপে গিয়েছেন আর কতজন সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারী খাল-বিল-পুকুর-লিফট ইত্যাদি দেখতে বিদেশ সফর করেছেন। সফর শেষে কজন কোয়ারেন্টাইনে গিয়েছেন। আমার জানামতে একজনও নয়। তার জ্বলন্ত প্রমাণ সিলেটের সাবেক মেয়র কামরান। বিলেত সফর শেষে দেশে ফিরেই তিনি যোগ দিয়েছেন বংগবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে, প্রধানমন্ত্রীর ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাস ফেলে বাড়ি ফিরে গিয়েছেন। কেউ কি নিশ্চিত করে বলতে পারবেন এদের মধ্যে কেউ করোনা আক্রান্ত ছিলেন না।
ধরা যাক, এক লাখ প্রবাসী দেশে ফিরে সংগনিরোধ বা সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং নির্দেশনা মানছেননা। তাহলে নিশ্চিত থাকেন, কয়েক কোটি দেশি এই নির্দেশনা মানছেননা। তাদের ক্ষেত্রে প্রশাসন কি পদক্ষেপ নেয় তা দেখতে আমি মুখিয়ে আছি।
আবারও বলছি, প্রবাসীদের মাধ্যমে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ হওয়ার আশংকা সবচেয়ে বেশি। তাই তাদেরকে নজরদারিতে রাখা সবচেয়ে জরুরি। তবে তা যেন কোনভাবেই হয়রানিমূলক না হয়।এই মহাবিপদের দিনে সবাইকে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। আপনি ট্রাম্পের মত বিদ্বেষমূলক মন্তব্য করবেন, করোনা ভাইরাসকে বলবেন ‘চাইনিজ ভাইরাস’ আর আশা করবেন আপনার প্রধানমন্ত্রী প্রণোদনা ঘোষণা করবেন ট্রুডোর মত, তা হতে পারেনা।
সকল শ্রেণী ও পেশার প্রতি সম্পুর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, ব্যক্তির আচরণ নির্ভর করে তার শিক্ষা, পারিবারিক মূল্যবোধ, কর্ম-পরিবেশ এবং সামাজিক যোগাযোগ ইত্যাদির উপর। দেশ বা প্রবাসে অবস্থান তাতে খুব একটা পরিবর্তন আনতে পারেনা। দেশে ফেরত যাওয়া প্রবাসীদের আচার-আচরণও তাই দিন শেষে একই রকম।
বিদেশে আইনের যথাযথ প্রয়োগ থাকায় যে প্রবাসী বিদেশে সকল আইন মেনে চলেন, সেই একই প্রবাসী বিমানবন্দরে নেমেই আইন ভংগ করা শুরু করেন। করোনার ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। এজন্য শুধু প্রবাসীদের দোষ দিয়ে লাভ নেই।
ইতালি প্রবাসীরা দেশে ফিরে হাজীক্যাম্পের অব্যবস্থাপনা দেখে সেখানে কোয়ারান্টাইনে থাকতে চাননি, বিশৃংখলা করেছেন। এর মধ্যে একজন বেশি বাড়াবাড়ি করে,দেশের সিস্টেমকে নোংরা ভাষায় গালি দিয়েছেন। এটি কোনমতেই সমর্থনযোগ্য নয়। তবে তার জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী যে মন্তব্য করেছেন তা তার পদ,শিক্ষাগত যোগ্যতা বা সামাজিক মর্যাদার সাথে যায়না।
আমি ওই প্রবাসীর সম্পর্কে বিস্তারিত জেনেছি। তিনি লেখাপড়ার সুযোগ খুব একটা পাননি, এদেশেই কষ্ট করে বড় হয়েছেন, বিদেশে গিয়ে কষ্ট ক্লেশ করে পরিবারকে স্বচ্ছল করেছেন। তার শিক্ষা-সংস্কৃতি, পারিবারিক মূল্যবোধ ইত্যাদি তার আচরণে প্রকাশ পেয়েছে। দেশেও লক্ষ মানুষ এই একই রকম আচার ব্যবহারে অভ্যস্ত। ফেইসবুক, ইউটিউব আর পত্রিকার মন্তব্যের পাতা খুললে প্রতিদিন হাজারো মন্তব্য পাবেন যেখানে আমাদের দেশী ভাইয়েরা দেশকে, দেশের সিস্টেমকে, দেশের কর্তাব্যক্তিকে প্রতিনিয়ত ধর্ষণ করতে চাইছে। তাদের ব্যাপারে গুনীজনরা বা কর্তাব্যক্তিরা কী বলবেন?
মনে রাখবেন, প্রবাসীরা বাংলাদেশের সন্তান, তা তারা শিক্ষিত পেশাজীবিই হোক আর স্বল্পশিক্ষিত শ্রমিকই হোক, সহনশীল সদাচারীই হোন আর বদমেজাজী হোন। তাই মোটাদাগে মন্তব্য করা বন্ধ করতে হবে। ব্যক্তি সমস্যাকে দলগত রূপ দেওয়া, সরলীকরণ করা বন্ধ করতে হবে।
দেশে বন্ধুদের প্রতি বিনীত অনুরোধ, প্রবাসীদেরকে শত্রু মনে না করে সরকারকে, দাম্ভিক প্রশাসনকে প্রশ্ন করুন, করোনার প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে তাদের কি প্রস্তুতি, কেন বিমান ও স্থলবন্দরগুলোতে সময়মত যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, কেন পর্যাপ্ত পরিমাণে করোনা ভাইরাস টেস্ট কিট নেই, কেন এখনো ডাক্তার-নার্সদের জন্য প্রয়োজনীয় সেইফটি ইকুইপমেন্টের সংস্থান হয়নি।
এই ভয়াবহ দুর্যোগের দিনে সবাইকে আরও সহনশীল আচরণ করতে হবে। একে অপরের দিকে আঙুল না তুলে, দেশী-প্রবাসী বিভাজন ভুলে, বিপদ মোকাবিলায় সবাইকে কাজ করতে হবে। প্রায় কোটিখানেক প্রবাসী যারা বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে আছেন, তারা এই মহাসংকটে আপনাদের পাশে আছেন এবং থাকবেন। যেমন ছিলেন একাত্তরে, অন্যান্য আন্দোলন-সংগ্রামে, ঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাসের সময়।
সকলের মধ্যে শুভ বুদ্ধির উদয় হোক।সৃষ্টিকর্তা আমাদের সকলকে রক্ষা করুন।