শাহানা আকতার মহুয়া
মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে পৃথিবী যে এভাবে পালটে যাবে, কোভিড-১৯ নামের এক ভাইরাস ওলট-পালট করে দিতে পারে মানবজাতির উন্নয়নের ইতিহাস- এটা ছিল কল্পনারও অতীত। হঠাৎ করে এই বিনাশী ভাইরাসের আক্রমণে পুরো পৃথিবীর মানুষ দিশেহারা, বি্পর্যস্ত,পর্যুদস্ত। এ ভাইরাসের কোন প্রতিষেধক আবিস্কৃত হয়নি এখনো, উন্নত দেশগুলোও বুঝে উঠতে পারছে না কিভাবে এর সংক্রমণ ঠেকানো যাবে, থামানো যাবে মৃত্যুর মিছিল। কানাডার বৃটিশ কলাম্বিয়া প্রভিন্সেই প্রথম মৃত্যু ঘটে করোনাক্রান্ত রোগীর। কয়েকদিনের মধ্যেই এই প্রভিন্সে বিশেষ করে নর্থ ভ্যাঙ্কুভারের Lynne Vally-তে সিনিয়র হোমে থাবা বসায় ভয়াল করোনা। মৃত্যুর হার বাড়তে থাকে। ঠিক তখন আতংকিত মানুষের মধ্যে যেন আশ্বস্ততার প্রতিরূপ হয়ে আসেন ডঃ বনি হেনরি, বৃটিশ কলাম্বিয়া প্রভিন্সের চীফ মেডিক্যাল অফিসার।
করোনাভাইরাস নিয়ে প্রতিদিন আপডেটের মাধ্যমে তিনি যেন এই অস্থির সময়টাকে শান্ত করার চেষ্টা করেন। এইরকম ঝড়ো সময়ে তাঁর ভূমিকা প্রশংসা কুড়িয়েছে, অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে স্বাস্থ্যকর্মীসহ সকল নাগরিককে। প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর কথা শোনার পরে যেমন মনে হয় তিনি যেন সকলের পিঠে আস্থার হাত রেখে বলছেন- তুমি একলা নও, আমরাও আছি তোমার সাথে, তেমনি ডঃ বনি হেনরিও …
নিভৃতে কাজ করা ডঃ বনি করোনার এই মহামারিকালে কানাডার একজন প্রিয়মুখ এবং অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছেন!!
ডঃ বনিকে নিয়ে তৈরি হয়েছে
” Bonnie Henry Fan Club”। ভ্যাঙ্কুভারের Amy
Shier এবং Vicky Ferguson তাঁকে
শ্রদ্ধা জানিয়ে গেয়েছেন গান, জুনো পুরস্কারপ্রাপ্ত শিল্পী আমাদের পার্শ্ববর্তী শহর Coquitlam-এর Phil
Dwyer ডঃ বনিকে নিয়ে লিখেছেন ফোক সঙ্গীত।
সাউন্ডক্লাউডে আপলোড করার দুইদিনের মধ্যে ২০,০০০ মানুষ গানটি শুনেছে।
ক্যালগেরি ভিত্তিক ফ্যাশন ব্রান্ডস Sophie Grace and Madame Premier ডঃ বনি হেনরি সহ তিন কানাডিয়ান পাবলিক হেরোইনকে বিশেষভাবে শ্রদ্ধা জানাতে তৈরি করেছে টি-শার্ট।
হ্যাঁ, প্রতিদিন তিনি আসেন এবং আপডেট দেন করোনাভাইরাসের। কোন গোপনীয়তা না রেখে সত্যিকার অর্থেই এক ভয়াবহ সংবাদ সরবরাহ করছেন – কতজন মানুষ অসুস্থ, কয়জন লোক মারা গেছে, কত বেশি লোক মারা যাচ্ছে। তবে তিনি যেভাবে কথাগুলো বলেন এবং সহানুভূতির মাত্রাটি দেখান ঠিক মনে হয়- তিনিই এই মুহূর্তে আমাদের জন্য সঠিক ব্যক্তি, তাঁকেই আমাদের প্রয়োজন ছিল।
বিসি-র রাজধানী ভিক্টোরিয়ায় বসবাসরত পেশাদার চিত্রশিল্পী এবং শিক্ষক শ্যারন মন্টগোমেরি – যার আঁকা ছবি টেক্সটাইল থেকে সিরামিক, কাগজের ন্যাপকিনস, গ্রিটিংস কার্ড, বইয়ের কভারে শোভা পায় উত্তর আমেরিকার সংগ্রহশালাগুলোতে প্রদর্শিত হয়- তিনি ডঃ বনি হেনরিকে শ্রদ্ধা জানাতে এঁকেছেন ছবি। হেনরির শান্ত এবং আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের সাথে সাথে ছবিটিতে মন্টগোমেরি “শান্ত হোন, সদয় হন, নিরাপদে থাকুন” উক্তিটি চিত্রিত করেছেন।
একজন মানুষ কতটা জনপ্রিয় হলে দেশের নাম করা জুতা কোম্পানী সেই মানুষটির স্মারকে জুতা বানাতে পারে? বি.সি.-এর জন ফ্লুয়েভের ডাঃ বনি হেনরি জুতা এনেছে বাজারে।জন ফ্লুয়েভ লক্ষ্য করেছিলেন যে ডঃ হেনরি তার নকশায় বানানো জুতা ব্যবহার করেন। বিষয়টা জন ফ্লুয়েভকে আনন্দ দিয়েছে, তাইতো ডঃ হেনরির প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর বিষয়টি হাতছাড়া করতে চাননি। বাজারে আসছে সীমিত সংস্করণের জুতো। এটা থেকে যে আয় হবে তার সবটুকুই কোম্পানীর পক্ষ থেকে বিসি ফুড ব্যাংকে দান করা হবে।
জন ফ্লুভোগ বলেন, আমরা সৌভাগ্যবান যে এইরকম কঠিন একটা সময়ে কেউ শান্ত এবং প্রাজ্ঞভাবে পরিচালনা করছেন, একইসাথে আবার ইতিবাচকভাবে বাস্তব অবস্থাটা অবহিত করে এই পরিস্থিতি মোকবিলার জন্য প্রতিনিয়ত আমাদের বোঝাচ্ছেন। চরম অনিশ্চয়তার এই সময়ে তিনি সঙ্গতভাবেই চিন্তাশীলতা এবং আন্তরিক বিশ্লেষণের জন্য প্রশংসা অর্জন করেছেন।
এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রী অ্যাড্রিয়ান ডিক্স সহ তিনি কোভিড -১৯ এর জন্য প্রতিদিন ব্রিফিং দিয়েছেন যা অন্যান্য প্রভিন্সগুলোকেও অনুপ্রাণিত করেছে। বিসি’র স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডাঃ অ্যাড্রিয়ান ডিক্স বলেছেন, স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জনস্বাস্থ্যের সমস্যাগুলি নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা হেনরির রয়েছে। “জাইকা ভাইরাস, বায়ু দূষণ, কিংবা ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো অসুখ যা আমাদের জনজীবনে বিস্তর প্রভাব ফেলে, সেসব নিয়ে সচেতনতা বাড়ানো, জনসাধারণকে সোজাসুজি তথ্য সরবরাহ এবং বিষয়গুলি নিয়ন্ত্রণে তার ধারাবাহিক পন্থা রয়েছে। আমাদের প্রভিন্সে জনস্বাস্থ্য পরিচালনা করা এবং উন্নত করার জন্য আছে দক্ষ এবং অভিজ্ঞ পরামর্শদাতা।”
প্রসঙ্গত, ডঃ বনি হেনরি ২০১৮ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে বিসি প্রভিন্সিয়াল হেলথ অফিসার হিসাবে নিযুক্ত হন। ২০১৪ সালের আগস্ট থেকে ডেপুটি প্রভিন্সিয়াল হেলথ অফিসার হিসাবে এবং এর আগে ডিসেম্বর ২০১৩ সালের আগস্ট থেকে ২০১৪ পর্যন্ত ‘বিসি সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোলের অন্তর্বর্তী প্রাদেশিক নির্বাহী মেডিকেল ডিরেক্টর হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
ডঃ হেনরি পাকিস্তানে ডব্লুএইচও / ইউনিসেফের পোলিও নির্মূল কর্মসূচী এবং উগান্ডায় ইবোলা প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণ করতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাথে আন্তর্জাতিকভাবে কাজ করেছেন।
নোভা স্কোশিয়ার ডালহৌসি বিশ্ববিদ্যালয়ে মেডিকেল ডিগ্রি শেষ করে বনি হেনরি কানাডার নৌবাহিনীর সাথে মেডিকেল অফিসার হিসাবে সমুদ্রের বুকে উল্লেখযোগ্য সময় কাটিয়েছিলেন, ভ্যাঙ্কুভার আইল্যান্ডে কাজ করেছেন কানাডিয়ান ফোর্সের সাথে।
বনি হেনরির সহকর্মী ডাঃ পেরি কেন্ডাল তাইতো বলেছেন, ফ্লাইট সার্জন হিসাবে ডাইভিংয়ের যোগ্যতা অর্জন করা বনি হেনরি একসময় ছিলেন কানাডার নৌবহরের যুদ্ধজাহাজে একমাত্র চিকিৎসক। ডাঃ হেনরির পূর্বের অভিজ্ঞতা তাকে “সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় সঠিক ব্যক্তি” করে তুলেছে।
যদিও ডাঃ বনি হেনরি বলছেন, “আমরা এখনও এমন পর্যায়ে আসিনি যাতে প্রহরা তুলে নিতে পারি, কঠোরতা শিথিল করতে পারি। ঝড় এখনও চলছে এবং দুঃখজনকভাবে দেখছি যে এখনও বিসি-তে মানুষ এই ভাইরাসে মারা যাচ্ছে।”
আজ হোক বা কাল- করোনার প্রতিষেধক আবিস্কৃত হবে। সুস্থ হয়ে উঠবে রুগ্ন, ক্লান্ত পৃথিবী। মানুষ ফিরে যাবে দৈন ন্দিন জীবনে। তবে যত বারই ২০২০ সালের করোনা মহামারীতে কানাডার ভূমিকার কথা উচ্চারিত হবে, অনেকের স্মৃতিতে কিংবা বইয়ের পাতায় কথা বলে উঠবেন সমবেদনামাখা, দৃঢ় কিন্তু প্রশান্ত ডাঃ বনি হেনরি – “be calm, be kind, be safe”।
আমরা হুজুগে বাঙালিরা তো পশ্চিমা দেশের অনেককিছুই অন্ধভাবে অনুকরণ করি, অনুসরণ করি। কিন্তু তাদের সততা, মানবিকতা, নিষ্ঠা, শ্রদ্ধাশীলতা কখনো কি অনুসরণ করেছি? মানবজাতির এইরকম একটা সময়েও কি করেছি?