শরীফ হাসান
করোনা মোকাবেলার যে যুদ্ধ আজ দেশে দেশে চলছে তার মূল সেনানী হচ্ছেন চিকিৎসক, নার্সসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীরা। বিশ্বের প্রায় সব দেশেই চিকিৎসক সমাজকে জাতীয় বীরের মর্যাদা দেওয়া হচ্ছে। মানতেই হবে, আমাদের দেশ চিকিৎসকদের এই অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়ায় স্পষ্টতঃ পিছিয়ে, তা সে সরকারি বা ব্যক্তিগত পর্যায়েই হোক। অন্য সব কিছুর মত এ ক্ষেত্রেও চিকিৎসকরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দিকে তীর্থের কাকের মত চেয়ে ছিলেন।
অবশেষে তিনি চিকিৎসকদের ব্যাপারে কথা বলেছেন। এবং এই বক্তব্যের দুটো অংশ রয়েছে। প্রথম অংশে প্রধানমন্ত্রী কোভিড-১৯ মহামারী মোকাবিলায় কাজ করা নিবেদিতপ্রাণ চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের “পুরস্কৃত” করার ঘোষণা দিয়েছেন। এ মহাদুর্যোগে সাধারণ মানুষের সেবায় মাঠে থেকে দায়িত্ব পালন করে চলা সকল স্বাস্থ্যকর্মী, মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তা, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য এবং প্রত্যক্ষভাবে নিয়োজিত প্রজাতন্ত্রের সকল কর্মচারীর জন্য “বীমা” ব্যবস্থা করার কথা বলেছেন তিনি। আর দ্বিতীয় অংশে বিভিন্ন হাসপাতালে সাধারণ রোগীরা চিকিৎসা পাচ্ছে না, এমন খবর পাওয়ার কথা তুলে তিনি বলেছেন, যেসব চিকিৎসক সেবা দিচ্ছেন না, ভবিষ্যতে তারা চাকরি করতে পাবেন কিনা, তা ভাবা হবে। এমনকি বিদেশ থেকে চিকিৎসক, নার্স নিয়ে আসার কথাও বলেন তিনি। স্বাভাবিকভাবেই পুরস্কারের ঘোষণা ছাপিয়ে তিরস্কারের বিষয়টি সামনে চলে এসেছে।
চিকিৎসকরা প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে আহত বোধ করেছেন। এই দুঃসময়ে বিভিন্ন পেশার মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন। স্বাভাবিকভাবেই তাদের মধ্যে কেউ কেউ ভয় পাবেন। চিকিৎসকরা এর ব্যতিক্রম নন। বিশ, পঞ্চাশ বা একশ জন চিকিৎসক হয়ত ভীত হয়ে তাদের কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করছেন না। কিন্তু দেশে চিকিৎসক একলাখের বেশি। হাতে গোণা কজন চিকিৎসকের দায়িত্বে অবহেলার জন্য একলাখ চিকিৎসকের শ্রম ও ত্যাগকে আমরা অস্বীকার করছি। এটা তাদের প্রতি চরম অন্যায় এবং বর্তমান পরিস্থিতিতে আত্মঘাতী মনোভাবও বটে। মনে রাখতে হবে, এই মহামারীতে সবচেয়ে ঝুঁকিতে আছেন চিকিৎসকরা। আমার জানামতে, বাংলাদেশে কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১৬৪। তার মধ্যে চিকিৎসক আক্রান্ত ১০ জন। অন্যদিকে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে আক্রান্তের সংখ্যা ৫০০০ এর উপরে। তার মধ্যে আক্রান্ত চিকিৎসকের সংখ্যা ২০ জনও নয়। চিকিৎসক, নার্স, প্যারামেডিক মিলিয়ে ৫০ জন। এ থেকেই বোঝা যায়, আমাদের চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীরা কতটা ঝুঁকির মধ্যে কাজ করছেন। অথচ আমরা এই চিকিৎসকদেরকে বলির পাঁঠা বানাচ্ছি, সোশ্যাল মিডিয়ায় গালাগাল করছি।
আমরা এত দ্রুত ভুলে গিয়েছি ডেংগুর সময় চিকিৎসকরা কিভাবে সকল সীমাবদ্ধতার মধ্যেও বুক চিতিয়ে লড়েছেন, হাজার হাজার মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছেন! তাই চিকিৎসক বন্ধুদের প্রতি আমাদের আস্থা রাখতে হবে, তাদেরকে মানসিক শক্তি যোগাতে হবে। সচেতন নাগরিক মাত্রই জানেন, করোনা যুদ্ধে আমাদের ব্যর্থতার সবচেয়ে বড় কারণ হল সমন্বয়হীনতা। পর্যাপ্ত সময় পাবার পরও করোনা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্য একটা সহজ প্রটোকল বা নীতিমালা তৈরি করা যায়নি। সাধারণ মানুষ জ্বর-শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরে চিকিৎসা পায়নি। সাধারণ হাসপাতালে গেলে বলা হয়েছে করোনার জন্য নির্ধারিত হাসপাতালে যেতে। সেখান থেকে বিভিন্ন অজুহাতে রোগীকে ফেরত পাঠানো হয়েছে। এই ছোটাছুটিতে প্রাণ হারিয়েছেন বেশ কজন সাধারণ মানুষ। দিন শেষে, সব কিছুর জন্য দায়ী করা হচ্ছে চিকিৎসকদেরকে। অতীতে কতিপয় চিকিৎসকের মফঃস্বলে কাজ করায় অনীহা, প্রশাসন যন্ত্রের একটা মহল আর মিডিয়ার অংশ বিশেষের নেতিবাচক প্রচারণার কারণে দীর্ঘদিন ধরেই শীর্ষ পর্যায়ে ভাবমূর্তির সংকটে ছিল চিকিৎসক সমাজ।
চিকিৎসকদের জন্য রূঢ় বাস্তবতা হলো, এই অস্থির সময়ে তা আরও প্রকট হয়েছে। যাহোক, এসব নিয়ে বিলাপ বা তর্ক-বিতর্কের সময় এটি নয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশের অভিভাবক। এই মহাদুর্যোগে তাঁর নেতৃত্বেই সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। তাঁর বক্তব্যে আহত হলেও অভিমান করার সুযোগ নেই। ব্যক্তিগতভাবে একাধিক চিকিৎসক বন্ধুকে বলেছি, জাতির ক্রান্তিলগ্নে ব্যক্তি, গোষ্ঠী এবং জাতীয় চরিত্রের প্রকাশ ঘটে। এই মহাবিপর্যয় চিকিৎসকদের জন্য এক সুবর্ণ সুযোগও বটে। আমি নিশ্চিত, চিকিৎসকেরা তাদের করণীয় সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল। তাঁরা জাতির মেধাবীদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অংশ। তাঁদের কঠোর পরিশ্রম আর আত্মত্যাগে জাতি নিশ্চয়ই এই দুর্যোগ কাটিয়ে উঠবে।