হোসনে আর জেমী
আমি দিন দিন স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছি এই একটা ভাইরাস কিভাবে আমাদের দুর্বল করে দেয় সব দিক দিয়ে। আজ আমার খুব আমার আব্বার কথা মনে পড়ছে। আব্বা বলেছিলেন “তোমরা বোনেরা সব ২০/২০। মাঝামাঝে কাউকে ১৯ হতে হয়। তখন দেখবে শান্তি আর শান্তি”। তাইতো আমি সবাইকে যেমন সমান ভালোবাসতে পারবো না তেমনি সবাই আমাকে সমান ভালোবাসবে না। ভালোবাসায় ১৯ আর ২০ থাকবেই। এই বছর ২০২০। মনে রাখার মতই তাই বলে এইভাবে।
প্রতিবছর আমি ২১শে ফেব্রুয়ারি আয়োজিত বইমেলায় যাই প্রায় তিন বছর ধরে। এটাই আমার বিনোদন বা আনন্দ বলা যেতে পারে। সেইসাথে যত বন্ধু আছে তাদের সাথে এক আয়োজনে দেখা করার এক সুবর্ণ সুযোগ।
আমি যখন কানাডা থেকে যাই তখন করোনার দেখা মিলেছে তবে সেই ভাবে কেউ গুরুত্ব দেয়নি আমিও দেই নাই।
একটা ভাইরাস গোটা বিশ্বকে এভাবে নাড়িয়ে দিয়ে যাবে ভাবাই যায় না। বইমেলা ভালোভাবেই উপভোগ করলাম সে কথা আর একদিন লিখবো।
আমার ফ্লাইট ৬ মার্চ, ২০২০ ঠিক আগের দিন মেয়ে আমাকে ফোন করে বলে, মা এখানে খুব খারাপ অবস্থা, তুমি খুব সাবধানে আসবে। কোন ভাবেই ঠান্ডা লাগাবেনা, গ্লোবস পড়বে, ডিজিনফেক্টেড টিসু রাখবে ব্যাগে এবং বিমানে,এয়ারপোর্ট এসব জায়গায় বাথরুম আগে পরিস্কার করে নেবে। সব সময় মাস্ক ব্যবহার করবে।
এবং সেই সাথে কিভাবে ভাইরাস ছড়ায় তার একটা মিনি লেকচার দিয়ে দিল।
তখনো বাংলাদেশে করোনা নিয়ে তেমন ভয়াভয়তার খবর প্রকাশ হয় নাই। আমি যখন ফার্মেসিতে গেলাম, পেলাম না কোন হ্যাান্ড গ্লোবস, ডিজনফেক্টট টিসু। শুধু একটা হ্যান্ড স্যানিটাইজার পেলাম। কয়েক ফার্মেসী খুঁজে যখন পেলাম না তখনি বুঝতে পারলাম এর ভয়াভয়তা।
আমার বয়স্কা মা, বোন, আত্মীয়, স্বজন, বন্ধু, বান্ধব আর কত কি যে ফেলে রেখে যাচ্ছি। এটা মনে হওয়ার চেয়ে মনে হয়েছে আমার সন্তানের কথা। ফেলে এসেছি আমার মেয়েকে তার পাশে আমার থাকতে হবে। ওদিকে আমার মা বলতে গেলে একাই থাকেন, তবে তার তিন মেয়ে তার আসেপাশেই থাকে।
আমি কানাডা আসার পরে টেলিফোনে আমার মাকে সব বললাম, ছোট বোনদের বললাম আম্মা যেন সাবধানে থাকেন। এই দূর প্রবাসে বসে প্রিয়জনের জন্য চিন্তা করি আর বাংলাদেশের টিভি চ্যানেল গুলোতে খুঁজে ফিরে দেশের অবস্থা। সারাদিন চ্যানেল থেকে চ্যানেলে ঘুরি আর দুচিন্তা বাড়াই। তার মধ্যে ফেসবুকের ইনবক্স আমাকে পাগল করে দিয়েছে।
বাংলাদেশ ১৮ কোটি মানুষের দেশ। আর আমি যে দেশে থাকি সেখানে ৩.৮ কোটি মানুষের দেশ। দুই দেশের তুলনা করলে বাংলাদেশ এখনো ভালো অবস্থানে অবস্থান করছে।
বাংলাদেশের সরকারী হিসাব মতো করোনা আক্তান্ত রোগীর সংখ্যা ৪৯, ১৫ জন সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরেছেন আর পরপারে চলে গেছেন ৫ জন। এই তিনদিনে করোনা পজেটিভ ১ জন। এখানেই আশার আলো। তবে যতক্ষন পর্যন্ত এটা শুন্যের কোঠায় না আসে চিন্তা রয়েই যায়।
বিভিন্ন পত্রিকা পড়ে, বিশেষজ্ঞদের কথা যদি ঠিক থাকে তবে বংলাদেশ সেভাবে আক্রান্ত হবে না জলবায়ু ও আবহাওয়ার কারনে। তাই হয়তো এরকম ঘনবসতিপূর্ন দেশে এখনো মহামারী আকার ধারন করে নাই। তবে মানুষের মধ্যে আতংক মহামারী আকার ধারন করেছে। প্রথমে আমার মনের আতংক দূর করতে হবে সাহসের সাথে।
আমি সরকারের কোন সমালোচনা করবো না। কি হলে কি হতে পারতো এসব নিয়েও কথা বলবো না। আমাদের নিজেদের আগে সচেতন করি। গুজবে কান না দেই, নিজের বুদ্ধি ও সচেতনতা দিয়ে কাজ করি।
একদিন স্বপ্ন দেখেছিলাম নায়াগ্রা জলপ্রপাত ছুঁয়ে দেবো। সাদাকালো টিভিতে হানিফ সংকেত এর ইত্যাদি অনুষ্ঠান দেখে। সেই স্বপ্ন যে সত্যি হবে ভাবতেই পারিনি। তবে ইচ্ছা শক্তি, চেষ্টা আর মনোবল যদি থাকে তবে অবশ্যই চাওয়াটা পাওয়ায় পরিনত হবেই। তেমনি আজ আমরা যে সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি সেই সংকট কাটাতে আমদের প্রয়োজন ইচ্ছাশক্তি, চেষ্টা আর মনোবল।
পৃথিবীতে মানবিক বিপর্যয় এসেছে প্রতি ১০০ বছর পর পর যেমন ১৭২০ প্লেগে মারা যায় এক লক্ষ্য মানুষ, ১৮২০ কলেরায় মারা যায় এক লক্ষ এবং ১৯২০ স্পেনিস ফ্লুতে মারা যায় ১০০মিলিয়ন। যা কিনা ছিল নিদৃষ্ট এলাকা ভিত্তিক।
২০২০ সালে যে একটা মহামারি হবে সেটা কি আমরা আগে থেকে ভেবেছিলাম! না ভাবিনি!
আর এই মহা বিবর্যয় এর নাম কোভিড – ১৯ বা করোনা যা এসেছে সূদুর চীন থেকে। যা আজ সারা বিশ্ব ছড়িয়ে গেছে। চারিদিকে মৃতের স্তুপ, অপনজন আপনজনকে দেখতে যেতে পারছেন না এর চেয়ে বড় আর কি হতে পারে। কি অপার শক্তি এই ভাইরাসের যার মাছে মানুষ পরাজিত। ভালোবাসা থমকে গেছে এই করোনার কাছে।
কানাডার জনসংখ্যা ৩ কোটি ৮০ লক্ষ।
রাশিয়ার পরে কানাডা পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ।
গত ১৩ মার্চ থেকে কানাডাতে সেলফ কোয়ারেন্টাইন, লক-ডাউন, জন সচেতনতা মূলোক কাজ চলছে। আজ থাকে কানাডিয়ান আর্মিও সহযোগিতার হাত বাড়ানোর জন্য প্রস্তুত রয়েছে।
কানাডার প্রধানমন্ত্রী সম্পূর্ণ ঘরে থেকেই দেশ পরিচালনা করছেন এবং প্রতিদিন মিডিয়ার মাধ্যমে জনগনকে তার পরিকল্পনার কথা বলছেন। সেইসাথে উনি উনার মন্ত্রী পরিষদের সাথে যোগাযোগ রাখছেন অনলাইনে, অফলাইনে এবং লাইভে এসে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে নিরাপদ দুরত্ব বজায় রেখেই। এখানে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেন খুবই প্রাসঙ্গিক এর বাহিরে কোন প্রশ্ন করেন না।প্রতিদিন উনি আসেন ১১:১৫ মিনিটে। আর আমরা উনার কথা শোনর জন্য অধীর হয়ে বসে থাকি নতুন কি আসছে আমাদের জন্য।
উনার বক্তব্যে আসার বানী এই আমি তোমাদের পাশেই আমি। তোমরা শুধু সবকিছু নিয়ম মেনে চলো। এখানে উল্যেক্ষ যে এইদেশে এই ধরেনের বিপদে সরকার ও বিরোধী দল সমুহ এক হয়ে কাজ করে। জীবন চলার পথে এখান থেকেই শেখার আছে অবেক কিছু।
কানাডার প্রধানমন্ত্রীর পাশাপাশি সিটি মেয়র ও প্রাদেশিক প্রধান প্রতিদিন জগনের উদ্যেশ্য কথা বলছেন মিডিয়ার মাধ্যমে পরিস্থিতির সর্বশেষ পরিসংখ্যান জানাচ্ছেন। জনগন যেন এই বিপদে ধৈর্য না হারায়। আর আমরা জনগন আশায় বুক বেধে এগিয়ে যাচ্ছি।
কানাডায় মার্চ এর বন্ধ শুরু থেকে প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে সকল স্কুল, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ। গত এক সপ্তাহ হয় স্কুল কলেজ থেকে কারিকুলাম, হোমওয়ার্ক দিয়ে দেওয়া হয়েছে। যাতে করে ছাত্র ছাত্রীরা বাসায় বসে সময় মত কারিকুলাম শেষ করতে পারে। সেইসাথে অনলাইনে হোমওয়ার্ক দিচ্ছে
ছাত্রছাত্রীরা যেন তাদের লেখাপড়া নিয়ে সময় কাটায়। ছাত্রছাত্রীদের জীবন যেন একঘেয়েমি না হয়ে যায়।
আফিস আদালতে শারীরিক উপস্থিতি নেই বললেই চলে। অনেকে আফিস করছেন বাড়িতে বসেই।
সকল প্রকার যানবাহন নিয়ন্রিত টরোন্টো ট্রানজিট কমিশন দ্বারা। দলবেধে বাইরে যাওয়াকে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। আজ থেকে সকল পার্ক, খেলার মাঠ বন্ধ করে দিয়েছে। কেউ যদি তাদের বাচ্চা নিয়ে পার্কে যায় তাদের ফাইন ধার্য করা হয়েছে ডলার ৭৫০ থেকে ডলার ৫০০০। আমার মনে হয় এই সময়সীমা বাড়বে।
আর একটা জিনিস ভালো লাগছে আমাদের ছেলেমেয়েরা যারা এখানে বড় হচ্ছে তাদের দেখছি এসব নিয়ে পড়াশুনা করে তাদের বাবামাদের সচেতন করছে।
কানাডায় কম গুরুত্বপূর্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সমুহকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্থ কোম্পানিগুলোকে ৭৫% সাবসিডি দেওয়া হবে। শুধুমাত্র গুরুত্ব পূর্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, সেবামুলোক প্রতিষ্ঠান খোলা রাখা হয়েছে।
এখন পর্যন্ত করোনা ভাইরাসের জন্য কানাডায় ২ লক্ষ ২১ হাজার ৬ শত ২৮ জন মানুষকে টেস্ট করা হয়েছে।
তারমধ্যে মধ্যে ৭হাজার ৪শত ৪৮জন নিশ্চিতভাবে আক্রান্ত।
মারা গেছে ৮৯ জন।
টরেন্টোতে আক্রান্ত ৫১৯ আমি লেখা পর্যন্ত।
এ কেমন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করছি আমরা যেখানে আমাদের সম্মুখ যোদ্ধারাও হরে যাচ্ছে এই ভয়ানক অদেখা ছোবলে। তাই আসুন এই মানবিক বিপর্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে কাজে লাগাই আমাদের ধৈর্য, ইচ্ছাশক্তি আর চেষ্টাকে।
আসুন আমরা যার যা আছে তাই নিয়ে এগিয়ে যাই। আসুন আমরা নিয়ম মেনে চলি, সামাজিক দুরত্ব মেনে চলি, ঘরে থাকি, নিজে সুস্থ থাকি সেইসাথে অন্যকে সুস্থ থাকতে সহায়তা করি।
একটি নতুন ভোর দেখবো এই প্রত্যাশায়!!