-সুব্রত কুমার দাস
পাঁচ বছর স্থায়ী প্রথম বিশ্বযুদ্ধে এক কোটি সত্তর লক্ষ মানুষের মধ্যে নিহত কানাডীয় সৈনিকের সংখ্যা ছিল ষাট হাজার। যুদ্ধে বিপুল সংখ্যক মানুষ নিহত হবার ক্ষত দূর হতে-না-হতেই পৃথিবীজুড়ে শুরু হয়েছিল নতুন আরেক যুদ্ধ। সারা পৃথিবীকে গ্রাস করতে চাইল এক মরণব্যাধি। নতুন ধরনের সেই ইনফ্লুয়েঞ্জা প্রথম দেখা গিয়েছিল ১৯১৮ সালের ৪ মার্চÑ কানসাসের আমেরিকান সেনাসদস্যদের মধ্যে। ততদিনে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সৈন্যরা ফেরার জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন। হেমন্ত কাল বা আগস্ট মাস আসতেই ঝড়ের গতিতে ছড়াতে শুরু করলো সেই জ্বর। বয়স নির্বিচারে আক্রান্ত হলেও বেশি প্রকোপ যেন দেখা গেল ২০ থেকে ৪০ বছরের যুবাবয়সীদের মধ্যে। উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলোতে ব্যাপকভাবে আক্রমণ হলেও সারা পৃথিবীর কোনো দেশই বোধ করি মুক্তি পায়নি এই জ্বরের ছোবল থেকে। ‘স্প্যানিস ফ্লু’ নামের সেই মহামারীতে পরের দুই বছরে সারা পৃথিবীতে মানুষ মারা গেলেন চারকোটির বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যদিও বলছে সংখ্যাটি আসলে পাঁচ কোটি কারণ ভারতবর্ষে যে এক কোটি মারা গিয়েছিলেন সেটি রেকর্ডে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। কোনো কোনো গবেষকের মতে মৃতের সংখ্যাটি প্রকৃতপক্ষে ১০ কোটির মত হবে।
কানাডাতে প্রথম আক্রমণ হয় মন্ট্রিয়লে। ৮ সেপ্টেম্বর। এক সপ্তাহের মধ্যেই ছড়িয়ে পরে সারা দেশে। শুধু কানাডাতেই মারা যান পঞ্চান্ন হাজারের বেশি। সদ্যসমাপ্ত যুদ্ধে যেখানে প্রতিদিন গড়ে মারা গিয়েছিলেন এক শ কানাডীয়, সেখানে ১৯১৮ সালে অক্টোবর মাসে কানাডায় ওই জ্বরে আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিন মারা গেছেন এক হাজার জন। বলে রাখা যেতে পারে, আমেরিকাতে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৬ লক্ষ পঁচাত্তর হাজার। শুধু নিউইয়র্কেই সংখ্যাটি ছিল উনিশ হাজার। মন্ট্রিয়লে মৃতের সংখ্যা এত বিশাল ছিল যে ট্রলি কারে লাশ বোঝাই করে শহর থেকে সরাতে হয়েছে। বলে রাখা যেতে পারে যে, স্প্যানিস ফ্লু’র প্রথম ধাক্কাটা এসেছিল ১৯১৮ সালে ফল ঋতুতে। পরেরটি আসে ১৯১৯ এর স্প্রিঙে। কোনো কোনো জায়গায় তৃতীয়বারের ধাক্কাও এসেছিল Ñ আর সেটার সময় ছিল ১৯২০ সালে।
কানাডার ইতিহাসে ওই সংক্রমণ একটি বিশেষ অধ্যায়। ইতিহাসে অন্যান্য সকল গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়কে নিয়ে ২০০১ সালে টরন্টোর ডাবলডে প্রকাশনী থেকে অসাধারণ একটি বই প্রকাশিত হয়েছিল। ‘স্টোরি অব অ্যা নেশন: ডিফাইনিং মোমেন্টস ইন আওয়ার হিস্ট্রি’ শিরোনামের সেই গ্রন্থে কানাডার বরেণ্য সাহিত্যিক টিমোথি ফিন্ডলের একটি প্রবন্ধ আছে। কানাডার ইতিহাসের ভিন্ন ভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত নিয়ে মার্গারেট অ্যাটউড, আলবার্তো ম্যাঙ্গুয়েল, ডিয়োন ব্যান্ড, ডেভিড ম্যাকফারলেন বা টমাস কিঙের মতো প্রথিতযশা লেখকেরা লিখলেও টিমোথি লিখেছেন স্প্যানিস ফ্লু নিয়ে। জানিয়েছেন কীভাবে যুদ্ধে তার কাকা মারা গেলেন; আর কীভাবে ফ্লুতে তার মামা মারা যান। কীভাবে ওই মৃত্যুর স্মৃতি পুরো পরিবার প্রজন্মের পর প্রজন্ম বহন করে চলেছেন। এক পর্যায়ে টিমোথি লিখছেন:
ঞযব ধিৎ ধিং ড়াবৎ. ঘড় ড়হব ৎবলড়রপবফ.
ণবং, ঃযবু ধষষ বিহঃ রহঃড় ংঃৎববঃং. ঞযব নবষষং ৎধহম. ঊাবৎুড়হব ংধহম. ঞযবৎব বিৎব ভরৎবড়িৎশং. চবড়ঢ়ষব পষরসনবফ ঃড় ঃযবরৎ ৎড়ড়ভং ধহফ ংধঃ ঃযবৎব, ধিারহম ভষধমং. অ ষড়ঁফ, ষড়হম পযববৎ বিহঃ ঁঢ়. ইঁঃ হড় ড়হব ৎবলড়রপবফ. ঙহ ঃযব ঃযরৎফ ফধু ড়ভ ঢ়বধপব, ঃযবৎব ধিং ংরষবহপব.
অহড়ঃযবৎ ধিৎ যধফ নবমঁহ. অ ধিৎ ভড়ৎ ংঁৎারাধষ. (পৃ. ১৬৭)
উল্লাশ করতে না-পারা সেই দেশ কানাডার শহরে শহরে ঘোষণা দিয়ে স্কুল, কলেজ, থিয়েটার, চার্চ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল ওই সময়ে। সর্বত্র জনাসমাগম নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। চতুর্দিকে আতঙ্কময় সেই সময়ে এমনও দেখা গেছে একজন সকালে অফিসে গেছেন, কিন্তু বিকেলে বাড়িতে ফিরতে পারেন নাইÑ অফিসেই জ্বর এবং মৃত্যু। এমনকি মৃত মানুষদের শবযাত্রায় ঘনিষ্টজন ছাড়া অন্যদের না থাকার জন্যে পরামর্শও দেওয়া হয়েছিল।
ইতিহাস বলছে শুধু টরন্টোতেই মারা গিয়েছিলেন বারো শ জনের বেশি। ২০০৯ সালের ২ মে তারিখের ‘টরন্টো স্টার’ পত্রিকায় বলা হয়েছে, টরন্টোতে স্প্যানিশ ফ্লু’র প্রথম প্রাদুর্ভাব ঘটে ওই বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর। দিন দশেকের মধ্যে শহরের একটি হাসপাতালে রোগটির প্রথম বলি হয় এক স্কুল ছাত্রী। এক সপ্তাহের মধ্যে শহরের জেরার্ড স্ট্রিট ইস্টে অবস্থিত মিলিটারি-বেজ হাসপাতালে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়ায় পাঁচ শ।
শতবর্ষে বিভিন্নভাবে জাতিকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে ভয়ঙ্কর সেই রোগটির ভয়াবহতা। সারা বছর ধরে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে শত শত প্রবন্ধ-নিবন্ধ। ৩০ সেপ্টেম্বর তারিখে সিবিসি-তে প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলা হয়েছে নিউ ফাউন্ডল্যান্ড এবং ল্যাবরাডরের ইনুইট জাতিগোষ্ঠীর প্রায় এক-তৃতীয়াংশের মৃত্যু ঘটে সে-সময়। সে-সময়ে সেইন্ট জনসে মারা যান স্বেচ্ছাসেবি এথেল ডিকিনসন (১৮৮০Ñ১৯১৮)। তারিখটি ছিল ২৬ অক্টোবর। ১৯২০ সালে ৩৮ বছর বয়সী এথেলের মারা যাবার দিনে তাঁর স্মৃতিতে শহরে একটি স্মারক নির্মাণ করা হয়।
২০০৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বরে টরন্টো স্টারে প্রকাশিত আরেক প্রবন্ধে হেলেন ব্রান্সওয়েল লিখেছেন, যদি অমন একটি ফ্লু’র আক্রমণ এখনকার সময়ে হয় তবে পৃথিবীর মোটামুটি ১৮ থেকে ৩৭ কোটি মানুষের মৃত্যু হবে। আর তাই এবছর যখন বছরব্যাপী বিভিন্ন আয়োজনে শতবর্ষ পূর্বের ভয়াবহ ফ্লু’র কথা স্মরণ করা হয়েছে, তেমনি একই সাথে প্রশ্ন তোলা হয়েছে ভবিষ্যতে এমন একটি আশঙ্কা থেকে আমরা কি সত্যি সত্যি শতভাগ নিজেদেরকে মুক্ত করতে পেরেছি? ওই মহামারীর শতবর্ষে এসে ডিফাইনিং মোমেন্টস কানাডা নামের একটি সংগঠন একটি উদ্যোগ গ্রহণ করেছে যেখানে অনলাইনে স্পানিশ ফ্লু নিয়ে অনেক অনেক তথ্য, গবেষণা, ছবি ইত্যাদি দিয়ে সমৃদ্ধ করা হচ্ছে।
টরন্টোতে বিধ্বংসী এই রোগের অসামান্য একটি বিবরণ পাওয়া যায় ‘ইফ আই ডাই বিফোর আই ওয়েক’ উপন্যাসে। দিনলিপির ঢঙে লেখা সে-উপন্যাসটি আসলে ফিওনা ম্যাকগ্রেগর নামে বারো বছরের এক কিশোরির বয়ান। দিনলিপি শুরু হয়েছে ১৯১৮ সালের ৩ আগস্ট Ñ ফিওনার জন্মদিনে। শেষ হয়েছে ১৯১৯ সালের ২২ মার্চ। ফিওনা বা ফি কিন্তু টরন্টো শহরেরই বাসিন্দা। স্প্যানিশ ফ্লু’র সময়ে ফি’র পরিবারের মানুষেরা আক্রান্ত হয় ওই ভয়ানক জ্বরে। ১৯১৮Ñ১৯ সালের সেই ভয়ানক সময়কে বাস্তবোচিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে এই উপন্যাসে। বলে রাখা যেতে পারে, উপন্যাসের ফি কিন্তু সেই স্কুলেই পড়ে যে স্কুলের একজন ছাত্রী ওই জ্বরে টরন্টোতে প্রথম মারা গিয়েছিল।
নির্মম সে-জ্বরের সাথে টরন্টো শহরের সম্পর্কে চিহ্নিত করে রাখতে ডিয়ার কানাডা থেকে ২০০৭ সালে প্রকাশিত নন্দিত ও পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক জ্যাঁ লিটলের সে-উপন্যাসের একটি উল্লেখযোগ্য অংশকে ফলকে উৎকীর্ণ করে জনসমাগমের জায়গায় স্থাপন করা হলো ২০১৮ সালের ১০ ডিসেম্বর। উদ্দেশ্য হলো পথচারীরা যেন জানতে পারেন এই শহরে এক শতাব্দী আগে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ সেই ঘটনার কথাÑ পড়তে আগ্রহ বোধ করেন ইতিহাসের ভয়াবহ সেই সময় নিয়ে রচিত অসামান্য সেই গ্রন্থ।