দেলওয়ার এলাহী
১৯৯৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসের চার তারিখ আমি কানাডার মাটিতে পা রাখি। পিয়ারসন্স এয়ারপোর্টে থেকে বেরিয়ে যে নির্মল বাতাসের নিঃশ্বাস নিয়েছিলাম তা এখনো আমার মনে আছে। মনে হয়েছিল কানাডার শীতল ও নির্মল বাতাসের উদার আমন্ত্রণে আমার শরীর মন ধৌত হয়ে গিয়েছিল। টরন্টোয় বন্ধুদের সঙ্গে কয়েকদিন থাকার পর সুরমা আপার নির্দেশে আমি মন্ট্রিয়ালে চলে যাই। মন্ট্রিয়ালে এসে আমার বসবাসের স্থান হয় স্টেনলি স্ট্রিটের একটি বিখ্যাত অট্টালিকায়। এই অট্টালিকাটি বিখ্যাত কারণ অধিকাংশ বাংলাদেশি এখানেই বসবাস করতেন। মন্টরয়াল পাহাড়ের পাদদেশে বিশ্বখ্যাত ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পায়ে হাঁটা দূরত্বে আমাদের বাসা। আমি যুগপৎ বিস্মিত ও মন্ট্রিয়ালের সৌন্দর্যে মুগ্ধ। ফরাসি ভাষার প্রতি আমার অনির্ণেয় এক মুগ্ধতা। ফরাসি ও আইরিশ বংশানুক্রমিক মানুষের অপরূপ কমনীয় সৌন্দর্য দেখে দেখে আমি মুগ্ধ। তবু ভেতরে ভেতরে এক ধরনের একাকীত্বের বিষন্নতায় আমি আচ্ছন্ন। নিয়ম ও শৃঙ্খলার কঠোর শাসনের অধিক শান্তিতে আমি অনিয়মের বিশৃঙ্খলার একান্ত খোঁজে জর্জরিত। নিজেকে নিজের কাছ থেকে নিয়ে কোথাও যেন পালাতে চাই৷ ইহুদী মেনুহিনের বেহালা, এলা ফিটজেরাল্ডের গান শুনি। আমি কোথাও পালাতে চাই। পারি না। আমার সময় কাটে না। ছবি দেখতে অভ্যস্ত হয়ে উঠি। ভিডিওর যুগ তখন। বেনহার, ডক্টর জিভাগো, ক্লিওপেট্রা, পথের পাঁচালি, শাখা প্রশাখা, আগন্তুক দেখা ছবিগুলো আবার দেখি। চারুকলা ছবিটি দেখার জন্য মন উদগ্রীব হয়ে ওঠে। মন্ট্রিয়ালের পার্ক এলাকায় এক বাঙালি দোকানে ভিডিও ভাড়া পাওয়া যায়। এক বিকেলে সেই দোকানে গিয়ে মালিককে জিগ্যেস করলাম -‘ভাই, আপনাদের কাছে কি চারুলতা ছবিটি আছে?’ দোকান মালিক উত্তর দেওয়ার আগেই দোকানের তাকিয়ার আড়াল থেকে বের হয়ে হয়ে এক সুঠাম দেহী সুদর্শন সামনে এসে আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করলেন -‘মানিকদার ছবি আপনি দেখেন বুঝি!’ এই প্রশ্নের উত্তরের কথোপকথন দিয়েই কামাল মামার সঙ্গে আমার পরিচয়৷ পরে কামাল মামা টরন্টো এলেন। আমিও। যারা তাঁকে ভালো করে জানেন, তারা নিশ্চয়ই অবগত আছেন পরিচিত মানুষের সঙ্গে তাঁর ফোনালাপের দীর্ঘসূত্রিতা। আলাপের নানামাত্রার বিস্তার। আমিও তার ব্যতিক্রম নই। খৈয়াম, হাফিজের রুবাইয়ের মতো আমিও একসময় চতুষ্পদী লেখার সামান্য কিছু চর্চা করেছিলাম। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তার কিছু ছাপাও হয়েছে। অকিঞ্চিকর সেইসব লেখাও কামাল মামার নজর এড়ায়নি। সেই প্রকাশিত লেখাগুলো বিষয়ে তিনি আমাকে এতোই উৎসাহ দিতেন যে, তাঁর একান্ত ইচ্ছা ছিল আমার এইসব চতুষ্পদীর একটি সংকলন প্রকাশ হোক। দুই মলাটের মধ্যে তাদের সন্নিবেশ হোক। নিজের এলায়িত প্রাণের দগ্ধতার দাগে আঁকা কোন পংক্তি নিয়ে বিদগ্ধজনের প্রশংসা শুনলে নিজের ভালো লাগার চেয়ে লজ্জা লাগে বেশী। গোপনে অনেক বিব্রতবোধ করি আমি। কামালা মামা আমার লেখা পত্রিকায় প্রকাশিত কোন চতুষ্পদী পড়েই ফোন করতেন। কবিতায় আঁকা ছবিটি তাঁর মতো বিস্তৃত ব্যাখ্যা করতেন। কদাচিৎ সামান্য কয়েক লাইন লেখালেখি নিয়ে চুপিসারে লুকিয়ে থাকা সেই আমিও বিস্মিত হতাম। একান্ত ভালোলাগায় আমার নিজের লেখা কোন কোন পংক্তির অন্যের মুখে নিজস্ব ব্যাখ্যা মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। কখনো কখনো আবেগে আমার কান্না চলে আসতো। মামা তখন আমার আম্মার জন্য আশীর্বাদ করতেন। কামাল মামা চেয়েছিলেন আমার লেখা চতুষ্পদী ও চতুর্দশপদী কবিতা নিয়ে একটি গ্রন্থ প্রকাশ হোক। আমি নানা অজুহাতে তা এড়িয়ে যেতাম। কোনভাবেই আমার লেখা কবিতা গ্রন্থবদ্ধ হওয়ার মতো নয়, নানান কৌশলে বিনয়ের সঙ্গে এই মত প্রকাশ করতাম। তবু মামার অব্যাহত আন্তরিক প্রচেষ্টা এতোই প্রবলাকার হয় যে, তিনি দুটি প্রচ্ছদ এঁকে আমার বন্ধু আহমেদ হোসেনকে দিয়ে বলেন আমাকে দেওয়ার জন্য। মামার আঁকা সেই দুটি প্রচ্ছদের চিত্রকর্ম এখনো টরন্টোয় আমার বাসায় সযতনে আছে।
কামাল মামা অসাধারণ স্মৃতিশক্তি ও মেধা নিয়ে জন্মেছিলেন। জীবনের শেষ প্রান্তে এসেও তাঁর নান্দনিক বিবেচনা আরো সুক্ষ্ম হয়েছিল, আরো প্রখর হয়েছিল। তাঁর হাতের লেখা প্রতিটি বর্ণ ছিল মুক্তোর দানার মতো সুন্দর ও স্বচ্ছ। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত প্রয়াত প্রিয়তমা স্ত্রীকে নিয়ে লেখা প্রতিটি কবিতায় তাঁর তীব্র অনুভূতি ও গভীর ভালোবাসা পরিস্ফুট হয়ে উঠেছিল।
বাঙালির নানা ক্ষেত্রে ইতিহাস সৃষ্টিকারী অনন্যসাধারণ মেধাবী ও সৃষ্টিশীল মানুষের অনেকেরই সান্নিধ্য পেয়েছেন, স্নেহ পেয়েছেন কামাল আহমেদ। এরকম জীবন হয়তো আরো অনেকেরই আছে৷ কিন্তু কামাল আহমেদের মতো স্মৃতি তর্পণে মুখর ও ভাস্বর কম মানুষই আছেন। তিনি শুধু শিল্পের বুভুক্ষু রসিকই ছিলেন না, ছিলেন নিজেও এক জীবন শিল্পী। প্রতিদিনের যাপনে তিনি তাঁর শিল্পীত বিন্যাসকে বিস্তার করেছেন। এমনকি প্রাত্যহিক জীবনের শেষ সময়েও তিনি নায়কোচিত ব্যক্তিত্বকে ধরে রেখেছিলেন। মাথায় শ্বেতশুভ্র চুলের সাথে চিবুকের কোল ঘেঁষে জুলপির বাহার কামাল মামার অনন্য ব্যক্তিত্বকে শত শত মানুষ থেকে আলাদাভাবে উজ্জ্বল করে তুলতো।
কামাল মামা মনেপ্রাণে শিল্পী ছিলেন। আমি যে দৈবাৎ কবিতা লেখার চেষ্টা করেছি – তাতেও শিল্পের রেখাচিত্রের মতো কোন কোন মুহূর্তের বা ভাবনার ছবিটি আঁকার চেষ্টা করেছি মাত্র। যত কম শব্দে, যত কম শব্দরেখার আঁচড়ে সেই ছবিটির অবয়বের ধারণাটি ধরা যায়, আমার চেষ্টা ছিল সেদিকেই। মামা তাঁর কল্পনাশক্তির অনন্য তুলিতে সেই রেখাটিকে নিজে ব্যাখ্যার পূর্ণ ছবিটির রূপ দিয়ে আমাকেই তা শোনাতেন। কামাল মামার অবিস্মরণীয় স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত তাঁর খুব পছন্দের আমার লেখা দুটি চতুষ্পদী এখানে সন্নিবেশ করে দিলাম।
ক. এখানে রাত্রি। আমি একা।
দূরের বাতি জ্বলে কাঁচের জানালায়।
মৃদু লয়ে পিয়ানোয় বাজে বিঠোফেন
টেবল বাতি ঈষৎ কাঁপে শীতল হাওয়ায়।
খ.শীত তাপের তীব্রতা আমি মানি না,
হারিয়ে যাই তোমার সুন্দরের মাঝে।
সবখানেই প্রশংসা তোমার খোদা,
যদিও অভ্যস্ত নই নামাজে!
কামাল মামাকে মনে রাখবো জীবনভর! তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা। আনত অভিবাদন।