দুই বছর আগে ঢাকার উত্তরায় স্কুলছাত্র আদনান কবীর হত্যার ঘটনা আলোচিত ছিল সারা দেশে। ওই হত্যার কারণ হিসেবে তখন স্থানীয় কিশোর–তরুণদের দুটি গ্রুপের দ্বন্দ্ব এবং কিশোরদের ‘গ্যাং কালচার’ বা সংঘবদ্ধ অপরাধের ভয়ংকর চিত্র বেরিয়ে এসেছিল। প্রায় একই সময়ে বিভিন্ন কিশোর অপরাধী চক্র সক্রিয় হয় জেলা শহর কিশোরগঞ্জেও। দুই বছরের মাথায় এসব চক্র এখন পুরো শহরবাসীর বড় উদ্বেগ ও আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এখন কিশোরগঞ্জ জেলা শহরে অন্তত নয়টি কিশোর অপরাধী চক্র বা গ্যাং রয়েছে। একেকটি গ্রুপে রয়েছে ১০ থেকে ১৫ জন কিশোর ও তরুণ। তারা শহরের হারুয়া, আখড়াবাজার, নিউটাউন, খড়মপট্টি, গাইটাল, শোলাকিয়া, মনিপুর ঘাট, নগুয়া, বত্রিশ এলাকাসহ আরও কয়েকটি এলাকায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। খুন, ছিনতাই, সশস্ত্র মহড়া, নারীদের উত্ত্যক্ত করা, মাদক বিক্রি ও সেবন এবং অটোরিকশাস্ট্যান্ড নিয়ন্ত্রণ, চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্মে যুক্ত তারা।
কিশোরগঞ্জ সদর থানা–পুলিশ জানায়, গত এক বছরে হত্যা-নির্যাতনসহ নানা অপরাধে প্রায় ৫০ কিশোরকে আটক করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ অপরাধের অভিযোগে মামলা হয়েছে তিনটি। এর বাইরে আরও দুটি হত্যা ও একটি ধর্ষণের ঘটনায় পৃথক তিন কিশোরের জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছে পুলিশ। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অভিযোগে শতাধিক কিশোরকে আটক করা হয়, পরে অভিভাবকদের থানায় ডেকে মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়।
সম্প্রতি এ বিষয়ে কিশোরগঞ্জ শহরে সাধারণ মানুষ, রাজনীতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদের সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হয়। তাঁরা সবাই কিশোর অপরাধ নিয়ে উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন।
কিশোরগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ ট্রাইব্যুনালের সরকারি কৌঁসুলি এম এ আফজল প্রথম আলোকে বলেন, ‘শহরে কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য অনেকটা নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থায় পৌঁছে গেছে, যা গোটা পরিস্থিতিকে ভয়ানক করে তুলেছে।’ এ জন্য তিনি মাদকের বিস্তার ও রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি সামাজিক ও পারিবারিক সম্পর্কগুলো শিথিল হয়ে পড়াকে দায়ী মনে করেন।
প্রথম আলোর অনুসন্ধানে জানা যায়, এসব অপরাধী চক্রের বেশির ভাগ সদস্য স্কুলছাত্র। বয়স ১২ থেকে ১৭ বছরের মধ্যে। তারা মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান। লেখাপড়া করেনি বা স্কুল থেকে ঝরে পড়েছে এমন কিছু তরুণ–যুবকও আছেন। এ ছাড়া একটা দলের নেতৃত্বে আছেন ৩৭ বছর বয়সের একজন। তাঁর নাম আবু হানিফ ওরফে হাছু; শহরের হারুয়া বউবাজার গলির বাসিন্দা। তিনি হত্যাসহ ১৫ মামলার আসামি।
দুই বছর ধরে কিশোর গ্যাং বা অপরাধী চক্রগুলো শহরবাসীর উদ্বেগ ও আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এ মুহূর্তে কিশোরগঞ্জ শহরে ‘সাজ্জাদ গ্রুপ’ একটা পরিচিত কিশোর গ্যাংয়ের নাম। ১৭ বছর বয়সী সাজ্জাদের পুরো নাম নাজমুল হুদা। শহরের বত্রিশ এলাকায় বাড়ি, নবম শ্রেণির ছাত্র। গত ফেব্রুয়ারিতে সাজ্জাদ ও তার সহযোগীরা সহপাঠী খালেদ আহমেদকে ব্যাপক মারধর করে। স্কুলের বেঞ্চের ভাঙা পায়া দিয়ে পেটানোর একপর্যায়ে খালেদের বাম চোখ গলে যায়। পেটানোর কারণ হলো খালেদ ওই কিশোর গ্যাংয়ে যুক্ত হতে রাজি হয়নি। ওই ঘটনায় সাজ্জাদসহ তিন কিশোরকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। অবশ্য অল্প কদিন পর তারা জামিনে মুক্তি পায়। তাদের নির্যাতনে এক চোখ হারানো খালেদ কিশোরগঞ্জ ছেড়ে দিয়েছে। এখন কুমিল্লার একটা বিদ্যালয়ে পড়ছে বলে তার স্বজন বজলুর রহমান প্রথম আলোকে জানান।
গত ৭ অক্টোবর বত্রিশ এলাকার নতুন পল্লী সংঘ মন্দিরে দুর্গাপূজার আরতি চলার সময়ে সাজ্জাদ তাঁর দলসহ মেয়েদের উত্ত্যক্ত করছিল। এতে বাধা দেওয়ায় পরদিন সাজ্জাদের দলের সদস্যরা কুপিয়ে জখম করে শুভ সরকার (১৬), প্রসেনজিৎ ঘোষ (১৭) ও তনয় বর্মণ (১৭) নামের তিন কিশোরকে। এ ঘটনার পরে সাজ্জাদসহ ১১ জনকে র্যাব আটক করে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে। ১১ জনের মধ্যে সাতজন ছিল অপ্রাপ্তবয়স্ক। কিশোরগঞ্জ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু বকর সিদ্দিক প্রথম আলোকে বলেন, গ্রেপ্তারের পর সাজ্জাদ ও তার সহযোগীদের টঙ্গী কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে।
আরেক অপরাধী চক্রের প্রধান আবু হানিফ ওরফে হাছুর সঙ্গে গত ১৬ এপ্রিল শহরতলির কাতিয়ারচরে বৈশাখী মেলায় ঝগড়া হয় হারুয়া সওদাগর পাড়ার কিশোর লাদেন মিয়ার। তখন গ্যাংয়ের সদস্যরা লাদেনকে মারধর করে। পরদিন ১৭ এপ্রিল এলাকাবাসী হাছুর সহযোগীদের ধাওয়া দেয়। এর রেশ ধরে ওই রাতেই হাছুর গ্যাংয়ের সদস্যরা লাদেন মনে করে তার প্রতিবেশী সাগর মিয়া নামের আরেক কিশোরকে কুপিয়ে হত্যা করে। এ ঘটনায় হাছুসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। হাছু বর্তমানে জামিনে মুক্ত আছেন।
গত ১০ অক্টোবর কিশোরগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির এক অনুষ্ঠানে শহরের কিশোর গ্যাং নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদও। তিনি বলেন, মাদক ও কিশোর গ্যাং এখন কেবল কিশোরগঞ্জের নয়, সারা দেশের বড় সমস্যা। এই সমস্যা সমাধানে কেবল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নয়, সবাইকে দায়িত্ব নিতে হবে।
জেলা প্রশাসক মো. সারওয়ার মুর্শেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে জানান, কিশোর অপরাধের নিয়ন্ত্রণের জন্য তাঁরা ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে শিক্ষার্থী, অভিভাবকসহ সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করার পরিকল্পনা করেছেন। খুব দ্রুত এটা শুরু করা হবে।
অপরাধের ধরন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, জ্যেষ্ঠ–কনিষ্ঠ (সিনিয়র–জুনিয়র) দ্বন্দ্ব, মাদকসংক্রান্ত বিরোধ এবং তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বেশির ভাগ সহিংস ঘটনা ঘটছে। মাঝেমধ্যে কিশোর গ্যাংগুলো নিজেদের জানান দিতে সন্ধ্যার পর সশস্ত্র মহড়া দেয়। এ সময় তারা আশপাশে ভাঙচুর ও নিরীহ পথচারীদের মারধর করে বলেও স্থানীয় বাসিন্দারা জানান।কোনো কোনো ক্ষেত্রে এসব অপরাধী চক্র কিছু রাজনৈতিক নেতার প্রশ্রয়ও পেয়ে থাকে বলেও অভিযোগ আছে।
শহরের এসবি সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা শাহনাজ কবীর মনে করেন, কিশোরদের একটা বড় অংশ এখন মাদকের পাশাপাশি ইন্টারনেট ও পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত হয়ে পড়েছে। সব মিলিয়ে তাদের মনস্তত্ত্বে একটা নেতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। যে কারণে তাদের অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে।
কিশোর গ্যাংয়ের কার্যক্রমসহ অন্যান্য অপরাধ নিয়ন্ত্রণে গোটা শহর ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরার নিয়ন্ত্রণে আনার কার্যক্রম চলছে বলে জানিয়েছেন কিশোরগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার মো. মাশরুকুর রহমান। তিনি বলেন, এ জন্য ৮০টি জায়গা নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ২০০টি ক্যামেরা বসানো হবে।