শরীফ হাসান
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সঙ্গনিরোধ বা ফিজিক্যাল ডিস্ট্যান্সিং চলছে প্রায় দুই মাস হলো। কোভিড-১৯-এর ভ্যাকসিন তো দূরের কথা, রোগটা সারানোর গ্রহণযোগ্য চিকিৎসা পদ্ধতি বা কার্যকরী কোন ঔষধও সহসাই আসছে না। সবাই বুঝে ফেলেছেন, করোনা থেকে খুব দ্রুত মুক্তি মিলছে না। তাই আক্রান্ত হবার বা মৃত্যুভয়ের প্রাথমিক ধাক্কা বা শক কাটিয়ে মানুষের মনে এখন ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা।
বিশ্বজুড়ে কোটি মানুষের কর্মহীন হয়ে পড়ার ভয়, বিশ্ব অর্থনীতি পুরোপুরি ভেঙে পড়ার ভয়ে সবাই তটস্থ। বাংলাদেশের মত স্বল্পোন্নত দেশে সবার জন্য এই ভয় বা আশঙ্কা কয়েক গুণ বেশি। কয়েক কোটি মানুষ যেখানে দিন আনে দিন খায় সেখানে দীর্ঘ সময় ধরে লকডাউনের কারণে লাখো পরিবার ইতোমধ্যে পথে বসেছে। এবং কেউ জানে না এই মহাবিপর্যয় কতদিন থাকবে, দুঃসময় কতটা দীর্ঘ হবে।
করোনা দুর্যোগের শুরুতে সরকারের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণে দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও বিস্তার রোধ করা যায়নি। এছাড়া সম্পদের অপ্রতুলতা, জনগণের মাঝে সচেতনতার অভাব, সরকারি নির্দেশনা না মানার প্রবণতা ইত্যাদি কারণে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আক্রান্তের আর মৃতের সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। আর এখন রোগের সংক্রমণ আর মৃত্যু ঠেকানোর পাশাপাশি সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে মানুষের অন্ন সংস্থান করা। যেখানে বৃহৎ অর্থনৈতিক শক্তিগুলোই অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশের পক্ষে এটি আরও কষ্টসাধ্য।
তবে একটা দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের অনেক দেশ থেকে কিছুটা এগিয়ে। তা হলো বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান গতি-প্রকৃতি। বিস্ময়কর হলেও সত্য, করোনার কারণে উন্নয়নের গতি বাধাপ্রাপ্ত হলেও বাংলাদেশের অর্থনীতি সহসাই ধসে পড়বে না, খাদ্যাভাব প্রকট হবে না। এর মূল কারণ কৃষিক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্বনির্ভরতা। আর এর কারিগর দেশের লাখো কৃষক। কৃষি ব্যবস্থার যথাযথ আধুনিকায়ন, কৃষকদের স্বার্থরক্ষায় সরকার বিভিন্ন সময়ে ব্যর্থ হবার পরেও বাংলার কৃষকেরা যুগের পর যুগ দেশের মানুষের খাদ্যের যোগান দিয়ে যাচ্ছেন। এই মহামারির সময়েও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না।
দ্যা ডেইলি সানের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ এ বছর বিশ্বে তৃতীয় অবস্থানে থাকবে। US Department of Agriculture (USDA)-এর World Agricultural Production রিপোর্টের বরাতে তারা বলছে, বাংলাদেশ ৩৬ মিলিয়ন মেট্রিক টন ধান উৎপাদন করবে। বাংলাদেশের থেকে এগিয়ে থাকবে শুধু চীন আর ভারত যাদের আবাদি জমির পরিমাণ, কৃষি ব্যবস্থা এবং মূলধন সব কিছু বাংলাদেশের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি।
এ এক যাদু। ছোট্ট এই ভূ-খণ্ডে কৃষকদের যেন জন্মই হয়েছে দেশবাসীর মুখে আহার তুলে দেবার জন্য। সার, পানি, বীজ না পেলেও তারা থামবেন না। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে ফসল ফলাবেন। ফসলের ন্যায্য দাম না পেয়ে হাহাকার করবেন। তবুও ক্ষান্ত দেবেন না। নতুন উদ্যমে ফসল ফলাবেন।
কবি রাজিয়া খাতুন চৌধুরাণীর ভাষায় ঋষি দধীচির চেয়েও মহান সাধক এই “চাষাদের” কারণে দেশের মানুষ না খেয়ে মরবে না। মহামূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে বিপুল পরিমাণ খাদ্যশস্য আমদানী করতে হবে না। ইউরোপের বৃহৎ অর্থনীতির দেশগুলো যেখানে খাদ্যশস্য উৎপাদন বা আমদানী করতে হিমশিম খাচ্ছে, কৃষি শ্রমিক আনতে ছোটাছুটি করছে সেখানে বাংলাদেশ বেশ স্বস্তিকর অবস্থায় আছে। এর একক কৃতিত্ব আমাদের কৃষকদের।
এর পরেই আছেন আমাদের পোশাক শ্রমিকরা। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে সময় টিভি রিপোর্ট করছে, এই দুঃসময়েও পোশাকখাত ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। পোশাক প্রস্তুতকারী ও রপ্তানিকারকদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, করোনাভাইরাসের এই দুঃসময়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে উৎপাদন সম্ভব হলে আগামী আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বর হলিডে এবং অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর- স্প্রিং মৌসুমে অন্তত ১ হাজার কোটি মার্কিন ডলারের কার্যাদেশ পাওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে দেশের তৈরি পোশাক খাতে। বিশেষ করে, প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোতে করোনার প্রভাব তুলনামূলক বেশি হওয়ায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডার ক্রেতারা বাংলাদেশ থেকে পণ্য কিনতে আগ্রহ প্রকাশ করছে।
বিজিএমইএ সহ-সভাপতি এ এম চৌধুরী সেলিমের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এই মৌসুমে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পখাত ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতির মুখে পড়লেও আগামী দুই মাসের কার্যাদেশে তা কাটিয়ে ওঠার আশা করছেন গার্মেন্টস মালিকরা। জাপানও এখন বাংলাদেশ থেকে তৈরিকৃত পোশাক কিনতে আগ্রহ প্রকাশ করছে বলে সেলিম জানান।
সাড়ে ৪ হাজারের বেশি গার্মেন্টস কারখানায় নীরবে নিভৃতে কাজ করে যাচ্ছেন ৮০ লাখ পোশাক শ্রমিক। তাদের নিরলস পরিশ্রমে বিশ্বে পোশাক রফতানিতে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। গত চার দশক ধরে তাদের শ্রমে ও ঘামে আমাদের অর্থনীতি সুদৃঢ় হয়েছে। মাথাপিছু আয় বেড়েছে, কৃষি নির্ভরতা কমেছে, সরকারের পক্ষে একের পর উচ্চাভিলাষী উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা সম্ভব হয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এই শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা গেলে তারা বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা দ্রুততম সময়ে সচল করে ফেলবেন।
আর আছেন প্রায় কোটিখানিক প্রবাসী। তাদের ধারাবাহিক সমর্থনে দেশের অর্থনীতি বিশেষ করে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত এখনো বেশ ভালো। দ্যা ডেইলি স্টারের প্রতিবেদন বলছে, শত সংকটেও আসছে প্রবাসী আয়। গত সাড়ে চার মাসে তারা দেশে পাঠিয়েছেন ৫১ হাজার ৫১০ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রের বরাতে পত্রিকাটি জানাচ্ছে, গত বছরের জুলাই থেকে চলতি অর্থবছরে প্রবাসীরা ১ হাজার ৪৮৫ কোটি ৬০ লাখ ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। তবে করোনার কারণে ব্যাপকভাবে লকডাউন শুরু হওয়ায় মার্চে এসেছে ১২৮ কোটি ডলার যা আগের বছরের মার্চের চেয়ে ১২ শতাংশ কম।
অবশ্য সামনে যেহেতু ঈদ, তাই মে মাসে প্রবাসী আয়ের ধারা বেড়েছে। মে মাসের প্রথম দুই সপ্তাহেই ৬২ কোটি ৪ লাখ ডলারের প্রবাসী আয় এসেছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম।
প্রবাসে অবস্থানের অভিজ্ঞতায় জানি, শত সংকটেও প্রবাসীরা দেশকে, দেশের মানুষকে ভুলে থাকেন না। ১০ ডলার আয় করলে, দুটো ডলার দেশে পাঠান। বিপদ-আপদ, উৎসব-আয়োজনে এর পরিমাণ আরও বাড়ে।
বাংলাদেশের জন্মকাল থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত সকল আন্দোলন-সংগ্রাম, জাতীয় দুর্যোগে প্রবাসীরা তাদের মাতৃভূমির পাশে থেকেছেন। এবারও তার ব্যত্যয় ঘটছে না। হাজার হাজার প্রবাসী ব্যক্তিগতভাবে বা বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে অর্থ সংগ্রহ করে দেশের দুঃস্থদেরকে সহায়তা করছেন, অনুদান পাঠাচ্ছেন।
করোনা একসময় বিদায় নেবে। ততদিন পর্যন্ত টিকে থাকতে হবে। কৃষক-পোশাক শ্রমিক-প্রবাসী ত্রয়ী এই টিকে থাকার লড়াইয়ে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশকে শক্ত অবস্থানে রেখেছেন। সম্মুখ সমরে করোনার বিরুদ্ধে প্রাণপণে লড়ে যাচ্ছেন চিকিৎসকসহ সকল স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশ বাহিনী ও মাঠ প্রশাসন আর পেছন থেকে রসদ যোগাচ্ছেন কৃষক, পোশাক শ্রমিক আর প্রবাসীরা। এই তিনের হাতেই বাংলাদেশের অর্থনীতির উত্থান, এই তিনের মিলিত শক্তিই চলমান বৈশ্বিক মহাদুর্যোগ শেষে আঠারো কোটি মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেবে। এই তিনের কারণেই বাংলাদেশের মানুষ আশার প্রদীপটি জ্বালিয়ে রাখতে পারেন।