বৈশ্বিক অর্থনীতির গতি দিন দিন বাড়ছে। বর্তমান প্রযুক্তিবিপ্লবের যুগে এ অর্থনীতি এত বিচিত্র পথে এগিয়ে চলেছে, যা এর আগে বিশ্বের মানুষ প্রত্যক্ষ করেনি। কয়েক দশক আগেও হয়তো বর্তমান পরিস্থিতির কথা কল্পনাও করতে পারেননি অর্থনীতিবিদেরা। ফলে, আজকের এ অর্থনীতি এক নতুন পরিস্থিতির সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে বিশ্ববাসীকে, যা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নতুন নতুন নীতিও হাজির করছে।
বড় অর্থনীতির দেশগুলোর দিকে তাকালে দেখা মিলবে শত কোটি ভোক্তা ও লাখো প্রতিষ্ঠানের কাতার। এই ভোক্তা ও প্রতিষ্ঠান কিন্তু মোটাদাগে নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেই নিচ্ছে। কিন্তু সূক্ষ্মভাবে দেখতে গেলে এসব সিদ্ধান্তই গৃহীত হয় সুনিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রীয় নীতির কাঠামোর ভেতরেই। আর এই নীতি তৈরি থেকে এর প্রয়োগ—সবকিছুই করে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। কেন্দ্রীয় ব্যাংক, মুদ্রানীতিসংক্রান্ত পরিষদের মতো সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজই হচ্ছে অর্থনীতিকে সামগ্রিকভাবে এগিয়ে নেওয়া, গতিশীল করা। এই কাঠামোই ভোক্তা বা প্রতিষ্ঠানকে তার অজ্ঞাতেই নির্দেশ দেয়, কতটা ব্যয় করতে হবে বা কতটা ঋণ করা যায়। ঋণ করে ঘি না খাওয়ার দাওয়াইটি আগে থেকেই রাষ্ট্র তার নীতিকাঠামোর মাধ্যমে মানুষের মগজে ঢুকিয়ে দেয়। ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিশ্বের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ও এসবের নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিষ্ঠিত নীতি অনুসরণ করেই চলছে। বলা ভালো যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বের পুঁজি কেন্দ্রটি যে কাঠামোটি দাঁড় করায়, তা-ই ১৯৯০ সালের পর এক মেরু বিশ্বকাঠামোয় একমেবাদ্বিতীয়ম্ হয়ে ওঠে।
এই প্রতিষ্ঠিত নীতি অনুযায়ী একটি দেশের সরকার চায় প্রচুর কর্মসংস্থান তৈরি করতে, যাতে তারা নাগরিকদের কাছ থেকে সমর্থন পায় আগামী ভোটের বৈতরণি পার করতে। আর চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন–সংকট দেখা দিলে এই অর্থনীতিই আবার মুদ্রাস্ফীতির মুখে পড়বে। মুদ্রাস্ফীতি অবশ্য সব সময় অনাকাঙ্ক্ষিত নয়। কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে দুটি বিষয়ের মধ্যে ভারসাম্য আনার কঠিন কাজটি করতে হয় স্বাধীন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। এই পুরো কাজে রাজনীতিক ও ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ পৃথকভাবে তাঁদের দায়িত্ব পালন করেন। এত দিন ধরে এটিই হয়ে আসছে। কিন্তু এখন এই সামগ্রিক ব্যবস্থা ভেতর থেকে ধসে পড়ছে।
ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, বেকারত্ব কমলে একটি দেশের মানুষের গড় ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে। আর এ কারণেই মুদ্রাস্ফীতিও বাড়ে। ফলে, কর্মসংস্থান বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মুদ্রাস্ফীতি আনুপাতিক হারে বাড়ে। কী হারে বাড়বে, তা রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান ঠিক করে দেয়। কিন্তু এখন এই সাধারণ নীতিতেই ব্যত্যয় হচ্ছে। বিশ্বের অধিকাংশ ধনী দেশে বর্তমানে বেকারত্ব কমছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে মুদ্রাস্ফীতি ঠিক করতে পারছে না বা করছে না। যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমানে বেকারত্বের হার সাড়ে ৩ শতাংশ, যা ১৯৬৯ সালের পর সর্বনিম্ন। কিন্তু এই দেশেই বর্তমানে মুদ্রাস্ফীতির হার মাত্র ১ দশমিক ৪ শতাংশ। সুদহারও এত কম যে তা আরও কমানোর কোনো সুযোগ থাকছে না। এরপরও কমালে তা মন্দার ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। এমনকি এই পরিস্থিতিতেও বন্ড মার্কেট বেশ গতিশীল। এই পুরো বিষয়টিই ঠিক সাধারণ সূত্রের সঙ্গে মেলে না। কয়েক বছর আগেও এমন পরিস্থিতিকে সাময়িক বলে মনে করেছিলেন অর্থনীতিবিদেরা। কিন্তু এটিই এখন খুব স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে।
এই নতুন পরিস্থিতি বলছে, এত দিন ধরে চলে আসা অর্থনীতির কাঠামোটি নিয়ে নতুন করে ভাবা প্রয়োজন। এমনকি কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাজ ও এর প্রকরণ নিয়েও ভাবা প্রয়োজন। কারণ, অর্থনীতিতে চলতে থাকা বিভিন্ন ঘটনা বলে দিচ্ছে, বিদ্যমান কাঠামোটি নতুন এ অর্থনীতিকে চালিয়ে নিতে পারছে না। এ অবস্থায় বেশি দিন চললে, তা এমনকি ভয়ংকরও হয়ে উঠতে পারে।
নতুন এ অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মূলটি রয়েছে গত দশকের মন্দা মোকাবিলায় গৃহীত পদক্ষেপগুলোর মধ্যে। ২০০৭-০৮ সালে মন্দা মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সীমিত সময়ের জন্য কিছু অপ্রচলিত সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু তারপরও মন্দা এড়ানো যায়নি। সে সময়ই বোঝা হয়ে গিয়েছিল যে এর কারণ আরও গভীরে। মূলত কর্মসংস্থান বৃদ্ধির সঙ্গে মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধির হারে অসামঞ্জস্য, আধুনিক সরবরাহ–পদ্ধতি ও এর বিভিন্ন ধাপে নির্ধারিত পণ্যের মূল্যের সঙ্গে স্থানীয় শ্রমবাজারের ক্রয়ক্ষমতা অসামঞ্জস্যতা, প্রতিষ্ঠানের আধিক্য, সঞ্চয়প্রবণতা বৃদ্ধি, নতুন বিনিয়োগে অনাগ্রহ ইত্যাদি মিলিয়ে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি করে, যেখানে সুদহার যথাযথভাবে বৃদ্ধি করাও কঠিন হয়ে পড়ে। এটি একটি দুষ্টচক্রের মতো চলছে। একটি আরেকটিকে চালিত করছে। ঘটনার কারণ ও ফল পরস্পরকে নির্মাণ করে চলেছে।
উদ্ভূত পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মেলাতে সারা বিশ্বের অর্থনীতিবিদেরাই গলদঘর্ম হচ্ছেন। ২০১২ সালে দিকে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভের অধিকাংশ কর্মকর্তা ভেবেছিলেন, সুদহারকে ৪ শতাংশে স্থির করা সম্ভব হবে। কিন্তু আট বছরের মাথায় এ সুদহার মাত্র ১ দশমিক ৭৫ থেকে ২ শতাংশে উন্নীত করা গেছে, যা কিনা আবার জি-সেভেনভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। এক দশক আগেও নীতিপ্রণেতারা ভেবেছিলেন, প্রাথমিক উদ্দীপনার প্রয়োজন ফুরালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো বন্ড বাজারের আগল ধরবে। কিন্তু এখন সেই উদ্দীপনার নীতিগুলোই স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাংকের (ইসিবি) কথা। মুদ্রাস্ফীতি বাড়াতে মরিয়া ইসিবি এই সময়ে আবারও উদ্দীপনামূলক অর্থনৈতিক কর্মসূচি (কিউই) নিতেই তৎপর।
এ অবস্থায় আসলে কী করা যায়। ইকোনমিস্টের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, সম্পূর্ণ নতুন করে ভাবতে হবে। সে ক্ষেত্রে নীতিগত জায়গায় অনেক পরিবর্তন আনতে হবে। এই পরিবর্তনগুলোর হতে হবে অর্থনীতিকে গতিশীল করতে তুলনামূলক নতুন পন্থা অবলম্বন করে। উদ্দীপনামূলক কর্মসূচি হিসেবে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের জন্য ঋণ সরবরাহ করা একটি পদক্ষেপ হতে পারে। এই বিনিয়োগ হতে পারে অবকাঠামো উন্নয়নের মতো ক্ষেত্রগুলোয়, যা প্রবৃদ্ধিকে বেগবান করবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এ ধরনের পদক্ষেপের বিষয়ে বড় অর্থনীতিগুলো দোনোমনা করছে। বড় কোনো পদক্ষেপ নিতে তারা সংশয়ে ভুগছে, যা অর্থনীতির এ সংকটকে আরও জটিল করে তুলছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় জার্মানির সড়ক ব্যবস্থার কথা, যা সেকেলে হয়ে পড়েছে অনেক দিন হলো। ২০১০ সালে ব্রিটেন বাজেট সংকোচনের যে নীতি নিয়েছিল, তা থেকে খুব একটা সরে আসেনি এখনো। সরকারি বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় দেশটির উৎপাদন খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ব্যাপকভাবে। আর যুক্তরাষ্ট্র চলছে অত্যধিক বাজেটঘাটতি নিয়ে। অথচ এর মধ্যেও তারা করপোরেট পর্যায়ে কর রেয়াত দিচ্ছে। কিন্তু সড়কব্যবস্থার উন্নয়ন ও টেকসই জ্বালানি কাঠামো তৈরিতে বিনিয়োগ করছে না, যা তাদের দীর্ঘ মেয়াদে উপকার করত।
এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মতো দেশগুলোর ক্ষমতাসীন রাজনীতিকেরা সত্যিকার অর্থে কোনো বিকল্প হাজির করতে পারছেন না। হ্যাঁ, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অনেকটা নিয়ম করেই যেকোনো উপলক্ষ খুঁজে ফেডারেল রিজার্ভকে (ফেড) আক্রমণ করছেন তাঁর টুইটের মাধ্যমে। কিন্তু ফেড বিকল্প হিসেবে কী করতে পারে, তা কিন্তু বলছেন না। আবার বিকল্প হিসেবে যা বলছেন, তা উচ্চারণমাত্রই ঝড় উঠছে বিশ্বের শেয়ারবাজারগুলোয়। এ এক বিরাট যন্ত্রণা। এর বিপরীতে এসব দেশে যাঁরা ক্ষমতার বাইরে রয়েছেন, সেই রাজনীতিকেরা কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ‘অকর্মা’ আখ্যা দিয়ে বলছেন, এ ক্ষেত্রে সরকারকে সরাসরি ভূমিকা নিতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের বাম ঘরানা থেকে মুদ্রাস্ফীতি কম থাকাকালে রাষ্ট্রীয় ব্যয়ের পরিসর বৃদ্ধির সুপারিশ করা হচ্ছে। একই ধরনের সুপারিশ আসছে ব্রিটেনের লেবার পার্টির কাছ থেকেও। তারা চায়, ব্যাংক অব ইংল্যান্ড ঋণ বিতরণে এগিয়ে আসুক। তবে এ ক্ষেত্রে ঋণগ্রহীতা ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাঝখানে একটি বিনিয়োগ বোর্ডের উপস্থিতি চায় তারা, যেখানে বাণিজ্যমন্ত্রী, গভর্নরসহ সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা থাকবেন।
মজার বিষয় হলো, বর্তমানে বড় অর্থনীতির বেশ কয়েকটি দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারের জন্য একটি মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে। সরকারের দিক থেকে অনেক সময়ই অভিযোগ আসছে যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার সীমালঙ্ঘন করছে। আর্থিক নীতি প্রণয়নের মতো সরকারি এলাকায় তার অনভিপ্রেত উপস্থিতি মাঝেমধ্যেই দৃষ্টিগ্রাহ্য হচ্ছে। এই অভিযোগের মূল কথা হলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতাকে সীমিত করা, তাকেও নিয়ন্ত্রণের আওতায় নিয়ে আসা। কথা হচ্ছে কার নিয়ন্ত্রণ? ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন ফেডের সমালোচনা করেন, তখন বুঝতে হয় যে তাঁর প্রকল্পিত পথে প্রতিষ্ঠানটি হাঁটছে না। অর্থাৎ রাজনীতিকেরাই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নিতে চাইছেন। তাঁরা আর্থিক ও মুদ্রানীতির একটি সংকর রূপ তৈরি করতে চাইছেন। শঙ্কাটা হচ্ছে, রাজনীতিকেরা যেমন কেন্দ্রীয় ব্যাংকে প্রভাব বিস্তার করতে চান, নীতিপর্যায়ে প্রভাবশালী ব্যবসায়ীনেতারাও চাইবেন নিজের মতো করে সিদ্ধান্ত নিতে। এটি আবার পুরো করপোরেট কাঠামোকে, যা এরই মধ্যে রাক্ষসে পরিণত হয়েছে, তাকে উদ্দীপ্ত করবে আরও স্বেচ্ছাচারী হতে। সে ক্ষেত্রে এই পুরো জোট দরিদ্রদের জন্য কতটুকু অবশিষ্ট রাখতে ইচ্ছুক হবে? তাদের বিনিয়োগের ধরনটি তখন কি শুধুই সম্পদের পাহাড় তৈরির জন্য হবে না? অর্থনীতির ঠিক কত অংশের মালিকানা তখন রাষ্ট্রের হাতে থাকবে?
সব মিলিয়ে এখনো বিদ্যমান অর্থনৈতিক কাঠামোটি সামষ্টিক অর্থনীতিতে ভারসাম্য ও স্থিতিশীলতার নিশ্চয়তা আর দিচ্ছে না। বিভিন্ন সংকট মোকাবিলায় পুরোনো ও বহুল ব্যবহৃত অস্ত্রগুলো তার কার্যকারিতা অনেকটাই হারিয়েছে। এ অবস্থায় বর্তমান বিশ্ব ও এর পরিবর্তিত অর্থনীতি ও এর সংকট মোকাবিলায় রাষ্ট্র ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোকে নতুন করে ভাবতে হবে। অর্থনীতিবিদেরা মন্দার আশঙ্কা প্রকাশ করছেন প্রায়ই। বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে এ ধরনের ঝুঁকি হ্রাসে আগে থেকেই প্রস্তুত থাকতে হবে।