মানস ঘোষ, ঢাকা
গুঞ্জনটা কিন্তু থামছে না। বরং দিন যত ঘনিয়ে আসছে ততই বাড়ছে। আগষ্টের শেষদিকে এসে নির্বাচন কমিশন জানিয়ে দিলো ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহেই অনুষ্ঠিত হবে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন। হিসেব অনুযায়ি তাই-ই হওয়ার কথা। তবু তফসিল ঘোষণার আগেই কমিশনের পক্ষ থেকে নির্বাচনের সময় নির্দিষ্ট করে দেয়ায়, ভোটের আলোচনা আরো জোরেশোরে শুরু হবে তাতে কোন সন্দেহ নাই। কিন্তু সময়মতো নির্বাচন হবে না বলে যে গুঞ্জন বাজারে চাউড় আছেÑ ইসি’র এই ঘোষণার পর কি তা থামবে? আমার তা মনে হয়না। গুঞ্জন থামাতে যে রাজনৈতিক সমঝোতা দরকার বাংলাদেশের বাস্তবতায় আপাত তার কোন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে।
কৌশলী ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। তারা চায় এই ধোঁয়াটে অবস্থাতেই নির্বাচন জিতে আরেক মেয়াদে ক্ষমতায় বসতে। অন্যদিকে বিএনপি’র চাওয়া যে কোন উপায়েই একটা গণজাগরণ। যে জাগরণ, ক্ষমতাসীন দলকে বিপাকে ফেলবে, সামনের সারিতে উঠিয়ে আনবে ধানের শীষকে।
কিন্তু সব হিসাব কি সবসময় মেলে? ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারীর নির্বাচনের আগে রাজপথে কঠিন লড়াই করে, এক পর্যায়ে হাল ছেড়ে দিতে হয় বিএনপিকে। তার আগে ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারির নির্বাচনের সময়ও হতাশ গতে হয় বিএনপিকে। মাত্র ১০ দিন আগে সেনা সমর্থিত তত্বাবধায়ক সরকার এসে তাদের সব হিসাব-নিকাশ ওলোটপালোট করে দেয়। সামান্য ভুলে ১২ বছর ক্ষমতার বাইরে জিয়া পরিবার। এবার তাই অনেক বেশি সতর্ক বিএনপি। অংক কষে পা ফেলছে দলটি। একদিকে নির্বাচনের কথা ভেবে প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে, অন্যদিকে সামনের ২/৩ মাস রাজপথে আন্দোলনেরও কর্মসুচী চুড়ান্ত করতে হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে নির্বাচন ও আন্দোলনের বাইরে থাকা দলটির জন্য কাজটা সহজ নয়। বিশেষ করে এমন একটা সময় যখন দলের চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া জেলে। আর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন তারেক রহমান লন্ডনে।
বিএনপি নেতারা জানেন, দ্বিদলীয় এই রাজনীতির দেশে তারা ছাড়া আর কোন বড় বিরোধী শক্তি নেই। এও জানেন, কোনভাবে একটা ভালো নির্বাচন হলেই তাদের ক্ষমতায় যাওয়া প্রায় নিশ্চিত। শুধুমাত্র এই ভরসাতেই সম্ভবত রুটিন কিছু বক্তৃতা-বিবৃতি’র বাইরে, বলা চলে একপ্রকার চুপচাপই আছেন দলটির নেতারা। শক্তি ক্ষয় হবে ভেবে খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে বড় কোন কর্মসূচীও নেয়নি বিএনপি। কিন্তু আর সম্ভবত দলটির বসে থাকার সময় নেই। ডিসেম্বরে নির্বাচন ধরতে, রাজপথে এখনই তাদের নামতে হবে। বিএনপি’র বড় ইতিবাচক দিক- দলের ঐক্য। মাঝেমধ্যে কিছু কানাঘুষা শোনা গেলেও প্রকাশ্যে দলটির ছোটবড় সব নেতার মধ্যেই এখনো ঐক্য আছে এবং দলটিও ভেঙ্গে যায়নি।
রাজনীতির চতুর মারপ্যাচে আওয়ামী লীগ বরাবরই এগিয়ে থাকা দল। ২০১৪ সালের নির্বাচনে প্রবল প্রতিকুল অবস্থায় যেভাবে দলটি আবার ক্ষমতায় এসে, টানা ৫ বছর নির্বিঘœ দেশ চালালো, তাতে তাদের সংগঠনিক সামর্থ নিয়ে কারো প্রশ্ন থাকার কথা নয়। কিন্তু আওয়ামী লীগ জানে এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। গতবার বিএনপিকে শুধু রাজপথে ঠেকিয়েই উতরানো গেছে, নির্বাচনী মাঠে ঝামেলায় পরতে হয়নি। কিন্তু এবার শুধু বিএনপিই নয়, গতবার বর্জন করা প্রায় সবগুলো দল নির্বাচনে অংশ নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য আওয়ামী লীগের ওপর দেশি-বিদেশি চাপও আছে। তাই বলা যায় নির্বাচনের আগে এই তিন মাস সরকারি দলকে একদিকে বিরোধী পক্ষের আন্দোলন সামাল দিতে হবে। অন্যদিকে জয়ী হওয়ার সহজ রাস্তাও খুঁজতে হবে।
আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় ভরসা দলটির নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মাঠের রাজনীতিতে ক্রমশ জনপ্রিয়তা হারানো দলটির নেতারা তাই তাকিয়ে আছেন প্রধানমন্ত্রীর দিকেই। তারা জানেন দলীয় প্রধানের নেতৃতগুণ আর দূরদর্শী সিদ্ধান্ত, বিপদে একমাত্র রক্ষা কবজ। দলটির আরো একটি সুবিধা, শেখ হাসিনার প্রতি সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের দৃশ্যমান আনুগত্য। বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনেও আছে আওয়ামী লীগের শক্তিশালী প্লাটফর্ম। বিশেষ করে ব্যবসায়ী নেতৃত্বের বড় অংশ সমর্থন দেখিয়ে যাচ্ছে দলটির প্রতি। সময়মত গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করার কৌশলও জানা আছে ক্ষমতাসীনদের। টানা প্রায় সাড়ে ৯ বছর সরকারে থাকায় এসবই অর্জন করেছে দলটি। কিন্তু দলের প্রবীণ নেতারা জানেন, সময়মত হাল ধরতে না পারলে এসবের কিছুতেই কিছু হবে না।
আওয়ামী লীগ মনে করে আন্দোলন করার শক্তি বিএনপি’র খুব একটা নেই। খালেদা জিয়াকে জেলে নেয়ার পর, বড় কোন কর্মসূচী দিতে না পারা বিএনপিকে নিয়ে দুশ্চিন্তাও তাই কম দলটির নেতাদের। দুশ্চিন্তা যা আছে, অরাজনৈতিক আন্দোলন নিয়ে। সাম্প্রতিক কোটা সংস্কার বা নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে চমকে উঠে ক্ষমতাসীনরা। নির্বাচনের আগে আগে এমন যে কোন আন্দোলন, পরিস্থিতি খারাপ করে দিতে পারেÑ সেটা বিশ্বাস করেন দলটির সিনিয়র নেতারাও। তাদের আরো একটি বড় ভীতির নাম স্যোশাল মিডিয়া বা অন্য অর্থে ফেইসবুক। ফেইসবুকের ছোট্ট একটা পোস্ট, বানের জলের মতো ছড়িয়ে, ক্যামন করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে যায়, আওয়ামী লীগের ভেতরে এই নিয়ে চলছে তাই গবেষণা।
প্রশ্ন হচ্ছে যে নির্বাচনকে ঘিরে ক্ষমতায় যাওয়ার বিএনপি-আওয়ামী লীগের এতো হিসেব নিকেষÑ শেষ পর্যন্ত সেই নির্বাচন কি সময়মত হবে? হলেও ক্যামন হবে ভোট? সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র বা বিদেশী কূটনীতি কোন দৃষ্টিতে দেখছে বাংলাদেশের এবারের ভোট যুদ্ধকে?
এই প্রশ্নের সহজ উত্তর এখনই দেয়া হয়ত সম্ভব নয়। কিন্তু বলা যায়, নির্বাচন সময়মত হবে না এমন কোন পরিস্থিতিও দেশে এখন পর্যন্ত সৃষ্টি হয় নাই। একটা পক্ষ বিশ্বাস করে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির মতো এবারো সময় মতো ভোট হবে। সেই নির্বাচনে বিএনপিও মাঠে থাকবে। নির্বাচনে না গেলে দলের নিবন্ধন বাতিল হবে শুধুমাত্র সেই কারণেই নয়, শেখ হাসিনার
নেতৃত্বে বিএনপি শেষ পর্যন্ত ভোটের লড়াইয়ে থাকবে দলকে টিকিয়ে রেখে, পরবর্তি আন্দোলনকে চাঙ্গা করতে। বিএনপি’র হাইকমান্ড বিশ্বাস করে জিততে হলে ভোটে ব্যাপক কারচুপি করতে হবে সরকারি দলকে। জনগণ তখন বিতশ্রদ্ধ হয়ে সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে। দেশে-বিদেশে সেই ভোটের গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও তখন প্রশ্ন তুলতে পারবে বিএনপি। তাছাড়া বেগম জিয়াকে নির্বাচনের আগে মুক্ত করতেও ভোটে যাওয়ার কৌশল নিতে পারে দলটি।
অন্যপক্ষ মনে করে ভোট সময়মত হবে না। শেষ পর্যন্ত আমেরিকার প্রভাবে সামরিক বাহিনীর একটি অংশ, কোন একটা উপায়ে ভোট বানচালে ভূমিকা রাখবে। ভারতকে ঠেকাতে চীনও এই ষড়যন্ত্রে থাকতে পারে, এমন কথাও বলাবলি হচ্ছে। তারা মনে করছেন ২০০৭ সালে ২২ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ যেমনটা শেষ সময়ে ভোট থেকে সরে দাঁড়িয়ে ছিলো, বিএনপিও এবার সেই কৌশল নিয়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলবে। এটা সত্য, জাতীয় নির্বাচনের আগে এদেশে বিদেশী দুতাবাসের তৎপড়তা বরাবরই বেড়ে যায়। সেই সাথে সামরিক বাহিনীর একটি অংশেও থাকে তোড়জোড়। তাই দ্বিতীয় পক্ষের এই মতকেও ফেলে দেয়া যাচ্ছে না। অর্থাৎ সার্বিক বিশ্লেষণ আগামী তিন মাস দেশের পরিস্থিতি ঘোলাটে থাকারই ইঙ্গিত দিচ্ছে।