শাহেদ ইকবাল
ডেটলাইন ঝিনাইদহ। ১১ এপ্রিল ২০২০। ফরিদপুর থেকে করোনা সন্দেহে মৃত এক ব্যক্তির লাশ এসেছে। লাশ গ্রহণ, দাফন ও জানাজা পড়াতে কেউ রাজি হচ্ছে না। জেলা প্রশাসক সরোজ কুমার নাথ নিজে উপস্থিত থেকে সবকিছু সম্পন্ন করলেন। ঝিনাইদহের উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো: বদরুদ্দোজা শুভ ইমাম হয়ে জানাজার নামাজ পড়ালেন।
ডেটলাইন ঢাকা। ২২ এপ্রিল ২০২০। গলাচিপা নিবাসী গায়ত্রী দেবী বৈশাখী (৪৮) মুগদা হাসপাতালে করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন। কেউ লাশ নিতে এলো না। নারায়ণগঞ্জের কাউন্সিলর মাকছুদুল আলম খন্দকার এগিয়ে এলেন। লাশ গ্রহণ করলেন। নারায়ণগঞ্জের কেন্দ্রীয় শ্মশানে নিয়ে ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে তাঁকে দাহ করলেন।
ডেটলাইন নারায়ণগঞ্জ। ২৬ এপ্রিল ২০২০। একজন হিন্দু ব্যবসায়ী করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন। মৃত্যুর আগে পানি চেয়েও পাননি। নিজ বাড়ির সিঁড়িতে লাশ পড়ে আছে। এবারেও মাকছুদুল আলম এগিয়ে এলেন। ওই ব্যক্তির শেষকৃত্য সম্পন্ন করলেন। নিজ হাতে ওই ব্যক্তির মুখাগ্নিও করলেন!
ডেটলাইন বরিশাল। ২৫ এপ্রিল ২০২০। উজিরপুরের মানসিক ভারসাম্যহীন ইদ্রিস জমাদ্দার (৫২) মারা গেছেন। লাশ পড়ে আছে বৃষ্টিভেজা রাস্তায়। করোনা আতঙ্কে কেউ আসছে না। উজিরপুর মডেল থানার ওসি জিয়াউল আহসান এগিয়ে এলেন। লাশ উদ্ধার, জানাজা ও দাফনের ব্যবস্থা করলেন। ওই গ্রামে মুসলমানদের কবরস্থান নেই। তাই লাশ দাফনের জন্য স্থানীয় সুশান্ত হালদার নিজের ব্যক্তিগত জমি দান করলেন!
ডেটলাইন দক্ষিণ রাঘবপুর,পাবনা। ১১ জুন ২০২০। খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের জেমস সুব্রত গোস্বামী করোনায় মৃত্যুবরণ করেছেন। মরদেহ সৎকারের জন্য কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। এগিয়ে এল বেসরকারি সংস্থা কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন। খ্রিস্টিয় রীতিনীতি মেনে জেমস সুব্রত গোস্বামীকে কবরস্থ করা হলো। এভাবে করোনাকালে কোয়ান্টামের দাফনসেবা এক হাজার ছাড়ালো!
ডেটলাইন চট্টগ্রাম। ১০ জুন ২০২০। জয়ন্ত বড়ুয়ার লাশ পড়ে আছে বহদ্দারহাট পুকুরপাড়ের নিজ বাসায়। করোনা আতংকে মরদেহ সৎকারে কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। বেসরকারী সংস্থা আল মানাহিল এগিয়ে এলো। প্রথমে জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে লাশটিকে গোসল করালো। তারপর নিজস্ব এ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে গেল কাতালগঞ্জ মন্দিরে। সেখানে ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে মৃত ব্যক্তির শেষকৃত্য সম্পন্ন হলো।
ডেটলাইন শ্রীমঙ্গল। ৩০ এপ্রিল ২০২০। মধ্যরাতে প্রসব বেদনায় ছটফট করছেন একজন অসহায় নারী। সাহায্যকারী কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। খবর পেয়ে ছুটে এলেন র্যাব-৯ এর কোম্পানী কমান্ডার আনোয়ার হোসেন শামীম। নিজে কোলে করে প্রথমে গাড়িতে,পরে হাসপাতালে পৌঁছে দিলেন। রোগীর পরিবারের জনৈক সদস্য ফেসবুকে লিখলেন,’এই রকম মানুষও কি পৃথিবীতে আছে?’
বিডি ক্লিন ও বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনসহ বহু স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান অসহায়, বিত্তহীন, ছিন্নমূল ও অভুক্ত পরিবারকে খাদ্য সহায়তা দিতে মাঠে নেমে পড়লো। সীমিত পুঁজি, সীমিত জনবল ও প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তারা নিরন্ন মানুষকে খাবার পৌছে দিতে শুরু করলো। ‘সংযোগ বাংলাদেশ’ ও আরও কিছু প্রতিষ্ঠান বিনামূল্যে কিংবা নামমাত্র মুল্যে জনগণের মধ্যে মাস্ক ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার বিতরণ করতে লাগলো।
শেরপুরের ঝিনাইগাতীর ৮০ বছর বয়সী ভিক্ষুক নাজিমুদ্দিন তাঁর আজীবনের সঞ্চিত ১০ হাজার টাকা কর্মহীন মানুষের খাদ্য সহায়তায় উপজেলা প্রশাসনের ত্রাণ তহবিলে দান করলেন!
এই ঘটনাগুলি এমন একটি সময়ের, যখন করোনা সন্দেহে নিজের মাকে তার সন্তানেরা রাতের অন্ধকারে টাঙ্গাইলের সখীপুরের জঙ্গলে ফেলে গেছে। এক কলেজশিক্ষকের লাশ অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামাতে ও দাফন করতে তার নিজের আত্মীয়স্বজনেরা বাধা দিয়েছে। রংপুর মেডিকেল থেকে মেয়ের লাশ নিয়ে কৃষক পিতা বাড়ি ফিরতে পারেননি; স্থানীয় প্রভাবশালীর হুমকিতে পোশাককর্মী মেয়ের লাশ তিস্তায় ভাসিয়ে দিয়েছেন। করোনার হাসপাতাল নির্মাণে মানুষ বাধা দিয়েছে; কবরস্থান নির্মাণে বাধা দিয়েছে। আরও অসংখ্য জায়গায় আপনজনের লাশ ফেলে মানুষ পালিয়ে গেছে।
আজ হোক কাল হোক, একদিন নিশ্চয়ই করোনা মহামারী বিদায় নেবে। কৃষ্ণপক্ষ কেটে যাবে। জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হবে। পৃথিবী আরও অনেক উন্নত হবে। তখন যদি কেউ স্যাটেলাইট-আকাশ থেকে আজকের পৃথিবীটা দেখতে চায়, কেমন দেখতে পাবে?
দেখতে পাবে বিশ্বজুড়ে ভালোবাসার বদলে ঘৃণা, প্রেমের বদলে হিংসা, সম্প্রীতির বদলে হানাহানি, বিশ্বাসের বদলে অবিশ্বাস, মমতার বদলে সন্দেহ, ফুলের বদলে হেমলক। সেই ঘনঘোর কৃষ্ণমেঘের মধ্যেও তারা নিশ্চয়ই দেখতে পাবে কোথাও কোথাও ঝিকিমিকি আলো জ্বলছে। আজকের এই গল্পগুলোই হলো সেই ঝিকিমিকি আলো।
এই গল্পগুলো বলে দেবে, কিছু মানুষ ছিল মানুষেরও অধিক। কিছু মানুষ হেমলকের বদলে ফুল নিয়ে হেঁটেছিল! কিছু মানুষ মোমবাতির দু’দিকেই জ্বালিয়েছিল! কিছু মানুষ ফুঁ দিয়েছিল বাঁশির উল্টোদিকে! কিছু মানুষ সর্বনাশা ঝড়েও নৌকা ভাসিয়েছিল! অমাবস্যায়ও প্রদীপ জ্বালিয়েছিল! ঈশ্বরের কাছ থেকে ভালোবাসা চেয়ে নিয়ে ফুল,পাখি, নদী ও নক্ষত্রকেও ভালোবাসা শিখিয়েছিল! সূর্যের চেয়েও অনেক বড় সূর্য নিয়ে কিছু মানুষ রাত্রি জেগেছিল!
পবিত্র ধর্মগ্রন্থে আছে, ঈশ্বর যখন মানুষ সৃষ্টি করতে চাইলেন, তখন দেবদূতেরা বলেছিল, “আপনি কি সেখানে এমন কাউকে সৃষ্টি করবেন যে অশান্তি ঘটাবে ও রক্তপাত করবে? অথচ আমরাই তো আপনার পবিত্র মহিমা ঘোষণা করি।”
তখন প্রতিপালক বলেছিলেন, “নিশ্চয়ই আমি জানি, যা তোমরা জান না।” (পবিত্র কোরান, ২ঃ৩০)।
তারমানে কি?
তারমানে উপরের স্বর্ণালি গল্পগুলো শুধু ঈশ্বর জানতেন! আর কেউ জানতো না! কেন জানতো না?
সেটা হয়তো এ কারণে যে, ভালোবাসা বোঝে শুধু মানুষ ও ঈশ্বর। অন্য কেউ নয়। তাই তো ভালোবাসার জন্য ঈশ্বরকে সাক্ষী মানা হয়। কবি যেমন বলেছেনঃ
‘কতবার যে আমি তোমাকে স্পর্শ করতে গিয়ে
গুটিয়ে নিয়েছি হাত-সে কথা ঈশ্বর জানেন।
তোমাকে ভালোবাসার কথা বলতে গিয়েও
কতবার যে আমি সে কথা বলিনি
সে কথা আমার ঈশ্বর জানেন।
আমার ঈশ্বর জানেন- আমার মৃত্যু হবে তোমার জন্য।
তারপর অনেকদিন পর একদিন তুমিও জানবে,
আমি জন্মেছিলাম তোমার জন্য। শুধু তোমার জন্য।’
(শুধু তোমার জন্য- নির্মলেন্দু গুণ)
করোনা চলে যাক। কৃষ্ণপক্ষ কেটে যাক। পৃথিবী বদলে যাক। কিন্তু এই গল্পগুলো জেগে থাক নক্ষত্রের তলে।