নরেশ মধু
পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচন পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী রাজনৈতিক চালচ্চিত্র নিয়ে বেশ কৌতূহলি ছিলাম এবং এখনও আছি। কৌতূহলের কারণ ১. পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত এবং রাজনৈতিক প্রভাব বাংলাদেশের রাজনীতিকে প্রভাবিত করে ২. ১৯৭১ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গেরে বর্তমান স্লটলেক তৎকালীন লবনহ্রদ ক্যাম্পে ৯ মাস অবস্থান ও ভারত সরকারের অন্নজল গ্রহণ।এছাড়া সর্বোপরি আমি যেহেতেু সুদীর্ঘ দিন সংবাদপত্রের সঙ্গে জড়িত তাই রাজনৈতিক সচেতন।
নির্বাচন পূর্ববর্তী দলবদলের হিড়িক দেখে মনে হলে যেন পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে নতুন কোন আলাউদ্দিনের চেরাগের আর্বিভাব। লিখতে গিয়েই একটা পুরোনো গল্প মনে হল। আমি তখন নবম শ্রেণির ছাত্র। আমাদের সময়ে বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রদের ইলেক্টিভ ম্যাথ পড়ানো হতো। কঠিন বিষয় মাথায় ঢুকে না। বাধ্য হয়েই বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষকের দ্বারস্ত হই। আমার শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষক মধুসূধন মজুমদার মহোদয়ের দ্বারস্ত হই। আমরা তিন বন্ধু ইলেক্টিভ ম্যাথ পড়তে যাই। শীতের সকালে স্যারের উঠোনে কাঁচা রোদে আমরা তিনবন্ধু পড়ছিলাম। সহসাই একজন এসে জিজ্ঞেস করলেন আমাদের শিক্ষককে, ‘মধুসূধন তোমার ছাত্ররা কে কেমন?’ স্যার হেসে বললেন আমার তিন ছাত্র তিন ধরনের। এক জন খুব দ্রুত সব কিছু সহজেই বুঝে কিন্তু স্থায়ীত্ব খুব বেশি দিন নয়। অপরজন বুঝে তবে সহজেই নয়। জেনে শুনে তবে? এর স্থায়িত্ব দীর্ঘ দিন। অপরজন সহজেই বুঝে না। অনেক কষ্ট করে তাকে বোঝানো হয়। এবং সে যা বোঝে ভোলে না।”
আমার একটি বদ্ধমূল ধারণা ছিল ভারতের রাজনীতিকদের প্রতি। আমি নেতাজী সুভাষ, জ্যোতিবসু, দেশবন্ধু চিত্ত রঞ্জন দাস, আবুল কালাম আজাদ, বিধান বাবুসহ অনেকেরই জীবনী পড়েছি। যতবার পড়েছি শ্রদ্ধায় বার বার মাথা অবনত করেছি। ভেবেছিলাম যদি দেশপ্রেমীক আদর্শবান নেতা ভারতেরই আছে। আমাদের দেশের মত স্বার্থপর দলবদলনেতা নেই। আমাদের দেশের নেতাদের মত জনগনের টাকা বিদেশি ব্যাংকের তহবিল সমৃদ্ধ করে না। জনগনের সঙ্গে প্রতারনা করে না। ২০১৯ সালে ভারতে যাই। ভারতে গিয়ে সাধারণ অটোওয়ালাদের সঙ্গে চলতি পথে রাজনীতিক নেতাদের সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেছি। ঐ যে স্বভাব যায় না মরলে। সাংবাদিকতা যে বোধ ও মননে, তাই খুটে খুটে বিভিন্ন কথা জেনেছি। শুনেছি প্রতারণার বিভিন্ন ফাঁদের গল্প। তবে আমাদের দেশের সরকারদল কখনও কোন প্রকল্পের ফাঁদে জনগনকে ঠকায়নি। ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকা নেই, শেয়ারবাজারের টাকা নিয়ে উধাও, ঘুষের টাকায় বিলাস বহুল বাড়ি, গাড়ি, নারী ও বিদেশে পাড়ি জমানো এসব ঠিক আছে। আমাদের দেশের ছাত্র রাজনীতিতে কোটি কোটি টাকার মালিক সব হচ্ছে। আমরা বাংলাদেশ দুর্নীতির মহা সমুদ্রে বাস করি। ভারতের নেতাদের দেখে মাঝে মাঝে নিজেদের বড় দোষী মনে হত। কিন্তু এখন আর হয় না।
মূল্য ও নীতিবোধের চরম অবক্ষয় ঘটেছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে যারা স্বৈরাচারী সরকারের আনুগত্য স্বীকার করেছিলেন সে দিন। বাঙালির বড় মূল্যবোধের পরাজয় সেদিন ঘটেছিল। হয়ত বা তারও যুক্তি আছে। কিন্তু সম্প্রতি সময়ে ভারতের দলবদলুদের দলবদলের হিড়িক , মূল্যবোধের পরিচয় সত্যি রাজনীতিক পরিমন্ডলে বড় ধরনের নৈতিক বিপর্যয়। মুকুল বাবু, শুভেন্দু, রাজীবসহ তাবড় তাবড় নেতাদের দলবদল –ঘরে ফেরা সত্যি রাজনীতিক মূল্যবোধ ও নেতাদের আর্দশ প্রশ্নবিদ্ধ। ভারত উপমাদেশে রাজনৈতিক সুতিকাগার হিসেবে ভারতকেই গণ্য করা হয়। ভারতের রাজনৈতিক আদর্শকে অনেক দেশই আদর্শ হিসেবে মনে করনে। সেই ভারতবর্ষের রাজণীতিকদের আদর্শ ও মূল্যবোধ দেখে কষ্ট হয়।
আমি প্রতিদিনই ভারতের কয়েকটি দৈনিক পত্রিকার অনলাইন সংস্করণ পড়ি। পড়ছিলাম চন্দনা বাউরি জীবন কথা। নুন আনতে পান্তা ফুরানো সংসার চালান চন্দনা বাউরি। পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার শালতোড়া বিধানসভা এলাকার স্বামীর সঙ্গে কাজের যোগান দিয়ে দুজনার আয় দিয়ে সংসার চালিয়ে জনগনের জন্য ভাবা সত্যি যেন মেরুকরনের দুদিক। আলো আধাঁরির খেলা। যেন চন্দ্রগ্রহণ আর সূর্যগ্রহণ এই আকাশে। এক অর্থ মান যশ ইত্যাদির নেশায় রাজনীতি অপরদিকে জনগনের সেবায় আত্মনিয়োগ। এক দিকে ভোগ অপরদিকে ত্যাগ। চন্দনা বাউরির প্রতিদিনের আয় ২৫০ টাকা । স্বামী শ্রবণের প্রতিদিনের আয় ৪০০ টাকা। প্রতিদিন যার সর্বমোট আয় ৬৪০ টাকা তিনি ভাবতেই পারেন বিধায়কের বেতনের এত টাকা দিয়ে তিনি কী করবেন। জানেনও না প্রতি মাসে ঠিক কত টাকা বেতন বা ভাতা বাবদ পাবেন। সেই অঙ্কটা শোনার পরে চন্দনার গলায় আবার অন্য ভাবনা। এত টাকা কী করে খরচ করবেন সেটাই ভেবে উঠতে পারছেন না। তবে মনের কথাটা বলেই ফেললেন, ‘‘কী করব এখনও ভাবতে পারছি না। কিন্তু মানুষের জন্য ভাল হয় এমন কিছুই করব প্রথম মাইনের টাকায়। তার পরেও মাইনের টাকা ওই কাজেই লাগাব। অত টাকা তো আমাদের লাগবে না।’’
সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে পাল্টা প্রশ্ন চন্দনার – ‘‘আচ্ছা, মানুষের জন্য যদি ভাল কিছু করতে চাই, তবে কী কী করা যায় বলুন না।’’ একটা অ্যাম্বুল্যান্স কিনতে পারেন। গরিব মানুষের কাজে লাগবে। বোঝা গেল একসঙ্গে অনেকগুলো অচেনা শব্দ শুনেই চুপ করে গেলেন চন্দনা । তার পরে বললেন, ‘‘আমাদের এমপি ডাক্তারবাবুকে (সুভাষ সরকার) বরং জিজ্ঞেস করব।’’ (আনন্দবাজর সূত্র)।
বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন এবং রাজনীতির দর্শণ এবং একজন চন্দনা বাউরি বনাম মুকুল-শুভেন্দু দর্শন এবং রাজনীতি কোন মেরু করণের ইঙ্গিত বহন করে?