নরেশ মধু
বহুল প্রচলিত প্রবাদ, সময় এবং নদীর স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না। সত্যি তাই। প্রতিদিনের সূর্য নিয়ম করেই উঠে। আবার অস্ত যায়। পৃথিবীর যাবতীয় সমস্যা উপেক্ষ করে প্রকৃতি তার আপন খেয়ালে মত্ত। সারাবিশ্ব যখন করোনাভাইরাস জ্বরে আতংকিত। তখনও সূর্য তার আপন গতিতে নিয়ম করেই চলছে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে খবর নিচ্ছিলাম দূর-প্রবাসের বাল্যবন্ধুদের আত্মীয়-স্বজনদের, কে কেমন আছে। বিকাশ বালা ছোট বেলার বন্ধু, আমেরিকা প্রবাসী বাঙালি। থাকে নিউ ইর্য়ক শহরের ক্যুইন্স জ্যামাইকাতে। এ পর্যন্ত খবরে যা চাউর আমেরিকার সব থেকে বিপর্যস্ত এলাকার মধ্যে ক্যুইন্স জ্যামাইকা ও জ্যাকসন হাইট অন্যতম। যেখানে বাঙালিদের বসবাস বেশি। বাঙালি মানেই অবাধ গতি। মনে প্রাণে রবি ঠাকুরের আর কোন কথা মনে না রাখলেও মেনে নিয়েছে , ‘আমরা সবাই রাজা, আমাদেরই রাজার রাজত্বে’ গানটি। বাঙালি বরাবরই খোলামেলা ফলে করোনার ভালবাসা পেতে কষ্ট হয়নি। দুটি এলাকাতেই মৃত্যুহার বেশি। প্রতিদিনি মানুষ মরছে। এ পর্যন্ত সংখ্যায় মৃত ৪৬ থেকে ৪৭ জন এবং এরা বাঙালি।
রোগীর তুলনায় চিকিৎসা ব্যবস্থা অপ্রতুল। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সরবরাহ প্রয়োজনের তুলানায় কম। মাক্স, হ্যান্ড সেনিটাইজার বাজারে নেই। দিন দিন কর্মবিমূখ মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। খাদ্য সংকট তীব্র । অপরদিকে উর্ধ্বগতি দ্রব্যমূল্য। সরকার যা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে তা মিলছে না। আমার দিদি শুক্লা গাঙ্গুলী, গত কয়েকদিন গৃহবন্দি। মজুদ খাদ্য প্রায় শেষ। খাদ্য সংকটের জন্য একবেলা ভাত খাচ্ছে। যা-ও-বা আছে তা ফুরিয়ে গেলে কি হবে এই আশঙ্কায় প্রহর গুণছে। আমার প্রাণপ্রিয় ছোট ভাই স্বাধীন এই সবেমাত্র আমেরিকা পৌঁছাল। গিয়েই গৃহবন্দী। বোবা কান্নায় ওর ভেতর-বাহির দুই একাকার। বন্ধুহীন নিঃসঙ্গতা সঙ্গে সদ্য পিতৃবিয়োগ। সব দুঃখ বেদনা যেন ওকে গ্রাস করছে। বন্ধু জয়ন্ত আমেরিকা পুলিশের চাকরি করে। প্রতিদিনই ওর সঙ্গে কথা হয়। মাঝে মাঝে শহরের বর্তমান চালচিত্রের ছবি দেখায়। জনমানবহীন শহরে সারি সারি গাড়ি। গাছগুলো কেমন দৃষ্টিহীন। সমস্ত আকাশ গুমড়োমুখো । যেন এক অদ্ভুদ পৃথীবিতে বাস করছি। সুকান্তের প্রতিশ্রুতি আজ ম্রিয়মান। তোমার রেখে যাওয়া পৃথিবী আর শিশুর বাসযোগ্য নেই সুকান্ত।
একবারে অলস সময় পার করছি তা নয়। পেশাগত কারণে প্রতিদিন দু-একবার বাইরে যেতে হয়। সঙ্গে সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে কিছু সেবামূলক কাজ। বাড়িতে নিরাপত্তার চাদর বেশ কঠিন। বাইরে থেকে ঘরে ঢুকলেই হাত-মুখ ভাল করে পরিস্কার করে নিতে হয়। সন্ধ্যায় পুলিশের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা কীটস্ দিলেন। সাবধানতার যেন কোন কমতি নেই। তবুও বাঙালি যেন বাংগাল থেকেই যাচ্ছে, যতক্ষণ-না পুলিশের লাঠি পিঠে উঠবে, ততক্ষণ ঘরমুখো হবে না। এই অলস সময়টা পুরেনো কাগজ-পত্র নেড়ে-চেড়ে বারবার দেখি। এই দেখার মাঝে ২০০৭ সালের কিছু পুরোনো কাগজ পাই। ২০০৭ সালে ডিসেম্বরে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় ওষুধি গাছের গুরুত্ব শিরোনামে ২ দিনের জাতীয় সম্মেলনের অয়োজন করি। আমার বন্ধু সরদার আরফি অগ্রভাগে , একশন এইডের আর্থিক সহায়তায় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ঐ সময় বেশকিছু সাংবাদিককে এই কাজের জন্য ফেলোশীপ দেওয়া হয়। ভারত-বাংলাদেশ মিলে প্রায় ৩০০ কবিরাজ, হোমিও চিকিৎসক ও উন্নয়নকর্মী অংশগ্রহণ করেন। বেশ কিছু বিশিষ্ঠজন তাদের লেখা উপস্থাপন করেন। শিরোনামেই বিষয়টি পরিস্কার। এরপর বেশ কিছু কাজ হল। বরাবরই চেষ্ঠা করেছি বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবনের জন্য। আমার শ্রদ্ধেয় গুরুজন ডা. রশিদী মাহবুবসহ অনেকের সঙ্গে এ নিয়ে বহুবার কথা হয়েছে। আমার শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষক ড. এবিএম ফারুক স্যার, তিনি এ নিয়ে বেশ কাজ করেছেন। কিন্তু কেন যেন আমাদের হাজার বছরের চিকিৎসা ব্যবস্থায় আস্থা রাখতে পারিনি। খাদ্য যে মানুষের জন্য সব থেকে বেশি নিরাপদ হওয়া প্রয়োজন এই বোধে বোদ্বয় হয়নি বাঙ্গালির কোন কালে। আজও নেই। খাদ্য জীবনের নিয়ন্ত্রক, গাড়ীর তেল না হলে যেমন গাড়ি চলে না, এটি সকলেই বুঝি-জানি আবার এও জানি খারাপ তেলে গাড়ি নষ্ঠ। কিন্তু খারাপ খাবারে দেহ নষ্ঠ এটি কখনই আমরা বুঝতে চেষ্টা করিনি। আমাদের চারপাশে হাজার হাজার রকমের গাছ ছড়িয়ে আছে যার ওষুধি গুণাগুণ আমরা জানি না। ২০০৬ সালে দৃক গ্যালারিতে ওষুধি গাছের একক চিত্র প্রদর্শনী করা হয়। এটি সম্ভবত বাংলাদেশে প্রথম। দর্শকদের মন্তব্য গাছের এত ঔষধি গুণ সত্যি আমরা জানি না। আমদের হাতের কাছে , রাস্তার দুই পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে হরেক রকমের ঔষধি গাছ, যা আমরা চিনি না। প্রকৃতি তার আসীমতায় সব কিছু রেখেছেন সৃষ্টির উল্লাসে। আজকের বিপ্নতা আমাদের নিজেদের তৈরি। যদিও এর উৎপত্তি নিয়ে বিভিন্ন খবর বাজারে চাউর।
প্রকৃতি তার নিজস্ব চলনে ভারসাম্যতা নিয়ে চলার গতি যখন হারিয়ে ফেলে তখন বিপর্যয় অনিবার্য। আমরা প্রকৃতির সঙ্গে প্রতারণা করেছি। আমাদের নদীগুলো শুকিয়ে কাঠ। প্রতিদিন জলের বিশুদ্ধতা নষ্ঠ করে ফেলছি। শুস্ক মরুভূমিতে রুপান্তরিত নদীগুলো। বিলুপ্ত সব প্রজাতির পশু-পাখি। ষড়-ঋতুর দেশ কখন যে কোথা দিয়ে পালিয়ে যায় খুঁজেও পাওয়া ভার। ঋতু বৈচিত্রের সঙ্গে আমাদের জীবন যে নিয়ন্ত্রিত সেটি ভুলে যেতে বসছি। জোয়ার-ভাটা, অমাবস্যা পূর্নিমাতে শরীরের ওপর যে প্রভাব পড়ে তাকে অস্বীকার করি কিভাবে? নদী শূন্যতায় জোয়ার-ভাটা নেই। প্রকৃতির ওপর প্রতিদিনের অত্যাচার আমাদের প্রতিরোধে ক্ষমতা বিলুপ্ত। তাই সামান্য সর্দি-জ্বর হলেই আমরা বিধ্বস্ত। যেমন হারিয়ে ফেলেছি প্রতিবাদের ভাষা, তেমনি ক্ষয় করেছি প্রতিরোধের সক্ষমতা। শরীরের যেন সেই কাঠামো নেই। খেলার মাঠ, সাঁতার কাটার পুকুর কোথায় হারিয়ে ফেলেছি। নগর সভ্যতা আমাদের অনেক দিয়েছে আবার অনেক নিয়েছে।
ইতিমধ্যে জীবন-জীবিকায় মানুষের সাধারণ বোধ কাজ করছে না. বা এটাকে লোভী বলব না সঞ্চয়ী বলব , ঠিক শব্দ গুছিয়ে উঠতে পারছি না। সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধান বারবার বলছেন, সবাই নিজের ঘরে থাকুন। নিজেকে নিরাপদ রাখুন অপরকেও নিরাপদে রাখুন। একদিকে সরকার বলছেন লকডাউন, অপরদিকে টিসিবির পণ্য ট্রাকে ঢলাঢলি। গায়ে গায়, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সারি সারি করে পণ্য কিনছি। কোথায় সামাজিক দুরত্ব, কোথায় নিরাপদ হোম!
প্রসাশনকে জানালে বলেন, ‘সরকারের দায় সকলকে খাবার পৌঁছে দেওয়া। যদি বন্ধ করে দেই তাহলে সাধারণ মানুষ কিভাবে বাঁচবে ?’ একদিকে লাঠি-পেটা করে ঘরমুখো করা অপরদিকে ঈদ উৎসবের মত বাজার করা। প্রতিটি শহরের বড় বড় বাজারে ভিড় ঠেলে ভেতরে যাওয়া কঠিন। একটু আগেই কথা হল বগুড়া ট্রাফিক পুলিশের পুলিশ সুপারের সঙ্গে। তিনি তথ্য দিলেন ঈদের সময় সিরাজগঞ্জ হাটিকুমরুল দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ১৭ হাজার ছোট-বড় মিলিয়ে পরিবহন চলে আর সেখানে ২৪ তারিখ প্রায় ২১ হাজার গাড়ি চলেছে। ঐ দিনের চিত্র আমাদের সভ্যতার সচেতনতার চরম অবমাননার চিত্র।
ফিরে আসি প্রসঙ্গে। করোনা বিষয়ে এখন পর্যন্ত বিজ্ঞান সঠিক কোনো পথের দিশা আমাদের দেননি। নানাজনের নানান কথায় কান ভারি। নিশ্চয়ই আমরা এই পথ পাড়ি দিয়ে লক্ষ্যে পৌঁছাবো। কিন্তু যেন ভুলে না যাই প্রকৃতির দান, অবহেলা আর অত্যাচারের বিরুপ ফলাফলের কথা। ইতিমধ্যে আমেরিকার গাছে গাছে নতুন কুড়ি, নতুন ফুল আসছে। নিশ্চয়ই নতুন করে আবার সূর্য উঠবে। প্রতিদিনের খাবারে খুঁজে বেড়াব সেই অমিত শক্তি যা আমাদের প্রতিরোধ ও প্রতিকারের শক্তি যোগাবে। নিরোগ ক্লান্তহীন একটি শরীর আমাদের প্রকৃতির সঙ্গে আলিঙ্গনে নিবিড়তা বাড়াবে। শেষ করব রবি ঠাকুরের কয়েকটি পংক্তি দিয়ে- ‘দুঃখের তিমিরে যদি জ্বলে তব মঙ্গল-আলোক , যদি জ্বলে, তবে তাই হোক। তবে তাই হোক। দুঃখের তিমিরে যদি জ্বলে, মৃত্যু যদি কাছে আনে তোমার, অমৃতময় লোক, তবে তাই হোক।’
সাংবাদিক ও কলামিস্ট