আকতার হোসেন
আমার কাছে একটা ছেঁড়া চিঠি আছে। চিঠিটা যার, তার নাম বলা যাবে না। তবে এইটুকু বলছি আমাকে সে ভানুদা বলে ডাকতো। ইচ্ছে করলে আমিও তাকে রানু বলে ডাকতে পারতাম। কিন্তু সে আমার থেকে পঁয়তাল্লিশ বছরের ছোট ছিল না। ছোট’দির স্কুলের মেয়ে ছিল মেয়েটি। ছোট’দির কাছে প্রাইভেট পড়তে আমাদের বাড়ি আসতো। শ্রাবণ মাসের বৃষ্টি মানতো না। মাথায় ছাতা দিতো না। কচু পাতাও না।
প্রথম দিন এসেই মায়ের কাছে গামছা চেয়ে বললো, কাকী’মা তোমাদের গামছাটা ব্যবহার করলাম। গন্ধ শুঁকে বলে দিতে পারি এই তোমার রাজপুত্রের গামছা। ক্ষমা করে দিতে বলো। চুল থেকে কিছু জল গেল উড়ে কিছু রইলো তার গামছাতে।
গলা নামিয়ে বলেনি কিছু বরং গলা উঁচিয়েই বলেছিলো যাতে আমি দোতালার পড়ার টেবিল থেকে শুনতে পাই।
ছোট’দির হাইস্কুলে শিক্ষকতা করতেন। আমি সবেমাত্র কলেজে ঢুকেছি। একবার বৃষ্টির দিনে ছোট’দিকে স্কুলে পৌঁছে দিতে গিয়েছিলাম। মেয়েটি পথে আমাকে দেখে ফেলে। স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী সে। আমার চুল দাড়ি গোঁফ দেখে তার মনে হয়েছিল আমার মধ্যে নাকি রবীঠাকুরের পুনর্জন্ম হয়েছে। এতো ফন্দিবাজ মেয়ে ছিল যে পরের সপ্তাতেই ছোট’দির কাছে প্রাইভেট পড়ার জন্য এসে হাজির। ওদের টাকা পয়সা ছিল বেশ। বলা যায় আমাদের মহল্লার সবচাইতে ধনী পরিবার। এদিকে ছোট’দির টাকা পয়সার টান ছিল। বিয়ে করবে বলে পয়সা জমাচ্ছিল। সপ্তাহে দুই তিনদিন আসতো আমাদের বাড়ি।
প্রথম প্রথম বড় বিরক্ত বোধ করতাম। অমন সুন্দরী মেয়ে কী করে যে এত বেয়ারা হয়! চট চট করে কথা বলতো। সবাইকে এমন করে কাকা কাকী ডাকতো শুনে মনে হতো এ বাড়িরই মেয়ে। রন্ধনশালায় বসেও মায়ের সঙ্গে গল্প করতো। বাড়ির কেউ ভয়ে আমার সঙ্গে কথা বলতো না আর এই মেয়ে প্রথম দিনেই আমার গামছা ব্যবহার করে ফেললো। দ্বিতীয় দিনে ওপরে উঠে এসে আমাকে লুচি ভাজা দিয়ে গেল। মা বিকেলের নাস্তা বানিয়ে নিয়ে আসছিলেন অথচ তার হাত থেকে কেড়ে নিয়ে বললো, কাকী’মা বাতের ব্যথা নিয়ে ওপরে উঠতে যাবেন কেন আমি আপনার রাজপুত্রকে দিয়ে আসি আর আপনাদের ওপরতলাটাও একটু দেখে আসি। ওপর তলার সিঁড়ির পাশেই আমার ঘর। একটা ইউ শ্যেপের বাড়ি ছিল আমাদের। মাঝখানে বিরাট একটা ফাকা যায়গা। তুলসী গাছাটা ওপর থেকেই দেখা যেত।
এভাবেই কারণে অকারণে ওপরে চলে আসতো সে। সুতি শাড়ি পরে আসতো। পিঠের ওপর আঁচল ফেলে রাখতো ঝুলিয়ে। চুলে বেণী করতো। ধনীর আদুরে কন্যা সে জন্য ফরাসী সৌরভ মেখে আসতো। ওর বয়সে অনেকে যা করে না, সে তার সবই করতো। এমন কি আমার পড়ার টেবিলে না বসে মাঝে মাঝে খাটে এসে বসে পড়তো। কতক্ষণ আর সোজা হয়ে বসে থাকা যায়। যেদিন দেরি করে যেত বালিশে হেলান দিতো। বুকের নিচে বালিশে চেপে পা দুটো উঁচু করে দোলাতো। ভানুসিংহের রানুর মতো বলতো, ‘আমি আর বিয়ে করবো না। আমার তো বিয়ে হয়ে গেছে’। মা ইচ্ছে করে ওকে মেনে নিয়েছিলেন। ছোট’দিও। এমনকি শ্বশুরবাড়ি থেকে বড়’দি এলেও ওর সঙ্গে বেশ জমে যেত। বশীকরণ সমিতিতে আমিও কখন সদস্য হয়ে গেলাম তা আজ আর বিশেষ মনে করতে পারছি না।
একদিন কিছু পেয়ারা নিয়ে ঢুকলো। ওদের বাড়িতে দুটো পেয়ারা গাছ ছিল। একটিতে বেশ মিষ্টি পেয়ারা হতো। এসেই বললো, কেমন আছো ভানু’দা? বলা বাহুল্য ততোদিনে সে আমাকে তুমি বলতে শুরু করে দিয়েছে।
আমি তখন বড় বড় লোকের ভাবনা জগত নিয়ে লেখা বই পড়তাম। আমার নিজস্ব জগতেও কিছু কিছু ভাবনা দাঁড়াতে শুরু করেছে। ওকে বললাম – ভালোতে আছি।
সে কেমন কথা ভানু’দা? লোকে বলে ভালো আছি আর তুমি বলছ ভালোতে আছি। ব্যাখ্যা কর।
আমি বললাম, পৃথিবীতে কেউ মন্দ থাকার কথা নয়। কারোর অভাব থাকার কথা নয়। কারোর দরিদ্র হবার কথা নয়।
সে কেমন?
দেখো, মায়ের পেট থেকে পড়ার পর আমাদের কোন জিনিশটার অভাব পেয়েছি? মায়ের পেটে আলো ছিল না অথচ পৃথিবীতে আলোর অভাব নেই। মহাজগত আঁধারের মধ্যে আছে আমরা পৃথিবীর মানুষ থাকি আলোতে। বাতাসের মধ্যে এমন কোন গ্যাসের অভাব নেই যা না পেলে আমরা মরে যেতাম। ভেবে দেখ এক মিনিটে আমরা কতবার শ্বাস নেই? সে হিসেবে দিনে কতবার আমাদের শ্বাস নিতে হয়? শুধু আমি নই, তুমিও শ্বাস নিচ্ছ। পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ শ্বাস নিচ্ছে। বাতাসে কোন বিষ নেই যে বিষ আমদের ভেতরটা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়। আবার মাটির ওপর জন্ম নেয় কত রকম ফল ফুল খাদ্য। পানির জন্য রয়েছে নদী। রাতের অন্ধকার দূর করতে আকাশের তারা। এতসবের পরও অনেক মনে করে তারা অভাবের মধ্যে আছে। আমি তা মনে করি না। আমি বলি, ভালোতে আছি।
এই কথাগুলো ও খুব পছন্দ করতো। আমাকে নিয়ে ওর শুধু একটাই আপত্তি ছিল, ঘরে ঠুকেই ও আমাকে পড়ার টেবিলে পেত। আমার জামার দুটো বোতাম লাগিয়ে দিয়ে বলতো বুকে লোম নেই তো বোতাম খুলে রাখ কেন?
একদিন এক টুকরো কাগজ নিয়ে এসে বললো আমার কিছু প্রশ্ন আছে কিন্তু উত্তরের যায়গাগুলো ফাঁকা। তুমি উত্তরগুলো লিখে দিবে ভানু’দা? আমি বললাম কেন? এসব দিয়ে কী হবে?
ও বললো, এটা আমার সখ। মানুষ কী পছন্দ করে নাকরে সেগুলো জানতে আমার খুব সখ হয়।
আমি প্রশ্নগুলো দেখলাম। লিখলাম উত্তরগুলো। প্রথম দিকের উওর এই যেমন; তোমার প্রিয় পানীয় কী? তোমার প্রিয় ফল কী? এসবের ঠিক ঠিক উওর দিলেও একবার ওর সন্দেহ হলো। সে বুঝতে পারলো শেষের দিকে আমি হয়তো কিছু ইচ্ছের কথা লিখছি। যাকে বলে চিঠি। ওর ধৈর্য কুলাল না। চট করে কাগজটি টেনে দিলো ছুট। ও নিয়ে গেল সবটাই কিন্তু আমার হাতে রয়ে গেলো এক টুকরো ছেড়া অংশ। তাতে প্রথম প্রশ্নের উওর লেখা, কোকাকোলা।
এর কিছুদিন আগে এসে চুপচাপ বসে ছিল। যাবার কথাটি বলছে না। এদিকে সন্ধ্যা হয়ে আসছে। আমি বললাম তুমি যাবে না? সে বললো, আমি তো যাব না। থেকে যেতেই এসেছি। তোমার চোখে চোখে থাকবো। চেয়ারটা হয়তো শূন্য হয়ে যাবে কিন্তু তবুও আমি রয়ে যাব তোমার এই পড়ার টেবিলে। না-দেখা মানুষ দেখতে পারবে না ভানু’দা?
আমি জানতাম না কিংবা এখনো জানি না সে কি জানতো তার বাবা ইণ্ডিয়া চলে যাবার জন্য গোপনে গোপনে সবকিছু ঠিক করে ফেলেছে। নাকি ওর নিজের মনের মধ্যেই কোন ভয় ঢুকে গিয়েছিল। হয়তো উড়ো কথা থেকে কিছু আন্দাজ করতে পেরেছিল। যাইহোক, যেদিন ছেঁড়া কাগজ নিয়ে পালালো পরেরদিন সকালে ওদের বাড়িতে খাঁ সাহেবের লোকজন এসে উঠে পড়ল। আমাদের পাড়ায় বিরাট পরিবর্তন করে দিলেন খাঁ সাহেব। ধীরে ধীরে বদলে গেল সমস্ত মহল্লা। আমাদের ইউ শ্যেপের দোতালা বাড়িটা এখন দশ তলা হয়েছে। বাড়ির নাম সেলিনা মঞ্জিল।
মৃত্যুকে আমি ভীষণ অপছন্দ করি। মানুষের মৃত্যু হলে অনুভূতি শেষ হয়ে যায়। কষ্ট নিয়ে কী সুন্দর বেঁচে আছি অথচ সামান্য মৃত্যু আমাকে সেই কষ্ট পাবার আনন্দ থেকে বঞ্চিত করে দিবে। যার আগমন অনুভূতির জগত অন্ধকার করে দেয় তাকে কীভাবে বলা যায়, ভালোতে আছি। তখনই বোধ হয় বলা উচিৎ – ভালো নেই।