ফারুক আহমেদ
প্রতিটি মাতাপিতা সন্তানের সাফল্যের স্বপ্ন দেখেন। কীভাবে তাদের টপ স্টুডেন্ট বানাবেন, ভালো মানুষ হিসেবে তাদের জীবনে সাফল্য আসবে আপ্রাণ চেষ্টা করেন। এজন্য প্রচুর অর্থ ও সময় ব্যয় করেন তারা।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, আজকের এই নতুন প্রজন্ম সত্যিকারভাবে সে অনুযায়ী সাফল্য বয়ে আনছে কি? চারপাশে একটু তাকালেই বুঝতে পারি, বর্তমানে আমাদের নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা পরিবারের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণে সুযোগ এবং সহযোগিতা পাওয়ার পরও অনেক পরিবারে পিতা-মাতার প্রত্যাশা অনুযায়ী ভালো ফলাফল অর্জন করছে না তারা। অনেক ছেলেমেয়েরা তাদের মূল্যবান সময় এবং এফোর্টসগুলো আনপ্রোডাক্টিভ কাজে নষ্ট করছে।
এর মূল কারণ হলো প্রধানতঃ তিনটি:
(১) তারা তাদের জীবনের সত্যিকারের মূল্য অনুধাবন করছে না,
(২) নিজেদের জীবন ও এর লক্ষ্য সম্পর্কে সচেতন ও সিরিয়াস না এবং
(৩) পরিবার, সমাজ এবং দেশের প্রতি তাদের যে দায়িত্ব ও কর্তব্য আছে তা তারা অনুভব করছে না।
এ ব্যাপারে সবচেয়ে বড় ভূমিকা হলো পিতামাতার। আমরা লক্ষ্য করছি, প্রায় প্রতিটি পিতামাতা তাদের সামর্থ অনুযায়ী সন্তানদের জন্য অনেক টাকা পয়সা খরচ করছেন এমনকি সারাবছর প্রাইভেট টিউশনও নিচ্ছেন। তারপরও অনেকেই পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করছে না, এমনকি মারাত্মক খারাপ রেজাল্টও করছে। এখন প্রশ্ন হলো, এরা কেন পরীক্ষায় খারাপ ফলাফল করছে? এর একটি বড় কারণ হচ্ছে, দুর্ভাগ্যবশত আমাদের অনেক বাবা-মায়েরা কীভাবে আরও বেশি অর্থ উপার্জন, বাড়িগাড়ি এমনকি রাজনীতি ও বিভিন্ন দল নিয়ে এতই ব্যস্ত থাকেন যে, সন্তানদের সত্যিকারের উন্নয়নের দিকে নজর দেওয়ার মতো সময় তাদের নেই বললেই চলে| ছেলেমেয়েদের পিছনে কেবল টাকাই খরচ করছেন কিন্তু খবর নিচ্ছেন না তারা আদৌ পড়াশুনা করছেন কিনা। এমনও দেখা যায়, অনেক মা-বাবারা এতই বেশি ব্যস্ত থাকেন যে, তাদের সন্তানদের সঙ্গে নিয়মিত কথাবার্তা বলার সময়ও পান না, যা এই আধুনিক সমাজে অনেক পরিবারের জন্য এটা একটা বিপদজনক সংকেত! এর প্রতিকার একান্ত প্রয়োজন।
আমাদের প্রতিটি পিতা-মাতাকে ভাবতে ও বুঝতে হবে, আজ আমরা এত কষ্ট ও পরিশ্রম করছি কাদের জন্য? একমাত্র সন্তানদের উন্নতি ও সাফল্যের জন্য। কিন্তু আমরা যদি তাদের জন্য পর্যাপ্ত সময় না দেই, সঠিকভাবে মনিটরিং এবং কাউন্সেলিং না করি, এর ফলে যদি আমাদের কলিজার টুকরা সন্তানরা সঠিকভাবে গড়ে না উঠে, বিপথে চলে যায়, তাহলে এই অর্থ, বাড়িগাড়ি ও প্রতিপত্তি অর্জনে সত্যিকার অর্থে কোনও মূল্য থাকবে কি?
প্রযুক্তি বিকাশের কারণে, বিশেষ করে ইন্টারনেট-এর মাধ্যমে আমাদের অনেক ছেলেমেয়েরা তাদের বাবা-মায়ের অগোচরে অনেক খারাপ বিষয়ে জড়িয়ে পড়ছে। তাদের মূল্যবান সময় ও এফোর্টসগুলো অপব্যবহার করছে আনপ্রোডাক্টিভ কাজে। প্রতিটি পিতামাতাকে এ বিষয়ে নজর দেওয়া জরুরি এবং এর জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া একান্ত প্রয়োজন।
এটা সত্যি যে, এই বিংশ শতাব্দীতে ইন্টারনেট ছাড়া জীবন অচল। তারপরও আমাদের ছেলেমেয়েদের ইন্টারনেট ব্যবহার করার ব্যাপারে তাদের প্রতি নজর রাখা একান্ত দরকার। ইন্টারনেট ব্যবহারের ব্যাপারে ছেলেমেয়েদের জন্য নিয়মানুবর্তিতা তৈরি করে দেওয়া জরুরি। উত্তম হলো, ছেলেমেয়েদের ইন্টারনেট ব্যবহার করার সুযোগ দেওয়া উচিত কেবলমাত্র একটি পরিণত বয়সে, বিশেষ করে যখন তারা হাইস্কুল, কলেজ এবং ইউনিভার্সিটিতে পড়া শুরু করবে এবং তা শুধু ব্যবহার করতে পারবে তাদের পড়াশুনা, গবেষণা এবং জ্ঞান অর্জনের জন্য। আমাদের সন্তানরা ইন্টারনেট যাতে অপব্যবহার না করে সেদিকে খেয়াল রাখা জরুরি। এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ উপায় হলো, অপরিণত বয়েসে তাদেরকে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ না দেওয়া।
গবেষণায় দেখা যায়, যে সমস্ত শিশু/স্টুডেন্টরা দীর্ঘসময় ইন্টারনেট/স্মার্ট ফোন ব্যবহার করে, তাদের সেলফ স্টিম (আত্মসম্মান) অনেক নিম্নপর্যায়ে চলে যায় এবং দীর্ঘ সময় ইন্টারনেট/স্মার্ট ব্যবহারের কারণে তাদের ভিতরে সৃজনশীলতা হ্রাস পায়। তাই আজ বিশেষজ্ঞরা খুব উদ্বিগ্ন। তারা বলছেন, “Too much screen time has been linked to behavior problems and delayed social development in order children। অর্থাৎ দীর্ঘ সময় ইন্টারনেট /স্মার্টফোন ব্যবহারের কারণে স্টুডেন্টদের মাঝে আচরণগত সমস্যা দেখা দিচ্ছে এবং শিশুদের সামাজিক উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে”।
আমাদের জন্য এটা অত্যন্ত জরুরি যে, সন্তানদের প্রতিদিন মনিটরিং করা, তাদের সাথে প্রতিদিন কথা বলা এবং জিজ্ঞাসা করা আজ কে, কী কাজ সম্পন্ন করেছে এবং কোনও ধরণের ইন্টারেস্টিং কিছু আছে কিনা তাদের কাছে। এর সাথে টাইম টু টাইম তাদের সঙ্গে প্রয়োজনীয় কাউন্সেলিংও করা। এতে সন্তানরা মনে রাখবে, আমি কখন কী করছি, কোথায় যাচ্ছি তা আমার আব্বু-আম্মু খবর রাখছে। তাই অপ্রত্যাশিত কিছু করা যাবে না, ভালো করে লেখাপড়া করতে হবে। ফলে তাদের মাঝে একটি এফেক্টিভ সিস্টেম তৈরি হবে, যা তাদের উন্নয়নের জন্য সহায়ক হবে।
আমরা যখন প্রতিদিন কৰ্মস্থল থেকে বাসায় ফিরি, তখন প্রথমে সবাইকে ‘হ্যালো’ বলতে পারি। ছেলেমেয়েসহ পরিবারের সবাইকে জিজ্ঞেস করতে পারি, আজ কে, কী কাজ সম্পন্ন করেছে এবং কোনও ইন্টারেস্টিং বিষয় ছিলো কিনা। সাথে যদি কোনও বিষয় ফলোআপ করার থাকে সে বিষয়েও খবর নিতে পারি। সপ্তাহে অন্ততঃ একদিন পারিবারিক মিটিং এবং টিপার্টি করা যেতে পারে। সেখানে আলোচনা হতে পারে, গত সপ্তাহের কে, কী করেছে এবং আগামী সপ্তাহে কার, কী পরিকল্পনা আছে তা জেনে নিতে পারি। এর সঙ্গে দিতে পারি প্রয়োজনীয় পরামর্শও।
এতে ফল হবে,
(১) পরিবারের প্রতিটি অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সবার কাছে খোলামেলা আপডেট হওয়া,
(২) পিতা-মাতার সাথে সন্তানদের সম্পর্ক গভীর হওয়া,
(৩) এবং বিশেষ করে পরিবারের সদস্যের মাঝে যদি কোনও গ্যাপ থাকে তা দূর করতেও সাহায্য করবে।
এটা খুবই জরুরি যে, ছেলেমেয়েদের সবসময় মনিটরিং করা এবং টাইম টু টাইম কাউন্সেলিং করা, তাদের লেখাপড়া এবং ভবিষ্যতের লক্ষ্য সম্পর্কে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেওয়া। এছাড়া কোনও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় থাকলে কালক্ষেপ না করে সমাধানের জন্য যথাবিহিত পদক্ষেপ নেওয়া। বাবা-মা না করতে পারলে প্রয়োজনে স্কুলের শিক্ষক, সিনিয়র অভিভাবক বা কাউন্সিলর-এর কাছ থেকেও সাহায্য কিংবা পরামর্শ নেওয়া দরকার।এভাবে প্রতিটি পিতা-মাতা তাদের ছেলেমেয়েদের মনিটরিং এবং কাউন্সেলিং করার গুরুত্ব অনুধাবন করে উদ্ভূত সমস্যায় তাৎক্ষণিকভাবে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিলে ছেলেমেয়েদের পড়াশুনার পাশাপাশি তাদের অনাগত জীবন-উন্নয়নে নিঃসন্দেহে সহায়ক ভূমিকা রাখবে এটা আশা করা যায়। পাশাপাশি সন্তানরা নিজ পরিবারের নিয়মতান্ত্রিক পরিবেশ রপ্ত করে অগ্রসর হয়ে পরবর্তী প্রজন্মের ধারবাহিক উন্নয়নে নিঃসন্দেহে আরও বেশি অবদান রাখবে তা নিশ্চিতভাবে বলা যায়।
লেখক: কলামিস্ট