সাদী আহমেদ
কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাঙালির জাতীয় কবি-বাংলাদেশের জাতীয় কবি। জন্মেছিলেন বর্তমান পশ্চিম বাংলার বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে ২৪শে মে ১৮৯৯ খ্রিষ্ঠাব্দে, ১২ ই জ্যৈষ্ঠ ১৩০৫ বঙ্গাব্দে। পিতা কাজী ফকির আহমেদ-মাতা জাহেদা খাতুন। পাকিস্তানকে ‘ফাঁকিস্তান’ বলার এই কবি ১৯৭২ সনে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে তৎকালিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বিশেষ বিবেচনায় ২৪শে মে তাঁর জন্মদিনের পূর্বক্ষণে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে এসে পৌঁছান। রাষ্ট্রের অতিথি হিসেবে কবি ভবন বর্তমানের নজরুল ইন্সিটিটিউটে তাঁকে এনে রাখা হয়। আমরা সবাই জানি তিনি তখন বাকরূদ্ধ।
এই ভবনে থাকাকালিন কবিকে দেখার জন্য সাধারণ মানুষের ভীড় লেগেই থাকত। দর্শণার্থী হিসেবে একদিন তাঁকে দেখেছি সাদা তহবন্দ রাজশাহী সিল্কের পাঞ্জাবী ও চেলী যুক্ত উত্তরীয় পরা অবস্থায় বাড়ীর লনে পায়চারী করছেনÑ অপূর্ব তাঁর পৌরুষ কান্তি! তখন তাঁকে নিয়ে কত শত অনুষ্ঠান। কখনও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, কখনও বাংলা একাডেমীতে, কখনও বা অসুস্থ কবিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে পিজি হাসপাতালে বর্তমানের বঙ্গবন্ধু ইন্সিটিটিউটে।
কিন্তু বিদ্রোহী কবি, সাম্যের কবি, পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ট গীতিকার ও সুরকার ‘চিরশিশু’ নির্বিকার! কোন কিছুতেই তাঁর কোন প্রতিক্রিয়া নেই। অথচ যিনি কিনা ছিলেন চির চঞ্চল। যাঁর চঞ্চলতায় একটি জাতি কিভাবে উন্মাদ হয়ে উঠতে পারে তা আমরা দেখেছি ১৯৭১-এ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়। ৭০ এর সাধারন নির্বাচনে বাঙালীর জয় লাভের পর পত্রিকার হেড লাইন হয়েছিল “ঐ নতুনের কেতন উড়ে।”
মৃত্যু তাঁকে স্পর্শ করে ১৯৭৬ সালের ২৯শে আগষ্ঠ সকাল ১০.১০ মি. এ ঢাকার পি.জি. হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায়। সেদিন হঠাৎ করে বেতার ও টেলিভিশনের মূল অনুষ্ঠান বাদ দিয়ে তাঁর মৃত্যু সংবাদ প্রচার করা হয়। ঐ সংবাদে আমার মনে এক ধরনের ব্যথার সাথে তীব্র শূন্যতা অনুভব হয়, সমস্ত জাতিও শোকাহত হয়ে পড়ে। সেইদিন-সারাদিন বেতার ও টেলিভিশনে তাঁর রচিত হার্মদ, নাত, গীত ইত্যাদি প্রচারিত হতে থাকে। জানা গেলো তাঁর মরদেহ টি.এস.সি. প্রাঙ্গনে রাখা হবে দর্শণার্থীর জন্য। তাঁকে সমাহিত করা হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদ প্রাঙ্গণে। এমতাবস্থায় ভারাক্রান্ত মনে দুপুর ১টার দিকে টি.এস.সি.তে পৌঁছালাম তাঁকে শেষ বারের মত একবার দেখার জন্য। সেই সময় দেশে জেনারেল জিয়ার সামরিক শাসন কবিকে ঢাকায় সমাহিত করার একটা তাড়াহুড়া ও চাঞ্চলতা লক্ষ্য করা যাচ্ছিল।
কিছুক্ষণের মধ্যে কবির মরদেহ টি.এস.সি.
প্রাঙ্গনে এনে রাখা হয়। এরই মধ্যেই দেখি দর্শনার্থীদের সারি, বিশেষত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের। ছাত্রীদের আলাদা একটা বড় সারি তৈরি হয়। ঘণ্টাখানেক-এর মধ্যেই জানাজার জন্য কবির মরদেহকে নিয়ে সেখান থেকে রেসকোর্স এর উদ্দেশ্যে রওনা হয়। প্রচন্ড ভিড়ের মধ্যেও আমার সৌভাগ্য হয়েছিল তাঁর কফিন বাহি মরদেহ কিছুক্ষণের জন্য বহন করার।
টি.এস সি. থেকে রেসকোর্স খুববেশী দূরে নয়। বেশী সময় লাগেনি সেখানে পৌঁছাতে। জানাজায় শরিক হন তৎকালীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিসহ বাংলাদেশের প্রধান সেনাপতি ও উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। জানাজার নামাজের শেষে তাঁর মরদেহ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আংশিক নিয়ন্ত্রণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদ প্রাঙ্গনে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রচন্ড ভিড় ও সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণের কারণে আর কোন ভাবেই কফিনের কাছাকাছি যাওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। তখন দ্রæত ঢাকা আর্ট কলেজ বর্তমান চারুকলার ছাদে উঠে মাত্র কিছু দূরেই তাঁর কবরের স্থান সেখান থেকে ভিড় এড়িয়ে অশ্রæসজল চোখে কবির অন্তিম শয়ন ব্যথাতুর চিত্তে দেখেছিলাম। সর্বশেষে সেনাবাহিনীর একটি চৌকষ দল বিউগলের বিদায়ী সুর ও ২১ টি গান ¯ø্যলুট দিয়ে রাষ্ট্রীয় সম্মান প্রদর্শন করে। ইতোমধ্যে সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়েছে। সেখান থেকে ভগ্ন হৃদয়ে ফিরে আসার সময় মনে হ’ল- কবির আক‚তি আজ যেন পূর্ণ হল। তিনি লিখেছিলেনঃ
“মসজিদেরই পাশে আমায়
কবর দিও ভাই
যেন গোরেও থেকে মুয়াজ্জিনের
আজান শুনতে পাই।”
আমাদের জাতীয় কবিÑ কেমন ছিলেন তিনি?
তিনি একাধারে কবি, সাহিত্যিক, সঙ্গীতজ্ঞ, সাংবাদিক, সম্পাদক, রাজনীতিবিদ এবং সৈনিক হিসেবে অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে সর্বদাই ছিলেন সোচ্ছার। অর্থাৎ মানবতাবিরোধী যত প্রকার আচরণ পৃথিবীতে বিরাজমান কবির লেখনি ছিল সেসবের বিরুদ্ধে।
তিনি বলেছেন,
“আমি আপনারে ছাড়া করি-না কাহারে কুর্নিশ।”
এ তাঁর কথার কথা ছিল না। একবার ঢাকার রইস ব্যক্তিরা তাঁকে ঢাকার বুড়িগঙ্গার নদীবক্ষে সম্বর্ধনা দিতে চেয়েছিল। মনভুলা কবি যথাসময়ে সেখানে উপস্থিত হতে পারেননি। রইস ব্যক্তিরা রইস-ই মনোভাব নিয়ে তাঁকে খুঁজে আনতে বললেন; তখন তিনি আগতদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন: “যাও রইসদের যেয়ে বল নজরুল আপনারে ছাড়া করে নাকো কারেও কুর্নিশ।”
সম্ভবত তিনিই হলেন বাংলা সাহিত্য জগতের প্রথম ব্যক্তি যিনি সাহিত্য রচনার জন্য প্রথম কারাবরণ করেন। পরাধীন অবস্থায় রাজরোষ ও নানা সামাজিক অন্যায় অবিচার প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও যিনি কখনও আপোষ করেননি। আজ সে রকম ব্যক্তি সত্যিই বিরল। অর্থকষ্ট তাঁকে বিপর্যস্থ করলেও তিনি কখনও নীতিভ্রষ্ট হননি। মাথা নত করেননি অর্থের প্রলোভনে।
ধর্মীয় রাজনীতি, সাম্প্রদায়ীকতার বিষ আজও সারা বিশ্বে। অথচ তিনি ধর্মকে কখনওই রাজনীতির সাথে মিলাননি, বা কখনও প্রস্তুতও ছিলেন না তা মিলাতে। কবি নজরুলের সময়ে “তাঁর উপর মুসলমান সমাজের রক্ষণশীল অংশ কতটা ক্ষিপ্ত ছিল সেটা আমরা জানি। ক্রোধের একটি নিদর্শন এখানে স্মরণ করা যেতে পারেÑ “নরাধম ইসলামের মানে জানে কি? নরাধম নাস্তিক দিগকেও পরাজিত করিয়াছে।” অথচ সাংস্কৃতিক জগতে ইসলাম ধর্মকে তিনি যেভাবে প্রতিষ্ঠা করে গেছেন তা অতিক্রম করা সত্যিই দূরুহ। ইসলামের মানে তিনি যেভাবে হৃদয়ঙ্গম করেছিলেন অনেকে তা করতে পারেনি।
বর্তমানে ধর্মের নামে মানুষে মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে সমস্ত বিশ্বে যে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড চরম আকার ধারণ করেছে তার বিরুদ্ধে আমাদের জাতীয় কবি বহু পূর্বেই লিখেছেনঃ
“কাটায়ে উঠেছি ধর্ম-আফিম-নেশা,
ধ্বংস করেছি ধর্ম যাজকী পেশা।
ভাঙ্গি মন্দির, ভাঙ্গি মসজিদ
ভাঙ্গিয়া গির্জা গাহি সংগীতÑ
এক মানবের একই রক্ত মেশা
কে শুনিবে আর ভজনালয়ের হ্রেষা।”
অনত্র্যঃ “মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান”।
কবি সাহিত্যিকরা আমাদের চিন্তার ও চেতনার অগ্রগামী অংশ। তাঁরা মনুষত্ব বিকাশে উদ্বুদ্ধ করেন, জাতিকে পথ দেখান। আমাদের জাতীয় কবি নজরুল শুধু আমাদেরকেই নয় সমস্ত বিশ্ববাসীকেও পথ দেখিয়ে নিয়েছেন: সমস্ত সংঘাত, সন্ত্রাস, ভেদাভেদ, নারীর প্রতি বৈষম্য, অন্যায় ও অত্যাচার, সর্বপরি শোষণ ও নিপিড়ন-এর বিরুদ্ধে।
মহাকালের সময়ে এই ধরনের ক্ষণজন্মা মানুষের জন্ম হয় দু’একজন। নজরুল সেই ক্ষণজন্মাদের অন্যতম।
লেখক, আহবায়ক-
টরন্টো বাংলা বই মেলা, কানাডা