সেজান মাহমুদ
লেখক পরিচিতি: কথাশিল্পী, গীতিকার, চলচ্চিত্রকার, পেশায় চিকিৎসা বিজ্ঞানী। ইউনিভার্সিটি অব সেন্টার ফ্লোরিডা কলেজ অব মেডিসিনে সহকারী ডিন ও প্রফেসর হিসাবে কর্মরত।
যে কোন শব্দ আসুক বাংলা ভাষায়; যদি তা স্বাভাবিকভাবে মিশে যায় সংস্কৃতির সঙ্গে তাতে ভাষারই সমৃদ্ধি ঘটে। ‘জান ও ‘জবান’, ‘জান-মালের নিরাপত্তা’, অন্যদিকে ‘বাক-স্বাধীনতা’ বা ‘জীবনের নিরাপত্তা’ কোনটা নিয়েই আমি আপত্তি করবো না। কিন্তু কেউ যদি বলে ‘জান ও জবানের আজাদী, স্বাধীনতার পরিবর্তে, তাহলে তা মার্কামারা হ’য়ে যায়। মনে রাখতে হবে ভাষা মানেই তাতে সাইন ও সিম্বল আছে, ‘সিগনিফায়েড’ ও ‘সিগনিফায়ার’ আছে, ভাষার সঙ্গে ইতিহাসও যুক্ত হয়। ভাষার সঙ্গে দৃশ্যকল্প ও উপমাও যুক্ত। তাই ভাষাকে খুব হালকাভাবে নেয়া উচিত না।
আমি ভাষার সঙ্গে মানব-মস্তিষ্কের বা নিউরোলজির সম্পর্ক নিয়ে নাই বা বললাম। তবু কয়েকটা কথা বলি; ভাষা আমাদের চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করে কী না এই প্রশ্ন নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে। একেবারে নিশ্চিতভাবে এই সম্পর্ক জানা না গেলেও ভাষা আমাদের চিন্তার গতিপ্রকৃতি, পারসেপশন বা উপলব্ধি এবং সাংস্কৃতিক পরিচয়ের ভিত্তিও তৈরি করে।
রাশান ভাষায় বার রকমের রঙের ধারণা আছে, অন্যদিকে নিউগিনির ভাষায় মাত্র দুই রকমের- কিছু রঙ উষ্ণ আর কিছু রঙ শীতল। চাইনিজ ভাষায় বাচ্চারা তাড়াতাড়ি গণনা শিখে ফেলে ইংরেজি বা বাংলা ভাষার চেয়ে। কারণ, চৈনিক ভাষায় দশের পরে এগারো বা ইলেভেন নেই- আছে দশ-এক বা টেন-ওয়ান। আমরা বাংলায় যেমন ‘অভিমান’ করি যার সমকক্ষ কোন ইংরেজি শব্দ খুঁজে পাওয়া যায় না। ইংরেজিতে ‘আই মিস ইউ’ বললে যা বুঝি বাংলায় ‘মন জ্বলে’ বললে তার চেয়েও গভীর ব্যঞ্জনা পাই!
রাজনীতির মতলববাজরা এগুলো জেনেই নানান রকম চালাকি করতে থাকে। ইতিহাসে আমরা তাও দেখেছি। সেজন্যেই পাকিস্তান সবচেয়ে আগে বাংলা ভাষার ওপরে আক্রমণ করেছিল যাতে আমাদের আত্ন-পরিচয় তৈরি না হয় বা নষ্ট হ’য়ে যায়। বহুদিন থেকেই বাংলা ভাষার ইসলামিকরণ, বা পশ্চিমবঙ্গের বাংলা থেকে বাংলাদেশের বাংলাকে আলাদা করার নানান আরোপিত চেষ্টা চলছে। ভাষা নিজস্ব গতিতে চলবে বললেও এইসব আরোপের কিছু ফল, বা সুফল বা কুফল থাকবেই। সেইসব মতলববাজদের কথাও মাথায় রাখতে হয়।
ভাষা একেকটা ইতিহাসেরও মাইলস্টোন বা মাইলফলক তৈরি করে। সেকারণেই ‘মীর জাফর’ একটি নাম থাকে না, ‘নাজি’ বললে শুধু জার্মান সমাজতান্ত্রিক জাতিয়তাবাদী দলের সদস্য বুঝায় না, এবং ‘রাজাকার’ বললে স্বেচ্ছাসেবক বুঝায় না, বরং একটি ঘৃণ্য বিশ্বাসঘাতক স্বাধীনতাবিরোধীদের বুঝায়। ভাষার এইসব নদীর-মতো বৈশিষ্ট আছে বলেই কারো যেমন শব্দ ব্যবহারের অধিকার আছে, তেমনি তা নিয়ে আপত্তি তোলারও অধিকার আছে।
আমি বরং ফেসবুকে কার বিয়ে-করা স্ত্রীর আগে পরে কয়টি স্বামী ছিল বা অন্য কোন গীবতের বা পরনিন্দা বা পরচর্যার চেয়ে ভাষা ব্যবহার নিয়ে এই বিতর্ককে স্বাগত জানাই। এই আলোচনার অন্তত কিছু সুফল পাওয়া যাবে!