নীলও বুঝতে পারে সব। বুঝতে পেরেও নীল একের পর এক ম্যাসেজ দেয় এই ভেবে, যদি অনন্যা তাকে ক্ষমা করে। যদি, আবার আগের মত হয়ে যায় অনন্যা। কিন্তু, বেশ কিছুক্ষণ ম্যাসেজ বিনিময় করেও অনন্যার নির্লিপ্ততা দেখে নীল হতাশ হয়। তবুও, প্রসঙ্গ ছেড়ে নীল হঠাৎ প্রশ্ন করে, – তুমি কি আমার নামটা মনে রেখছো মেম সাহেব? – হ্যা, তোমার নাম নীলাদ্রি। – পদবী সহ? অনন্যার অবশ্যই মনে আছে। কিন্তু, বলবে না সে। ইচ্ছে করেই বলবে না। কারণ, নীল বুঝুক, কোনো কিছুরই আর তোয়াক্কা নেই অনন্যার। পদবী না বলতে পারা দেখে অনন্যাকে নীল কটাক্ষ করে- দেখলে মেমসাহেব, আমার পুরো নাম তোমার মনে নেই। অনন্যা মনেমনে বলে- নীলাদ্রি চৌধুরী তোমার নাম। এতগুলো দিন মনের মধ্যে লালন করেছি তোমায়। আবেগ নেই বলে স্মরণ শক্তি কি নেই? অনন্যার হৃদয়ে মৃধু হাসি তখন। নীল আবার জিজ্ঞেস করে – এমন একটা কথা বলো তো যা তুমি-আমি ছাড়া কেউ ধারণাও করতে পারবে না। অনন্যা রাগে গড়গড় করে এবার, উত্তর দেয় – জ্যাপনিস ওয়াইফ। অফিস ফাঁকি দিয়ে আমার সাথে ফোনে থাকা। আমাকে ভার্চুয়ালি চুমু খাওয়া শেখানো। দেখলে তো আমি কিছুই ভুলিনি। ভুলে ছিলে সব কিছু তুমি।
সব অনুভূতি লীন হয়ে গেলেও, আজ অনন্যার ইচ্ছে হচ্ছিলো নীলকে শক্ত মন্দ কিছু বলতে। এমন কথা শোনাতে যেন জীবনের সব তৃপ্তিগুলো মিটে যায়। আবার ভাবে, তাহলে তো ওর শাস্তিটা হয়েই গেলো। বলুক ওর যত কথা আছে, বলুক। আমি আর কিছুই বলবো না। কিন্তু, এতটা নিরবও থাকতে পারছে না অনন্যা। তাই, আবার যখন নীল বলে, – কই, পারলে কই? আমি চেয়েছিলাম এমন কথা যা জীবনে কেউ আন্দাজও করতে পারবে না। অথচ, তুমি আমি দুজনেই জানি। এবার অনন্যা একটু উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞেস করলো – কি সেই কথা, নীল?
নীল অবলীলায় উত্তর দেয় -মেমসাহেব, তুমি আমাকে কামশীতল বলেছিলে। কথাটা শুনে অনন্যা নড়েচড়ে উঠে। এমন কথা বলেছি আমি! নীল আবার বলে, – সেদিন আমি ভীষণ লজ্জা পেয়েছিলাম। সেই লজ্জা আমি এখনো ভুলিনি, মেমসাহেব। আরো কিছু কথা যা আমি এখন আর বলবো না। ভীষণ বিব্রতকর! আমার উপর তোমার অনেক রাগ, তাই না মেম সাহেব? অনন্যা অন্যমনস্ক। বাকি কথা কি হতে পারে, প্রশ্ন তার মনে? জিজ্ঞেস করবে না তবুও অনন্যা। অন্যমনস্ক থেকেই লিখে ফেললো – হ্যা, তুমি আমার অনেক ক্ষতি করেছো। তুমি আমার সাথে অন্যায় করেছো। তোমাকে ভুলতে আমার অন্যের স্মরণাপন্ন হতে হয়েছিলো। তুমি আমার মনটাকে বিষিয়ে দিয়েছো। আমার একটা কোমল মন ছিলো, তাতে তুমি ঘৃণার জায়গা করে দিয়েছো। কানাডায় আমি কত একা ছিলাম, তুমি আমাকে আরো একা করে দিয়েছো, নীল। -জানি একটি-দুটি ঘটনায় আমার দোষ ছিলো। তোমার সাথে ভীষণ রকম খারাপ ব্যবহারও করেছি আমি মেমসাহেব। কিন্তু, সেদিন যেটা প্রধান কারণ ছিলো আজ যদি তুমি টরোন্টোতে থাকতে তাহলে আজও একই কারণ প্রধান হোতো। দুঃখ হয় যে তুমি সেই কারণটা বুঝেও বুঝলে না। এবার অনন্যা উত্তর দেয়, – বুঝে থাকলে বুঝবো না কেন? হয়তো বুঝিইনি। তাছাড়া, না বুঝলে বুঝাতে তো পারতে! – কারণ তো একটাই ছিলো মেমসাহেব -দূরত্ব। তুমি ছিলে সাত সমুদ্রের ওপার। আক্ষরিক অর্থে- Half way across the globe! আমার যখন অফিস, তোমার তখন ছুটি৷ তোমার কাজ, আমার বাড়ি ফেরা। কথা বলি কি করে? তুমি অধৈর্য, তুমি প্রেম ব্যাকুল, আমিও তাই। কিন্তু, সময় যে আমাদের অনুকূলে ছিলো না। সময়ই পরস্পরকে দূরে ঠেলে দিয়েছিলো। -দুরত্ব কোনো কারণ হতে পারে না, নীল। কারণ, সেই সুদূরেই আমাদের ভালোবাসা ঘনিভূত হয়েছিলো। – প্রথম দিকে আমাদের তো কোনো চাহিদা ছিলো না, মেমসাহেব। শুধু ফেসবুক ম্যাসেজিং ছিলো। তার পর এলো আসল সময়। সেটা হোলো ফোন। তুমি খুঁজতে আমাকে আমার অফিস টাইমে, আমি তোমাকে চাইতাম আমার রাতে, আমার অবসরে, একাকিত্বে, আমার নির্জন বিছানায়। সে এক অসম্ভব যন্ত্রণা, মেমসাহেব; অসহ্য যন্ত্রণা। – ওসব কিছুই না, নীল। তুমি তোমার পরিবারের কিছু বিষয় নিয়ে আপসেট ছিলে। -হ্যা, তা তো ছিলামই। তবে, এটাই মূল কারণ ছিলো না আমার চলে যাওয়ার। পরিবারতো ঠিক হোলো মেমসাহেব। শুধু তোমাকে কিছুই বোঝানো গেলো না। -আর কি বোঝাতে চেয়েছিলে তুমি, নীল? – এই যে আমাদের দূরত্ব, আমাদের সময়ের ব্যবধানই আমাদের প্রেমের প্রতিকূলতা। আমি সব চেয়ে ভুল করেছি আমার ধৈর্য হারিয়ে। আমার মনে আছে, আমি তোমাকে অনেক কথা শুনিয়েছিলাম- বাঁধন ছাড়া রাগ, অজস্র কটু কথায় তোমাকে আমি এফোড়ওফোড় করে দিয়েছিলাম। তুমি কেঁদেছিলে। সেটাই আমার ভুল, ভীষণ রকম ভুল! মেমসাহেব, কি ভীষণ ট্র্যাজেডি! নীল এসব কথা লিখছে আর অঝোরে কাঁদছে। তাই, একটুক্ষণ বিরাম দিলো লিখায়। চোখের জল মুছে নিলো সে। মুছে নিলো চশমার কাঁচ জোড়া। কারণ, ঝাপসা হয়ে উঠেছিলো তার চার পাশ – চশ্মার গ্লাস, মোবাইল স্ক্রিন, আশেপাশের সব।
অনন্যা বুঝতে পারছে নীলের মনের অবস্থা। তাই, সেও অন্য কাজে ব্যস্ত না হয়ে মোবাইলটা হাতে নিয়েই বসে রইলো ঠায়। অনন্যাও এবার ব্যকুল হয়ে উঠলো ঠিক আগেরই মত। এর আগে নীল বলেছিলো- আমি ঢাকায় আসছি। তুমি দেখা করবে তো আমার সাথে? সেদিন কোনো উত্তর করেনি অনন্যা। আজ কেনই যেন মনে হতে লাগল, কেন কিছু উত্তর করলাম না? পরক্ষণেই ভাবলো, এখন এই মহামারীতে নীল আসতোই বা কি করে? আমি আসতে বলে দিলে ও মরিয়া হয়ে যেত আসার জন্যে। আরো কষ্ট পেতো নীল। এরই মধ্যে ম্যাসেজ টোন বেজে উঠলো। নীলেরই ম্যাসেজ। সম্বিত ফিরিয়ে ম্যাসেজ পড়তে শুরু করলো আবারও অনন্যা।
চলবে….