একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০১৮-তে জয় পায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের অন্যতম এই রাজনৈতিক দলটি টানা তৃতীয় বারের মত তাদের সরকার গঠন করে। নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয়ের রেকর্ড করার পর নতুন মন্ত্রিসভা গঠনে বিশাল চমক আনেন আওয়ামী লীগ সভাপতি এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সেই সময় স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী পদে দায়িত্ব পান জাহিদ মালেক স্বপন। মানিকগঞ্জ-৩ আসন থেকে টানা তিনবার নির্বাচিত জাহিদ মালেক মহাজোট সরকারের গত মেয়াদে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
জাহিদ মালেক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। রাজনীতির পাশাপাশি বিভিন্ন সমাজকল্যাণ কাজের সঙ্গেও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত রয়েছেন। তিনি ঢাকাসহ মানিকগঞ্জের বিভিন্ন শিক্ষা, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, সমাজ উন্নয়নমূলক প্রতিষ্ঠান স্থাপনে অগ্রণী ভূমিকা রেখে চলেছেন। তিনি দেশের একজন স্বনামধন্য বিশিষ্ট ব্যবসায়ী।
তবে এত সবকিছু ছাপিয়ে এখন তিনি বাংলাদেশের একজন অন্যতম সমালোচিত স্বাস্থ্যমন্ত্রী। বাংলাদেশে বারবার দুর্নীতির কারণে যে মন্ত্রণালয় আলোচনায় উঠে এসেছে এমনকি পূর্বে সেই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীদের সম্পদের খোঁজ নিয়েছে দুদক সেটা হচ্ছে বিতর্কিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পরেই স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বিচিত্র সব কর্মকাণ্ড এবং বেফাঁস মন্তব্য শুধু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নয় বরং সরকারের ভাবমূর্তির ওপর বিরূপ প্রতক্রিয়া ফেলেছে জনমনে।
করোনার সময় সারাদেশের মানুষের দৃষ্টি এই মন্ত্রণালয়ের দিকে। করোনার এই সময়ে সুযোগ ছিল মন্ত্রণালয়ের ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনা। কিন্তু হয়েছে উল্টো। বারবার আলোচনায় আসছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক এবং তার সবই নেতিবাচক কারণে।
গত কয়েক মাসে স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিজেকে অনেকটাই ব্যর্থ হিসেবে ফুটিয়ে তুলেছেন। তিনি নিজেই বলেছেন, করোনা বিষয়ে এমন সব কাজ হচ্ছে, যা তিনি জানেন না। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাও তাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করেন না। এই প্রেক্ষাপটে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বারবার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের প্রতি আহ্বান রেখে চলছেন, তার কাছ থেকে সিদ্ধান্ত না নিলেও অন্তত পরামর্শটুকু যেন নেওয়া হয়। একজন মন্ত্রী কোন পর্যায়ে গেলে গণমাধ্যমের সামনে এমন আবেদন রাখতে পারেন, তা অনুমান করা যায়। বাস্তবে মন্ত্রীর এই আবেদনেও সাড়া মেলেনি।
সম্প্রতি করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন প্রয়োজন নাও হতে পারে বলে এক মন্তব্য করে ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন তিনি। গত ১৫ আগস্ট রাজধানীর মহাখালীতে বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনস (বিসিপিএস) মিলনায়তনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৫তম শাহাদতবার্ষিকী ও জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে দোয়া মাহফিল ও আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত হয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, “ভ্যাকসিন আসুক বা না আসুক করোনাভাইরাস বাংলাদেশ থেকে এমনিতেই চলে যাবে। আক্রান্ত বিবেচনায় করোনায় মৃত্যুহার আমাদের দেশে অনেক কম। বলা চলে, ভ্যাকসিন ছাড়াই দেশ এখন স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরার পথে।” তার এই মন্তব্য নিয়ে ইতিমধ্যেই বিভিন্ন মহলে সমালোচনার ঝড় উঠেছে।
নমুনা পরীক্ষা কেলেঙ্কারি এবং ভাইরাসের বিরুদ্ধে যথাযোগ্য লড়াই করতে তার মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতা ছাড়াও, তিনি নিজে সরকারকে বিভ্রান্ত করেছেন। মার্চের শুরুর দিকে দেশে প্রথম কোনো কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হলে, তার দেওয়া ‘পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য সরকার সম্পূর্ণ প্রস্তুত রয়েছে’ আশ্বাসটি ঠুনকো বুলি হয়ে ওঠে। বিশ্বব্যাপী ভাইরাসটির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অন্যতম কার্যকর হাতিয়ার হিসেবে গণ্য হওয়া- নমুনা পরীক্ষা ঠিকঠাক চালাতে পারেনি স্বাস্থ্য বিভাগ। ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামের জন্য ত্রাহি অবস্থা শুরু হয় স্বাস্থ্যকর্মীদের মাঝে। করোনাভাইরাসে পাঁচ ডজনেরও বেশি চিকিৎসক প্রাণ হারালে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি স্বাস্থ্যসেবা খাতেও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ভাইরাসটির সংক্রমণ রুখতে ভঙ্গুর স্বাস্থ্যসেবা খাত এখনো হিমশিম খাচ্ছে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিজেই কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কমিটির প্রধান। এই মহামারির সময় গোটা জাতি তাকিয়ে থাকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য, কাজকর্ম এবং উদ্যোগের ওপর। কিন্তু স্বাস্থ্যসেবা, হাসপাতালে ভর্তি এবং করোনা পরীক্ষা নিয়ে মানুষের ব্যাপক ক্ষোভ তৈরি হয়ে আছে। এসবের সমাধানে মন্ত্রণালয়ের কাজকর্ম দৃশ্যমান নয়। স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিজেই যে জাতীয় কমিটির প্রধান, সেটির কর্মকাণ্ড নিয়েও তিনি অসন্তুষ্ট। এসব কারণে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে পাশ কাটিয়ে প্রতিটি মন্ত্রণালয় যার যার মতো সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক একাধিকবার বলেছেন, করোনা মোকাবিলায় জাতীয় কমিটির চেয়ারম্যান হলেও অনেক কিছুই তাকে জানানো হয় না। তার বক্তব্যে সমন্বয়হীনতার ইঙ্গিত স্পষ্ট।
জুনে স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে দেওয়া এক চিঠিতে বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) দ্রুতগতিতে চিকিৎসক ও নার্সদের মধ্যে কোভিড-১৯ ছড়ানোর দায় মন্ত্রণালয়ের ওপরও চাপিয়েছে। সংগঠনটির মতে, নিম্নমানের মাস্ক সরবরাহ, অপর্যাপ্ত ও কারিগরি ত্রুটিযুক্ত ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট এবং চিকিৎসকদের অপ্রতুল প্রশিক্ষণ স্বাস্থ্যকর্মীদের ভাইরাসটিতে এভাবে আক্রান্ত হওয়ার জন্য দায়ী।
সম্প্রতি বাংলাদেশের একটি বেসরকারি হাসপাতালের কোভিড-১৯-এর নমুনা পরীক্ষা জালিয়াতির ঘটনা সারবিশ্বে বাংলাদেশ নেতিবাচকভাবে তুলে ধরে। নমুনা পরীক্ষা কেলেঙ্কারি ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর দায়ভার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাঁধে চাপানোর চেষ্টা করছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী, অথচ ওই অধিদপ্তর তারই মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ। বেসরকারি ওই হাসপাতালটির সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরে নিজের দায়ভার নিজ কাঁধে না নেওয়ার চেষ্টা করছেন তিনি। এমনকি ওই সমঝোতা সম্পর্কে তিনি জানতেন না বলেও দাবি করেছেন। অথচ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যাওয়া ছবিতে দেখা যায়, সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরের অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিজে উপস্থিত ছিলেন।
এছাড়া আরো বিচিত্র সব কাণ্ড আছে তাকে নিয়ে। বেসরকারি এক টিভি চ্যানেলের প্রোগ্রামে তিনি ভিডিও কলে যুক্ত হয়েছিলেন। অনুষ্ঠানের সঞ্চালক যখন শক্তপোক্ত কিছু প্রশ্ন করে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেককে চেপে ধরেছেন, তখন তিনি বেশ বিপাকে পড়ে যান। তখন প্রশ্নের এই বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে যেতে তিনি আকস্মাত ভিডিও কলের সংযোগ কেটে দিয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান।
একবার ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম বা পার্সোনাল প্রটেকটিভ ইকুইপমেন্টের সংক্ষেপিত রূপ ‘পিপিই’কে ‘পিপিপি’ উচ্চারণ করে তুমুল হাস্যরসের জন্ম দেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। এক ভিডিও বার্তায় তিনি করোনাভাইরাসের পরিস্থিতি জানানোর সময় অন্তত নয়বার তিনি ‘পিপিই’কে ‘পিপিপি’ বলে উচ্চারণ করেন।
নিজের মন্ত্রণালয়ে নিয়মিত আসতেন না স্বাস্থ্যমন্ত্রী। সাংবাদিক এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে বলেন, আমি যেখানে বসবো, সেটাই অফিস।
এত সবকিছুর পরও তিনি বারবার বিভিন্ন জায়গায় নিজেকে সফল বলে দাবি করেছেন। বিনা সংকোচে বলে গেছেন তার মন্ত্রণালয় অত্যন্ত সফলতার সাথে এই মহামারি পরিস্থিতি সামাল দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু বাস্তবে বাংলাদেশকে এই পরিস্থিতি সামাল দিতে বেশ বেগ পোহাতে হচ্ছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে ব্যর্থ আখ্যা দিয়ে বিভিন্ন মহল তার পদত্যাগের দাবি করেছেন। কিন্তু নানান অনিয়ম, অব্যস্থাপনা এবং উদ্ভট মন্তব্যের পরও বহাল তবিয়তেই আছেন বাংলাদেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।