গত শতকের আশির দশকের শেষের দিকে ব্রিটিশ কবি রবীন্দ্র গবেষক ও অধ্যাপক ড. উইলিয়াম রাদিচে ঢাকা এসেছেন দুটি বক্তৃতা দেবার জন্যে। বাংলা একাডেমি ও জার্মান কালচারাল সেন্টারের গ্যায়টে ইন্সটিটিউটে তিনি পালাক্রমে দুটি বক্তৃতা দেবেন।
দুই জায়গায়ই খুবই স্বাভাবিকভাবে বিষয় : রবীন্দ্রনাথ। আগের দিনের বিকেলে বাংলা একাডেমির বক্তৃতা পর্বের সভাপতি ড. খান সারওয়ার মোর্শেদ ও পরেরদিন গ্যায়টে ইন্সটিটিউটে সভাপতি ড. আনিসুজ্জামান।
বাংলা একাডেমির বক্তৃতাপর্ব অনুষ্ঠান শুরুর কিছু আগে খেয়াল করলাম আহমদ ছফা অনুষ্ঠানস্থলে আসার পর পরই তাঁকে নিয়ে একটি গুঞ্জন শুরু হয়েছে। অবশ্য গুঞ্জনের সূত্রপাত ছফাই করেছেন। তিনি বক্তৃতার আগেই কিছু কিছু বিষয় উত্থাপন করে বুঝিয়ে দিয়েছেন রাদিচের প্রতি একটি আক্রমণাত্মক মনোভাব তাঁর ভিতরে কাজ করছে। ছফা যদি সত্যি সত্যি একজন বিদেশি অতিথিকে অপমান করেন এই আশংকায় নিম্নস্বরে কেউ কেউ বলাবলি করছিলেন ছফাকে সেখানে থাকতে দেওয়াটাই আশংকাজনক। এই গুঞ্জরন ছড়িয়ে পড়লে আহমদ ছফাকে নিবৃত্তি করার জন্য হস্তক্ষেপ করলেন স্বয়ং সভাপতি। কিন্তু পরেরদিন গ্যায়টে ইন্সটিটিউটে ছফা আগের দিনের জমানো ক্ষোভ জেড়ে রবীন্দ্রনাথের জীবনের বিভিন্ন ছোট ছোট বিষয় উত্থাপন করে মন্তব্য করলেন রাদিচের বক্তৃতার পর। কি কি বিষয়ে এই আপত্তি আজ আর তা মনে নেই। এর জের ছড়িয়ে পড়লো সভায়। জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী অনির্ধারিত বক্তা হিসেবে এর জবাবে কিছু বললেন। সমাজতান্ত্রিক ভাবনার প্রভাববিস্তারী কারো কারো কাছে আরো আরো অসন্তুষ্ট প্রকাশ পেলো নিম্নস্বরে। অতঃপর সভাপতির ভাষণে ড. আনিসুজ্জামান মাত্র তিনটি শব্দের একটি বাক্যে সব গুঞ্জনের অবসান করে শান্তির বাতাবরণ এনে দিলেন মিলনায়তন পূর্ণ সকলের মনে। শব্দ তিনটি ছিল : রবীন্দ্রনাথও তো মানুষ!
তারপর এই তিন শব্দের কথার সূত্র ধরে তিনি বিস্তারিত বললেন। এই বিস্তারও ছিল মিতবাকের আশ্চর্য কুশলী ও বিষয়ের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ।
সেই সন্ধ্যা থেকে আনিসুজ্জামান স্যারের প্রতি আমার আলাদা রকমের শ্রদ্ধা ও অন্যরকম বিবেচনা। তারপর তাঁর অভিসন্দর্ভ ‘মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য’ থেকে শুরু করে সর্বশেষ ‘বিপুলা পৃথিবী’তে তিনি লিখে রেখেছেন বাক সংযমী এক মনীষার গবেষণা ও প্রামাণ্য আকর গ্রন্থসমুহ।
বাংলাদেশ সৃষ্টির সূতিকাগার ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ ও পরবর্তীতে প্রতিটি গণতান্ত্রিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অংশগ্রহণ জাতির কাছে তাঁকে অনিবার্য অভিভাবক হিসেবে পরিগণিত করেছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবেই শুধু নয়, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদের বক্তৃতা লিখার মতো গুরু দায়িত্বও তিনি পালন করেছেন পরম বিশ্বস্ততার সাথে।
আনিসুজ্জামানের আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ : স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংবিধান রচনায় তাঁর অংশগ্রহণ। ড. কামাল হোসেনের আহবানে তিনি এই কাজে অংশগ্রহণ করেন। ‘সংবিধান খসড়া প্রণয়ন কমিটি’র প্রধান ড. কামাল হোসেনের ইংরেজিতে লিখিত খসড়াকে আনিসুজ্জামান বাংলায় অনূদিত করেছেন। সংবিধানের কোনো কোনো অনুচ্ছেদ বা এর ধারা ইংরেজি থেকে হুবহু বাংলা অনুবাদে কঠিন মনে হলে আনিসুজ্জামানের পরামর্শে তৎকালীন আইনমন্ত্রী ও ‘সংবিধান খসড়া প্রণয়ন কমিটি’র প্রধান ড. কামাল হোসেন সেই অনুচ্ছেদ বা ধারা অনুবাদে সহজ বাংলা করা যায় এরকম ইংরেজি প্রণয়ন করেছেন।
বঙ্গবন্ধু তাঁকে শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিতে চেয়েছিলেন। আনিসুজ্জামান বঙ্গবন্ধুর আহবানে সাড়া দিয়ে এই দায়িত্ব গ্রহণ করতে মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে বিলেত থেকে এসেছেন ১৯৭৫ সালের ১২ আগস্ট। এর দুই দিন পর থেকে বাংলাদেশের ইতিহাস ভিন্ন।
‘আমার একাত্তর’ ‘কাল নিরবধি’ ‘বিপুলা পৃথিবী’ আনিসুজ্জামান স্যারের জীবনের তিনটি পর্বে বিভক্ত আত্মজীবনী। এই তিনটি গ্রন্থ একজন মনীষীর ব্যক্তিগত জীবনের তিনটি পর্বই শুধু নয় বরং বাংলাদেশ রাষ্ট্রের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ইতিহাসের প্রামাণিক আকর দলিল।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে আনিসুজ্জামান সর্বাগ্রগণ্য অভিভাবকদের
অন্যতম। ১৯৩৭ ইংরেজি সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি তিনি জন্মগ্রহণ করেন। আজ তাঁর জন্মদিন।
জন্মদিনে আনিসুজ্জামান স্যারের প্রতি আমার অফুরান শুভেচ্ছ ও বিনম্র শ্রদ্ধা।দেলওয়ার এলাহী