-দেলওয়ার এলাহী
কানাডার অন্যান্য প্রভিন্সের মতো টরন্টো ও এর পার্শ্ববর্তী শহরেও প্রবাসী বাংলাদেশিদের সংখ্যা ক্রমে বেড়েই চলেছে। এবং প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রাণপ্রাচুর্য ও স্বতঃস্ফ‚র্ততাও অনুভব করা যায় এই শহরের যে কোন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে উপস্থিত হলে। বেঙ্গলি ফেস্টিভ্যাল, পথ মেলা, বাংলা মেলার সাফল্য দেখে বুঝা যায় এই শহরে আমাদের মানুষের ক্রম স¤প্রসারণের ধারা।
শুধু কি তাই? ইতোমধ্যে এই টরন্টো তথা কানাডার ইতিহাসে দুটি মাইলফলক রচিত হলো। ২০১৮ সালে অন্টারিও প্রভিন্সিয়াল পার্লামেন্টে বাংলাদেশের ডলি বেগম বিপুল ভোটে জয়লাভ করে বহুজাতির এই কানাডায় প্রবাসী বাংলাদেশিদের চিরকালের অগ্রযাত্রায় একটি উজ্জ্বল উদাহরণ সৃষ্টি করলেন। ২০১৯ সালে গ্রীষ্মের ছুটিতে এই টরন্টো শহরেই প্রবাসী বাংলাদেশিদের ক্রমশ বিজয় যাত্রায় রচিত হলো আরেকটি স্থায়ী আনন্দ উৎসব। প্রবাসী বাংলাদেশি অধ্যুষিত হিসেবে বিখ্যাত টরন্টো শহরের ডানফোর্থ এলাকায় রাজপথ বন্ধ করে অনুষ্ঠিত হলো ঞযব ঞধংঃব ড়ভ ইধহমষধফবংয। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, টরন্টো শহরে অনেক সংগঠনের আয়োজনে মেলা হয়, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। এবং এই মেলা বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সাফল্যের ব্যাপ্তিতে ক্রমশ বৃদ্ধি পেলেও তা হয় কোন কোন একক বা একাধিক সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানের ব্যানারে। কিন্তু ঞযব ঞধংঃব ড়ভ ইধহমষধফবংয যেন সকল মানুষের। সকল সংগঠনের। সকল সাংস্কৃতিক সংগঠক বা নেতা কর্মীর। এ এক অভ‚তপ‚র্ব উদ্দীপনাপ‚র্ণ জমায়েত।
এই শহরে প্রবাসী বাংলাদেশিদের বহু সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে উঠেছে। এবং এই সংগঠনগুলোর নিয়ত চর্চা ও চেষ্টার ফলে বাংলাদেশের বাইরে বহির্বিশ্বে বাংলা সংস্কৃতি
চর্চায় টরন্টো এক বিশেষ সম্মানের স্থান অধিকার করে নিয়েছে। কানাডা যেহেতু বহুজাতিক ও বহুভাষী একটি সংস্কৃতিবান্ধব দেশ, তাই এখানে বাংলাদেশের কোন কোন সংগঠন তাদের কার্যক্রম বাংলা ছাড়াও আরো ভাষাভাষী মানুষের মিশে যাওয়ার প্রচেষ্টায় কাজ করে যাচ্ছেন। টরন্টো ফিল্ম ফোরাম সেরকম একটি সংগঠন। টরন্টো ফিল্ম ফোরাম চলচ্চিত্র নির্মাণ ও প্রদর্শনী ছাড়াও বহুভাষী চলচ্চিত্রকেও প্রদর্শনের আওতায় এনে শুরু করেছেন – মাল্টিকালচারাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল। এবার এই সংগঠন আয়োজন করলো তৃতীয় মাল্টিকালচারাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযোগ্য যে, বাংলাদশের বিকল্পধারার চলচ্চিত্র নির্মাণ আন্দোলন যাদের হাতে শুরু হয়েছিল; তাদের প্রথম সারিতে থাকা কয়েকজন মিলেই প্রতিষ্ঠা করেন টরন্টো ফিল্ম ফোরাম। ফিল্ম ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এনায়েত করিম বাবুল গত শতকের আশির দশকের মধ্যভাগে নির্মাণ করেন ‘চাক্কি’ নামের বিকল্প ধারার চলচ্চিত্র। যা বাংলাদেশের বিকল্প ধারার প্রথম হাতে গোনা কয়েকটি চলচ্চিত্রের একটি। এই সংগঠনে আরো আছেন বিকল্প ধারার চলচ্চিত্র নির্মাতা ও বাংলাদেশ শর্ট ফিল্ম ফোরামের এক সময়ের সভাপতি আমিনুল ইসলাম খোকন। আছেন চলচ্চিত্র গবেষক মনিস রফিক। আছেন অভিনেতা, নির্মাতা, নাট্যনির্দেশক আহমেদ হোসেন। আরো আছেন চলচ্চিত্রকার সাইফুল ওয়াদুল হেলাল, চলচ্চিত্রকার নাদিম ইকবাল, চলচ্চিত্র শাকিল হান্নান প্রমুখ। লেখায়, নির্মাণে, অভিনয়ে, গবেষণায় জড়িত অনেক সৃজনশীল মানুষদের নিয়েই গঠিত হয়েছে টরন্টো ফিল্ম ফোরাম। ফিল্ম ফোরাম আয়োজিত এবারের তৃতীয় মাল্টিকালচারাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল টরন্টো প্রবাসীদের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ১৪ জাতির ২৭টি ছবি ফেস্টিভ্যালে প্রদর্শীত হয়। ১৯৭৬ সালে টরন্টো ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের প্রতিষ্ঠাতা জুটি ইয়াংকা ভ্যানডার কক ও হ্যান ভ্যানডার ককের একজন মিসেস ইয়াংকা ভ্যানডার কক মাল্টিকালচারাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের লাল গালিচায় হেঁটে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ঘোষণা করেন ও উদ্দীপনাপূর্ণ শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন।
ভাবা যায় এবারের তৃতীয় মাল্টিকালচারাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে টরন্টো ফিল্ম ফোরামের সঙ্গে জড়িত চার জন সদস্যের নির্মিত চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়েছে! প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য এবং বাংলা চলচ্চিত্রের বিকল্প ধারার দর্শকদের জন্য এটা অনেক বড় একটি বিষয়। এইসব ছোট ছোট পদক্ষেপের মাধ্যমেই একাত্তরে অর্জিত বাঙালিদের ত্যাগ ও তিতিক্ষার ফসল সোনার বাংলাদেশের মানুষের মানবতাবাদী মনোভাবের মূল দর্শনকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেবে। আর এটাই হবে মানবতার জন্য, গণতন্ত্রের জন্য, আইনের শাসনের জন্য আত্মত্যাগকারী সকল শহিদের প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা।